লাইন ধরে
ইঁদুরটা ছুটছে। ট্রেনের দিকেই । কী সাংঘাতিক ! এখুনি
কাটা পড়বে যে। এখুনি
রক্তে ভেসে যাবে । এসব ভালোলাগে না সুমির । একদমই না। রক্ত দেখলে
মাথা ঘোরায়। বমি পায়। পেচ্ছাপ পায়। হঠাৎ
চিৎকার করতে যাবে... বলতে যাবে ,ওকে বাঁচান...কিন্তু
গলা দিয়ে একটুও স্বর বের হয়
না... পাশের
জনকে কিছু একটা
বলবে... এরই মধ্যে
ট্রেনটা ঢুকে
যায়। দু'হাত দিয়ে চোখ ঢাকে সুমি। মনে হয় রক্ত ছিটকে এসে তার
মুখে
লেগেছে! রুমাল দিয়ে মুখটা মোছে। ট্রেন
এসে থামে। গেটটা সামনেই। উঠে পড়ে এক ঝাঁক মানুষের সাথে।
ট্রেনটা
আজ একটু দেরি করেই ঢুকল । বেশ ভিড় আজ । ঠেলেঠুলে নিজেকে পাকা সাঁতারুর মতো নিয়ে গেল জনসমুদ্রে। সেখানে কত হাত! কাঁচা পাকা। কত সাঁতার ! চিত-ভুট। এভাবে এগোনো। সামনে। স্টেশনের পর স্টেশন। একটার
পর একটা। লোক নামে । ওঠে তার দ্বিগুণ। কোনোমতে একটা বারে হাত রাখে । মনে হয়
কিছু একটা
হেঁটে যাচ্ছে
আঙুলের উপর
দিয়ে। চট করে
হাত সরিয়ে নেয়। দেখে সেই ইঁদুরটা ! যাক্ তাহলে মরেনি! রক্তাক্ত কাণ্ড ঘটেনি। কিন্তু এখানে কী করে?
ট্রেন ছুটছে । শেষমেশ গুমায় এসে একটা বসার জায়গা হল। আজ একটু আগেই পেল । অন্যদিন অশোকনগর - হাবড়ায় গিয়ে পায়। মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করছে। একটু শুতে পারলে হত। কিন্তু তা আর হয়না । এদিকে পাশের
টাকমাথাটা তার গায়ে
এসে পড়ছে বারবার । সেও ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। টাকটার চোখ খুলে মাঝে মধ্যে একটু লজ্জা
পাওয়া। যেন বামিয়ান ধ্বংসের পর অন্ধগুহার চাউনি । দু'পাটি
বের করে আবার যে-কে সে-ই।
ঠাকুরনগরে বেশ ফাঁকা। পা-টা ফট করে টান দিল সুমি। মনে হল পায়ের উপর
সেই ইঁদুরটা ! পা-দুটো তুলে দিল
সামনের
ফাঁকা বেঞ্চে । দু'একজন বিষয়টাকে
ভালো চোখে দেখল না। একজন বলেই ফেলল, ফাট দেখেছো, সব যেন বাবাতে মাল !
ট্রেন কখন বনগাঁ এসে গেছে খেয়ালই নেই সুমির। লোকজন নেমে আবার উঠতেও শুরু করেছে। একজন বলল, দেখি দিদি পা-টা ! ও হ্যাঁ ! বলেই ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়ে । ঘড়িতে তখন ৪-১০ । রিক্সাভ্যান ধরে বাড়ির পথে। দত্ত পাড়া ।
দরজা খুলে ঢুকে পড়ে সুমি। কুলারটা অন করে। বিছানায়
টিশার্ট এসে পড়ে । তারপর জিনস, ব্রা , প্যান্টি
এক এক করে। যেন একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে রাগবি খেলোয়াড়দের মতো। বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। খুলে গেল
শাওয়ারের মুখ। বৃষ্টির মতো একটা শব্দ। যদিও এবারে
বৃষ্টি
অভিমান করে বসে আছে কিশোরী প্রেমিকার মতো। তবু শব্দেই সে অনুভব লেগে
থাকে । জলধারা চুল থেকে
গড়িয়ে ব্যাক ক্লিভেজে মধ্যে মুখ লোকায় । যেন এক
আশ্চর্য নদীকথা। মায়াময় সুরের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। গভীর গহনে ।
টেবিলে
কাচের
গ্লাস। গ্লাসে জল । পাশে কিছু ওষুধের পাতা। এখনকার মানুষদের নিত্যসঙ্গী । বন্ধুর থেকেও বন্ধু। পাশের নীরব মুঠোফোনটা
হঠাৎ নড়ে চড়ে বসে। বেশ কয়েকবার। জলটা কাঁপছে। অদ্ভুত ভাবে। সে কাঁপুনিতে
ঘরের
পশ্চিম কোণ থেকে আসা একটা মরা আলো পক্ষাঘাতগ্রস্থ রুগীর মতো কাঁপছে। থামছে। কাঁপছে। কাঁপছে । থামছে। যেন এও এক হৃৎপিণ্ড। সময়ের। কোথা থেকে ইঁদুরটা চলে আসে! মুঠোফোনে
মুখ রাখে। যেন লিপস্ লক্
করে আছে।
বাথরুম থেকে দুটো নগ্ন পা এগিয়ে এল। ভেজা। বিন্দু বিন্দু ঠাণ্ডা ছোঁয়া। ডানপায়ে একটা সুতো বাঁধা । নূপুরের মতো। পা'দুটো এগিয়ে চলে
ক্রমশ। একটা তোয়ালে খসে পড়ে পায়ের পাতার কাছে। আর তারপরই নাইটিতে ঢেকে যার দৃশ্যমান সুতো। মুঠোফোনটা
বড়ো আদরের সাথে তুলে নেয় সুমি। কিছু কথা হল । কিছু হল না। কিছু পরা হল । কিছু হল না। কিছু প্রসাধন হল। কিছু হলনা। এবারে
নিজেকে এলিয়ে দিল বিছানায় । চোখে ঘুম। ঘুমে স্বপ্নের গাঢ় আঠা। সে স্বপ্নে ঢুকে পড়ে
সারি সারি নিয়নের আলোর নিচে সারি সারি গাড়ি। দামি সিগারেট । ভদকা। নাইট ক্লাব। চড়া মিউজিক। ডান্সফ্লোর। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঘর ভরে যায় । মাথা ঘোরাতে থাকে । উঠে পড়ে । চোখমুখে জল দিয়ে টিভিটা অন করে। আবার
বন্ধ করে দেয়। পিসিটা খোলে । ইঁদুরটা
নড়েচড়ে বসে। ফেসবুকে বেশ মেসেজ । বেশ রিকোয়েস্ট । জমে যায় । ইঁদুরটা মাঝে মাঝে লাফিয়ে ওঠে মুঠোর মধ্যে।
দুই
নদীর পাশে জীর্ণ বাড়ি। ইছামতী। পক্ষাঘাতগ্রস্ত । বাড়িটাও। ধোঁয়া উড়ছে একমুখ দাড়িগোঁফ থেকে। পরনে
খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ডেনিম জিন্স। ধোঁয়া একটা ছেড়ে একটা । পশ্চিম আকাশে তাপ কমছে ক্রমশ ।দাড়িমুখো
ঘাসের বুকে বসে। ডান হাতে ভর দিয়ে চোখ রেখেছে নদীর বুকে ছই দেওয়া নৌকার দিকে । হাতের মুঠোটা
খোলে
। শিশি । কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে
দেয় ঝোপজঙ্গলে। এবারে কাশে। খুব । কাশতে কাশতে প্রাণ বেড়িয়ে যায়। তবু আবার একটা ধরায় । তিন চারটে বাচ্চা ছেলে এসময়ে ঢুকে পড়েছে
পোড়ো বাড়িটিতে। ছেঁড়া হাফপ্যান্ট কোমরের
কালো সুতোতে কোনও মতে ঝুলছে। খালি গা । চুল উষ্কখুষ্ক। সারাটা শরীরে কালি-ঝুলি। হাতে পাটকাঠি-কঞ্চি জাতীয় কিছু। একটা আবার কোথা থেকে বেলুন খুঁজে পেয়েছে। তা নিয়ে কাড়াকাড়ি। সবচেয়ে
ঢ্যাঙা ছেলেটির দখলে সেটি। সে ফোলাবার চেষ্টা করে। ফোলে। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দাড়িমুখোর
চোখ আটকে ছিল ঘাসের উপর পড়ে থাকা
একটি পরিত্যক্ত
কন্ডোমের
উপর। হাওয়ায়
মাঝে মাঝে
নড়ছে। এবারে
সে মুখ ফেরায় ছেলেগুলোর দিকে।
তিন
একটা কলিং বেল বেজে
ওঠে
। দরজাটা খুলে যায়। ঢুকে পড়ে সে- পুরুষ। দরজাটা বন্ধ হয়
। ইঁদুর এখন মুঠোমুক্ত। শান্ত। ধ্যানস্থ।
দাড়িমুখো এগোতে থাকে
পাড়ের দিকে। নদীতে চোখ। জলে তার
প্রতিচ্ছবি । নিজেকে নিজেই চিনতে পারে না। পশ্চিমাকাশ লাল হয়ে আসছে ক্রমশ। তবু চেয়ে থাকে। ফ্যাল ফ্যাল করে। লালচে
জলে ধোঁয়া ওড়ে। কাঠিটা ফেলে দিয়ে উঠে পড়ে। কাঠিটা
ভাসতে ভাসতে এগোতে থাকে। নৌকার দিকে চায়। মাঝিহীন। বাঁধা । গাছের সাথে। তবু ছইয়ের মধ্যে টিম টিম করে একটা হেরিকেন জ্বলে, যেন পৃথিবীর সকল ব্যথা বেদনার মহান সাক্ষী সে। নদীর বুকে লেখা যতসব ব্যথাযাপন এই করুণ হ্যারিকেনের চোখ দেখে চলেছে যুগের পর যুগ। একটু পরে মাঝির সাথে নেমে পড়বে কালো জলে । সারারাত জেগে থাকবে আর বেদনার মতো শুকিয়ে আসা কেরোসিনের পাশে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়বে সুবোল হালদার।
কন্ডোমটা হঠাৎ চলতে শুরু করে । একটা ইঁদুর
ঢুকে পড়েছে। কিছুটা এগিয়ে থেমে যায় । আবার এগোয়। এবারে থামে। পা দিয়ে পিষে দিতে চায়, আর মুহূর্তেই ছুটতে থাকে শুকনো ঘাসের উপর দিয়ে। এখুনি রক্তে ভেসে যেত কন্ডোমটা ! বুটের আঘাতে। এখন নির্জন
দ্বীপের ঝাউবনের মতো
সেটি কেবলই
হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে । ভাঙা পাঁচিলের কাছে ঢ্যাঙা
ছেলেটা এখনও বেলুন ফোলাতে থাকে । নৌকাটা দুলতে থাকে। প্রচণ্ড। নৌকার
আলোটা
যুবতী হয়ে
ওঠে। গোধূলির যৌনতা ছড়িয়ে পড়ে ঘাসে ঘাসে। বেলুনটা ফুলতে ফুলতে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে
যায় । কান বন্ধ করে অন্য ছেলে গুলো। মারতে যার ঢ্যাঙাকে। ছুটে পালিয়ে যায়। ইঁদুরটাও। ঘাসের মধ্যে।
বিছানায়
চারটি পা বেড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই
টোকা খেয়ে কাচের
গ্লাসটি মেঝেতে ভেঙে চৌচির! সেদিকে নির্বিকার চাউনি। জল ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের লাল আলোও। সেখানে । সেখানে দেখা যায় খেলাধুলো। কাচের টুকরোর উপর চলছে অনন্ত খেলা । নদী। নৌকা। মাঝি। হেরিকেনের টিম টিম আলো। দিগন্তের ছেলেগুলো। বেলুন। ইত্যাদি।
ইঁদুরটা নেমে আসে মেঝেতে। জল পান করে। চলে যায়। চুপি চুপি।
দাড়িমুখো
উঠে পড়ে। হাঁটতে শুরু করে। হারিয়ে যার । অন্ধকারে। ধীরে ধীরে