গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১২ মে, ২০১৪

তাপসকিরণ রায়

হরেন্দ্র বাবুর মনের শান্তি
তাপসকিরণ রায়

কিছু  দিন আগেই হরেন্দ্র বাবু ছিলেন ঘোর নাস্তিক। তাঁর মতে ভগবান,আল্লহ বলে কিচ্ছু নেই। দুর্বল লোকদের দুর্বলতার মধ্যে হল ভগবানের বাস ! তাঁর মতে সত্যি কথা বলে কিছু নেই,সৎ লোক আজকাল একটাও নেইসাধু সন্ত সব বুজরুকিনিজের আখের গোছানোর ফন্দি ফিকির ছাড়া আর কিছুই নয় ইত্যাদি ইত্যাদি ধরনের কথা লেগেই থাকে হরেন বাবুর মুখে। 
তাঁর মতে ভালবাসা বলতে আজকাল আর কিছু নেই। ওই ছেলে মেয়েরা আজকাল পথে ঘাটে শুধু নাকি পাগলামি করে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই বকাটে ছেলেগুলি মেয়ে পটাতে লেগে যায়...ও সব প্রেম টেম কিচ্ছু নাই--এখন শুধু  বইয়ের পাতায় মুখরোচক গল্প। পিওর দুধের যেমন অকাল পড়েছে,ঠিক তেমনি প্রেম ভালবাসার !

আজকাল পয়সা সবাই চেনে--ভালটা বেশী পয়সা দিয়ে কিনে খাও বিনা পয়সায় আজকাল কেউ কুটোটাও নাড়ে না। প্রেম ভালবাসাও দোকানে বিক্রি হয়। ছেলে মেয়েরা ঘর সম্পত্তি দেখে লভ করে--সে সঙ্গে গতর তো দেখেই--মায় শরীর বাজিয়ে পর্যন্ত দেখে নিতে চায় !
হরেন্দ্র কেবল মাঝে মধ্যে নিজের গিন্নীর কাছে বশ্যতা স্বীকার করন তাঁর মতে এমনটা নাকি পুরুষের ধর্ম। না,বশ্যতা বললে ভুল হবে,সন্ধি বললেই ঠিক হয়--রাত বিরেতের সন্ধি--তা না হলে সংসার ধর্ম রসাতলে যাবে যে--রস কষ বলতে কিছু তো থাকবে প্রেম ভালবাসার এই অর্চনটুকু যদি না থাকে তবে কিসের এই ভালমন্দরাতের চাঁদতারা দেখা,দিনের নীলাকাশ দেখা ! সবকিছুই যে ডবগোল মেরে যাবে !

এই প্রকৃতি নিয়ে ভালবাসার আদিখ্যেতা,দিনের নীলাকাশ,মেঘ সাদা ভেলা,পেঁজা তুলোর সাজসজ্জা,আহা কি সুন্দর গো ! আর রাত চত্বরের রাজত্বে গা ঢাকা দিয়ে যা খুশি করে যাও,রাতের মশা মারার ভান করো,জানলা গলানো চাঁদের রশ্মি দেখো,,মরা আকাশ জ্যোৎস্না দেখো--আর চুপি চুপি বিছানার শয্যা পাত--দু মুখের মাঝে আড়াল রেখে পঙ্কের পঙ্কজ কোরক মাখো ! রাত বড় নেশার,তাই নাকি চুপি চুপি ফুলেরা ফুটে ওঠে অন্ধকারে ? এতক্ষণ পরে হরেন যুতসই কিছু একটা মনে করতে পারল মনে হলযাকে বলে কাব্যিক কিছু !

ইদানীং কালে হরেন্দ্রের নাস্তিকতা অনেকটা কমে গেছে। বয়সটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ক্ষোভ ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ধর্মকর্ম বলে একটা কথা আছে--গড ভগবান আল্লাহ কিছু তো একটা আছেন বটে,আজকাল তাঁর এমনটা মনে হয়। সর্বশক্তিমানকে ডাকার ইচ্ছে হয়--মাঝে মাঝে অবশ্য মনে হয় কিছু না,এসব মনের দুর্বলতা--বয়স বাড়ছে শরীরের শক্তি কমে আসছে আর দুর্বল নরম ভাবনাগুলি ক্রমশ বুকের ওপর চেপে বসছে। ইদানীং তিনি নাস্তিক আস্তিকের মাঝখানে বিরাজমান।
তারপর সেই স্বপ্ন--সেদিনের স্বপ্ন যেন তাকে আরও দুর্বল করে ছাড়লএই তো সে দিনের কথা।  তিনি দিবা নিদ্রা দিতে চান না। কিন্তু চাওয়া,না চাওয়া অন্য ব্যাপার--পেট পুরে গব্য ঘৃত চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় সব কিছুর পর অতি ভার পেট নিয়ে কাহা তক বিছানা থেকে দুরে থাকা যায় ? শুবেন না বলে বিছানায় আরাম করে বসতে গিয়ে ভাবলেন--না,আরাম না--আরাম হারাম হায় ! তার চে বজ্রাসনে বসা যাক। তাতে পেটের ওজন যেমন কম হবে,তেমনি হজম হয়ে যাবে সব কিছু--আর জড়ত্ব কেটে গিয়ে ঘুম ভাবও কমে যাবে।

কিন্তু সব বৃথা--বজ্রাসনেও তাঁর ঝিম আসছিল। তারপর আর কি হবে,আজীবনের অভ্যাস যাবে কোথায়,কখন যেন তিনি চিৎপাত হয়ে পড়েছেন নিজেও তা জানেন না ! 
বয়সের আর এক ধর্ম নাকি নাক ডাকা। নিজের নাক ডাকায় নিজের নিদ্রাপাত ! আবার ঝিম--আবার ঘুম। ভেতো ঘুম বলে একটা কথা আছে।  বলতে গেলে নেশারই নামান্তর। আর তার মাঝেই যত উদ্ভট স্বপ্ন--উদ্ভট শব্দটা বলেই হরেন জিভ কাটলেন,না,না,দেব দেবতার নামে এমনটা বলা অনুচিত। ক্ষমা করে দিও ঠাকুর!

স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল হরেনের। দিবা স্বপ্ন নাকি সত্য হয় না--কিন্তু এই মুহূর্তে হরেন্দ্র অন্তত তা মানতে পারছেন না। এ যে জলজ্যান্ত দেখা। তিনি দেখলেন,এক সাধু তাদের ঘরের দ্বারে এসেছেন। সে কি চেহারা ! সারা গা ছাই ভস্ম মাখা। পরনে গেরুয়া--না ঠিক গেরুয়া নয়--লাল আর গেরুয়ার মাঝামাঝি রঙ। কপালে ভস্মের লম্বা চওড়া তিলক। ওরে বাবা ! হরেন দেখলেন যে সে তিলক কপাল থেকে সিধা নেমে গেছে নিচের দিকে--হরেন দেখে নিলেন সে তিলকের টান নাভি ছাড়িয়ে আরও নীচে চলে গেছে ! একি সাধু বাবা !-- যে সাধু ঘণ্টা রাম !

--জয় ভোলানাথ ! ভোম ভোম ভোলা ! সাধু যেন গর্জন করে উঠলেন 
স্বপ্নে সেই যেন আগের নাস্তিক হরেন্দ্র জেগে উঠলেন,তিনি চীৎকার দিয়ে উঠলেন,এই ভোলানাথ,এখানে কিচ্ছুটি হবে না--জাগা মাপো দেখি !

ওরে বাবা ! সাধুর চোখ না যেন আগুনের গোলা ! হরেন্দ্র দেখলেন,সাধু ভীষণ রেগে গেছেন--কিন্তু হরেনও ততোধিক রেগে গিয়ে বলে ওঠেন,বলছি না,এখান থেকে ভাগো !
হরেন্দ্রের এবার চোখ পড়ে সাধুর বগলে ঝুলে থাকা কাপড় প্যাঁচানো ঝোলার দিকে। তিনি মনে মনে ভাবেন,এর মধ্যে ঠিক চুরির মাল রাখা হবে ! তিনি বলে ওঠেন,ঝোলা মে ক্যা মাল হায় নিকালো !
সাধু তার বড় গোল গোল লাল চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন,ইসকে অন্দর ভস্মদেব হয়। তুই ওকে দেখবি আর ভস্ম হয়ে যাবি। 

হরেন রেগে গিয়ে সাধুর ঝোলা ধরে মারলেন এক টান। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝোলা ছিঁড়ে তার সমস্ত জিনিসপত্র নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গেল আর কি ! হরেন দেখেন,সত্যি এক শালগ্রাম শিলার মত ছাই মাখা পাথর ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে ! তার দিকে চোখ পড়তেই হরেন্দ্র যেন ভস্ম হয়ে গেলেন--তিনি চেষ্টা করেও নড়েচড়ে নিজের দেহ প্রকাশ করতে পারছেন না। এদিকে সাধু প্রচণ্ড উচ্চস্বরে,হা হা হা করে হাসতে লাগলেন...সে হাসির আওয়াজে হরেণের ঘুম ভেঙে গেলো--ধড়ফড় করে তিনি বিছানায় উঠে বসেন। 

কি বিশ্রী স্বপ্ন রে বাবা ! এমনটা হওয়া তো উচিত হয় নি। সাধুর ঝোলা ছিঁড়ে তিনি কোন বড় অপরাধ তো করে ফেললেন না ? আস্তিক হরেন মনে মনে ঠিক করলেন,আজ সোমবার,তিনি মন্দিরে গিয়ে না হয় বাবা শিবের মাথায় জল চড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে আসবেন। 

এমনি হয়েছে--আজকাল হরেন্দ্রের নাস্তিকতার থেকে  আস্তিকতার দিকের ভার যেন বেড়ে গেছে। নিজের মনে মনে বিরক্ত হয়ে তিনি বলে উঠলেন,সব বয়সের ধর্ম--সব বয়সের ধর্ম। 
হরেন্দ্র সন্ধ্যের আগে আগে গিয়ে রিক্সায় চড়ে বসলেন। তাঁকে শিব মন্দিরে যেতে হবে। রিক্সা গড়িয়ে চলছে মন্দিরের দিকে। এদিকের রাস্তাঘাট বড় খারাপ। এবড়ো খেবড়ো--বারবার ঝাঁকুনি খেতে খেতে এক সময় রাস্তার মাঝখানে ঘট ঘটাং শব্দ হয়ে রিক্সা থেমে গেল। সিক্সোয়ালা রিক্সা থামিয়ে সামনের চাকার সামনে গিয়ে বসে পড়ল। এত এবড়ো খেবড়ো নুড়ি পাথর কাঁকড়ের রাস্তায় কত সময় আর রিক্সা চলে ! রিক্সা পাঞ্চার !

হরেনের শঙ্কা হল শিব ঠাকুর বড় নারাজ তার ওপরে। না হলে এমনটা হল কেন ?--পথে রিক্সা পাঞ্চার ! তাঁর চোখ পড়ল,রিক্সার সামনের চাকার রিং একেবারে মাটির সঙ্গে লেগে আছে। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন,একটা পাথরের টুকরোএকেবারে রিক্সার চাকা ঘেঁষে পড়ে আছে এগিয়ে গেলেন তিনি। কালো একটা নুড়ি পাথর--আর সেটা অদ্ভুত ধরণের,শিব লিঙ্গের আকৃতির ! হরেন্দ্র হাঁটু নিচু করে সেখানে বসে গেলেন। চোখের সামনে তুলে ধরলেন নুড়ি পাথরটা। বাঃ, যে সেই মত,সেই শালগ্রাম শিলার মত ! অবিকল তাই--কেবল এতে ছাই মাখা নেই--এটুকু  যা পার্থক্য! 

ভীষণ আশ্চর্য হলেন হরেন্দ্র বাবু--মনের মধ্যে দুপুরের স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। খেপা সাধুর কথা মনে পড়ে গেল--সে সঙ্গে তার ভস্ম হয়ে যাবার কথাও। ভস্ম হয়ে যাবার পর তিনি নিজেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না 
! 
এবার কপালে ঠেকালেন তিনি সে শিলা মন্দির এখান থেকে এখনও বেশ কিছুটা দূরে এক কিলোমিটারের কাছাকাছি তো হবেই। কি মনে হল হরেন বাবুর,তিনি নিজের গায়ের পাঞ্জাবির এক পাশ  দিয়ে শিবাকৃতির শিলাটি সযত্নে ঢেকে নিলেন। মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিয়ে ফিরতি এক রিকশাওয়ালাকে ডেকে চড়ে বসলেন তাতে। ঘরের দ্বারে এসেই তিনি তাঁর গিন্নীকে হাঁক দিলেন,কোথায় গো গিন্নী,তাড়াতাড়ি এস এখানে। 

হন্তদন্ত হয়ে গিন্নী এসে বললেন,কি হল গাঁ ?
--দেখো কাকে নিয়ে এসেছি--বলে পাঞ্জাবির কাপড়ের ভাঁজ খুলে শিব শিলাকে গিন্নীর চোখের সামনে তুলে ধরলেন। 
গিন্নী মহা আশ্চর্য হয়ে বললেন, কি--শালগ্রাম শিলা তুমি পেলে কোথা থেকে ?
--সব বলছি গিন্নী। এখন তাড়াতাড়ি স্নান-টান সেরে এসো--আমিও স্নান সেরে আসছি গো। 
হরেন্দ্র বাবু তাঁর ঘরের ঠাকুরের আসনে পুরোহিত ডেকে নিয়মাদি পালন করে স্থাপনা করলেন সেই শালগ্রাম শিলারূপী শিব 
আশপাশের অনেক লোকের কানে তখন কথাটা চলে গেছে যে হরেন্দ্র বাবু পথের মাঝে স্বয়ংভূ শালগ্রাম শিলা কুড়িয়ে পেয়েছেন। 

পরদিন থেকে নিয়ম মত হরেন্দ্র নুড়ি পাথরকে শিবজ্ঞানে পূজা করে চলেন পাড়া পড়শি সবাই জানে হরেন্দ্র বাবুর বাড়ির শিবশিলা বড় জাগ্রত। 
হরেন্দ্র বাবু নিজেও দেখেছেন,শান্তি,চির শান্তি-- শিলা প্রতিষ্ঠার পর সত্যি তাঁর মন শান্ত হয়ে গেছে। তিনি যত কিছু দেখেন,যত কিছু শোনেন,তার সব কিছুর মধ্যেই সরলতা খুঁজে পান,সব কিছু মিলিয়ে যেন চারিদিকে শান্তি--পরম শান্তি বিরাজমান। 
                               সমাপ্ত