গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১২ মে, ২০১৪

দুপুর মিত্র


সাংবাদিকের পুঁথি

এক দেশে ছিল এক সাংবাদিক। তার ছিল একটি কলম। সাংবাদিকটির ছিল প্রচুর টাকা-পয়সা। কিন্তু সারাণ সে মন খারাপ করে বসে থাকত। পাঠক, এই গল্পটি পড়ুন। ভাল লাগতে পারে। সাংবাদিকদের চরিত্র কিন্তু অনেক রোমাঞ্চকর আর নানা অভিজ্ঞতায় ভরপুর। তার কলমের ছিল অনেক জোর। কলমের এক খোঁচায় সে অনেক কিছু করে ফেলার মতা রাখত। এজন্য সংবাদ পত্রের অফিসে তার নাম-ডাক যেমন ছিল, তেমনি ছিল তাকে দেখামাত্র অনেকের ভয়ে জুবুথবু হওয়ার খবরও। আরও একটি খবর তার সম্পর্কে শোনা যেত, তবে এটা ভেতরে ভেতরে অনেকেই আলাপ করত, কেউ সবার সামনে এসব আলাপ করতে ভয় পেত, তা ছিল উনি অনেক মিথ্যা সংবাদ লিখেন। অথবা বাংলাদেশে স্ক্যান্ডাল সাংবাদিকতার জনকও বলা যেতে পারে তাকে। টাকা পেলে উনি হেন কোনও সংবাদ নাই, যা ছাপিয়ে দিতেন না। যাই হোক নাম-ডাকের কথাই সবাই জানত। তাই দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে অনেক মানুষও আসত, তাদের নিপীড়নের খবরটি উনি যেন লিখে জানিয়ে দেন দেশবাসীকে। এটার কারণও ছিল, মানুষের রাষ্ট্রের ওপর থেকে আস্থা কমে গিয়েছিল। আইন-আদালত কারও কাছে গিয়েই মানুষ ভরসা পেত না। একমাত্র একটা সময় তৈরি হয়েছিল যে মানুষ সংবাদপত্রের ওপর আস্থা রাখছে বা সংবাদপত্র সত্য কথা বলার মতা রাখে।

তো একবার তার কাছেই এক লোক হাজির। তার সংবাদ ছাপিয়ে দিতেই হবে। অনেক টাকার ব্যাপার-সেপার। গোপনে এসে সব সংবাদের বিষয় তাকে দিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে টাকা-পয়সাও। ওই লোকটি সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ভেরিফিকেশন করতে চান? সাংবাদিকটি বললেন- টাকা-পয়সা ছাড়া আমার আর ভেরিফিকেশনের দরকার নাই। পরদিন সংবাদ এল- ইউটিউবে ছেয়ে গেছে স্বপ্নার নগ্ন ভিডিও।

হুলস্থূল পড়ে গেল পুরো বাংলাদেশে। পুরো বাংলাদেশ বলতে, আপনিও পাঠক খুঁজতে লাগলেন সেই ভিডিও। যারা ইন্টারনেট ব্যবহার জানেন, তারা সবাই লুকিয়ে সেই ভিডিও খুঁজতে লাগল। সাইবার ক্যাফেগুলোতে বেড়ে গেল ভিড়।

সাংবাদিকটি সে দিন স্বাভাবিকভাবেই এলেন সংবাদপত্র অফিসে। এসে নিজের টেবিলে বসলেন। কেউ কেউ তাকে দেখে হাসছে বলে মনে হল তার। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তাকে আড্ডায় ডেকে নিলেন। একজন বললেন- দোস্ত গতকাল যে নিউজটা করছ, সেটা তো হিট। সাংবাদিকটি বললেন, হিট না হওয়ার কি আছে। সংবাদ তো এভাবেই খাওয়াতে হয়। আরেকজন বলল- দোস্ত, তুমি যে নিউজটা করছিলা, ভিডিওটা কি দেখছিলা? সাংবাদিকটি বলল- না, ভিডিও দেখার দরকার মনে করি নি। কেন ইউটিউবে কি ভিডিওটা নাই? বন্ধুটি বলল- আছে। সাংবাদিকটি বলল- তাহলে? বন্ধুটি বলল- আচ্ছা ভাবীর নামও তো স্বপ্না, তাই না? এবার সাংবাদিকটি একটু বিরক্ত হল বলে মনে হল। সাংবাদিকটি বলল- হ্যাঁ, কিন্তু এ কথা বলার মানে কি? বন্ধু বলল- দোস্ত ভিডিওটিতে যাকে দেখা যায়, তার চেহারাটা স্বপ্না ভাবীর মত। আমার ধারণা কেউ তোকে ফাসানোর জন্য স্বপ্না ভাবীর ছবি ভিডিও এডিটিং করে ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েছে। সাংবাদিকটি বিরক্ত হল এবং বিচলিতও হল মনে হল। এবং সেদিনের পর থেকে সাংবাদিকটিকে আর কোনও সংবাদপত্র অফিসেই নাকি দেখা যায় নি। এমন কি এখন সে কোথায় আছে, তাও কেউ জানে না।

গঞ্জিকাবৃত্তান্ত

একবার এক দেশে শিব ঠাকুরের ভক্ত বাড়তেই লাগল। এটা কিন্তু সত্যি পাঠক। পড়ার পর বলবেন যে কি সব গল্প বানিয়ে বানিয়ে লেখে  তা কিন্তু হবে না। হাজার-হাজার, লাখ-লাখ, কোটি-কোটি মানুষ ভক্ত হতে শুরু করল শিবের। শিব ঠাকুর এক পাহাড় থেকে নেচে বেড়ান আরেক পাহাড়ে। এক শ্মশান ঘাট থেকে উড়ে বেড়ান আরেক শ্মশানে। শিবের সাথে কোনও দেবতাই আর পেরে উঠছেন না। সবাই যদি শিবেরই ভক্ত হয়ে যান তাহলে অন্য দেবতাদের কি হবে ? দেবতারা যুক্তি করলেন, যাই হউক এই শিবকে ঠেকাতেই হবে। দেবতারা মর্ত্যে নেমে এলেন। শিবের কি এমন শক্তি যে সব মানুষ তার ভক্ত হয়ে উঠছেন। দেবতারা মানুষ রূপে শিবালয়ে ঘুরতে লাগলেন। খোঁজ করতে লাগলেন কি এই শিবের শক্তি। দেবতারা কয়েকদিন মর্ত্যে থেকে ফিরে গেলেন দেবতালয়ে।
একদিন সব দেবতারা শিবের কাছে গেলেন। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে মহাদেব, এ তোমার কেমন রূপ। মর্ত্যলোকে সকল মানুষ কেবল আপনারই ভক্ত হয়ে ওঠছে। মহাদেব হাসলেন। বললেন, কেন দেবকুল। এভাবে কেন বলছেন? এ সময় নারদ বলে ওঠলেন, কিন্তু মহাদেব আমি মর্ত্যলোক ঘুরে এসে দেখলাম, মনুষ্যকুল সত্যিকার অর্থে আপনার ভক্ত নয়। মহাদেব বিচলিত হলেন। বললেন, কি বলছেন এসব নারদ মুনী। নারদ বললেন, হে সত্যি মহাদেব, আমি মর্ত্য লোক ভাল করে ঘুরে দেখেছি। তারা কেউই আসলে আপনার ভক্ত নয়। মহাদেব বললেন, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। নারদ মুনি বললেন, আপনি মনুষ্যকূলকে নষ্ট হওয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। যা আপনার কাছ থেকে কাম্য নয়। আপনার কারণেই দেবতাদের সম্মান ুণœ হচ্ছে। মহাদেব এবার ক্রোধ সামলাতে পারলেন না। নারদ বলে চিৎকার করে ওঠলেন তিনি। কেঁপে ওঠল পৃথিবী। নারদ বললেন, বিশ্বাস না হয়, তো একবার মর্ত্য লোক ঘুরে আসুন মহাদেব। আমরা দেখে আসলাম, কেউই আপনার ভক্ত নয়, তাদের ভক্তি কেবল গঞ্জিকা সেবনে। হাজার-হাজার, লাখ-লাখ, কোটি-কোটি মানুষ আপনার মন্দিরে যাচ্ছে কেবল গঞ্জিকা সেবন করতে, আপনাকে ভক্তি করতে নয়। এইভাবে চলতে থাকলে দেবতাদের কোনও সম্মানই থাকবে না মনুষ্যকূলে।
সঙ্গে সঙ্গেই মহাদেব ধ্যানস্থ হলেন। এরপর থেকে মহাদেবকে কোনও দেবতাই নাকি গঞ্জিকা সেবন করতে দেখেন নি।