প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে বল্টু স্কুলের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল । আজ
নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে । গত
কয়েকমাস যা ধকল গেল । কোথা দিয়ে যে দিনরাত গেছে সে টেরই পায় নি । বাংলা
,ইংরাজী, অঙ্ক , ইতিহাস , ভূগোল সব একদম গুলে খেয়েছে । চারিদিকে বইখাতার পাহাড় তার মাঝে ঘার গুজে কখনও অঙ্ক করেছে । কখনও ইতিহাসের সন তারিখ মুখস্থ করেছে । কখনও ভূগোলের ম্যাপ এঁকেছে । তার ওপর ছিল বাবার কড়া নজর । একটু উঠলেই তার হুঙ্কার – কোথায় যাচ্ছ ? মা , তিনিও কম যান না । সকালের ঘুম বল্টুর খুব প্রিয় । তা কি একটু রেহাই আছে । কাকভোরে মা ঠিক ডেকে তুলতেন বল্টুকে । সকালটা যে কি বাজে লাগতো সে বলার নয় । মাঝে মাঝে সে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতো । কতকিছু আবিস্কার হয় রোজ
। এমন ওষুধ কেন বের হয় না । যা এক চামচ খেলেই । সেই মোঘল আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত । ইতিহাসের সব সন তারিখ ঝরঝরে মুখস্থ
হয়ে যাবে । বা একটা ক্যাপসুল গিলে
ফেললেই মাথাটা এমন খুলে যাবে যে পাটিগণিত
,বীজগণিতের সব অঙ্কের উত্তর মিলে যাবে সটাসট । আর যদি হাতে এমন ক্রিম লাগিয়ে নেওয়া যায় ।যাতে ভারতের ম্যাপটা পরোঠা না হয়ে ভারতের
ম্যাপই হবে । এসব ভাবাই সার ।কিছুই হয় নি । বল্টুকে সেই রাত জেগে পড়া মুখস্থ করতে হয়েছে ।পাতার পর
পাতা উত্তর না মেলা অঙ্ক কষতে হয়েছে । আজ
সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নময় দিনগুলি থেকে মুক্তি। বোর্ড পরীক্ষা শেষ । এখন অখণ্ড অবসর । যদিও অঙ্কটা নিয়ে একটু কিন্তু কিন্তু আছে । বল্টু সেটা ঠেলে সরিয়ে ফেললো মাথা থেকে ।
সকালের ঘুম বল্টুর
খুব প্রিয় । ইসসস......। কতদিন সে ভাল করে ঘুমায় নি । আজ বাড়ি গিয়েই লম্বা ঘুম দেবে । উঠবে তিনদিন পরে । সবাইকে বলে দেবে তাকে যেন কেউ
ডিস্টার্ব না করে ।
গেটের বাইরে আসতেই নিখিলের সাথে দেখা ।
নিখিল বল্টুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ।
সে বললো - নাইট শোয়ে
সিনেমা যাবি ?
‘নাইট
শোয়ে ? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? বাড়িতে আস্ত রাখবে না’ – আঁতকে উঠে বলে বল্টু । মনে ইচ্ছা থাকলেও সে সাহস দেখাতে পারলো না । বললো ‘না রে
আজই পরীক্ষা শেষ হল । আর আজই সিনেমা যাব । বাড়িতে দারুন বকুনি খাব’ । নিখিল কাঁধ ঝাকিয়ে বললো ‘তুই আর বড় হবি না কোনদিন’ ।
যদিও বল্টু ভেবেছিল বোর্ডের
পর সে সাবালক হয়ে যাবে । কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঠিক সাহসে কুলালো না । পাখির মত
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সে বাড়ি ফিরল ।উঃ কি আরাম । কি স্বস্তি ।চারিদিকে এত আলো । তাই
যেন ভুলে গেছিল এত দিন । এখন অনেকগুল আলোময় দিন পাবে সে ।আচ্ছা এতগুলো দিন নিয়ে কি
করবে সে ? কি করা যায় ? আড্ডা দেবে । বেড়াবে । ঘুমাবে । গল্পের বই পড়বে । টিভি
দেখবে নাকি স্রেফ নেট সার্ফিং করে দিন কাটাবে ।নাঃ এতগুলো দিন নষ্ট করা যায় না ।
ভাল একটা কিছু করতে হবে ।
বল্টুর বাবা বললেন – এটা অমূল্য সময় । হেলাফেলা করে নষ্ট কোরো না । বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে তো কিছুই জান না । বাংলা সাহিত্য পড় । তোমাদের ঐ ইংরাজী মিডিয়ামের বিদ্যায় তো শরৎচন্দ্র , বঙ্কিমচন্দ্র পড়তে পারবে না । গল্পগুচ্ছ দিয়েই শুরু কর । ইচ্ছা করলে রামায়ণ মহাভারতটা ও পড়ে ফেলতে পার । বল্টু সতৃষ্ণ নয়নে তাকের রাখা মোটা গল্পগুচ্ছের দিকে তাকাল । ঐ মোটা বই পড়তে তো পুরো ছুটিই শেষ হয়ে যাবে । বাবা আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন ‘ম্যাট্রিকের পর আমিও সব ক্লাসিক বইগুল পড়ে ফেলেছিলাম’ ।
পাশের বাড়ির কাকু । সেদিন বাজারে যাবার পথে বল্টুকে একা পেয়ে ধরলেন । বললেন ‘ বল্টু হাতে তোমার অগাধ সময় । পরীক্ষা পরীক্ষা করে তো চেহারাটার বারোটা বাজিয়েছ । এবার একটু স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও । একটা ভাল জিমে ভর্তি হয়ে যাও । আজকাল তো সব কিছুরই প্যাকেজ । দেখেশুনে একটা ভাল প্যাকেজ নিয়ে নাও ।এই কয়েক মাসেই বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে যাবে । টাকা পয়সা নিয়ে বেশী মাথা ঘামিও না’ ।
বল্টু শুনেছে এককালে নাকি কাকু বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন । সকালে ভিজা ছোলা আর গুড় খেয়ে মুগুর ভাজতেন । কিন্তু এখনকার এই প্যাকাঠি মার্কা কাকুকে দেখে সেটা বিশ্বাস করা খুব মুশকিল । সবই নাকি পেটের দোষে ।
হঠাত সেদিন পিসতুতো দাদা বাবলাদা এসে উপস্থিত । এসেই বললে ‘কি রে বল্টু । খেয়ে আর ঘুমিয়ে মোটা হচ্ছিস । তোরা হলি দেশের ভবিষ্যত । এভাবে সময় নষ্ট করছিস । কাল আমার সাথে পার্টি অফিসে যাবি । ওখান থেকে প্রতিবাদী মিছিল বেরবে তাতে যোগ দিবি’ ।
বল্টূর মাথা গেল ঘুরে । সে মলিন মুখে বললো –‘এই গরমে কাঠফাটা রোদে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল’ । শুনে বাবলাদা বললো - ‘আমরা করছি না । অলসতাই জীবনের সেরা শত্রু । বুঝলি । পৃথিবীতে করবার কাজের কোন শেষ নেই । যত পার কাজ কর’ ।
কথাটা বেশ ভাল লাগলো বল্টুর । বেশ মহান-মহান । যেন বিবেকানন্দের বাণী শোনাচ্ছে । বাবলাদার কথাই সে শুনবে ।
প্রথমে কয়েকদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে । সিনেমা দেখবে ।তারপর বাবলাদার সাথে লেগে পড়বে দেশের কাজে ।বাবা ,পাশের বাড়ির কাকু যে যা বলেছে সব করবে । এসবের ফাঁকে ফাঁকে নেট সার্ফিং , ফেসবুক এসব ও করবে ।আর বিকালে ফুটবল প্রেকটিস ও চালিয়ে যাবে ।
ওদিকে বল্টুর মা ঠিক করেছেন তাকে মামারবাড়ি পাঠাবে । শহরে থাকার দরুন আত্মীয়-পরিজন কাউকেই তো ভাল চেনে না । কদিন ওখানে থেকে সবার সাথে মেলামেশা করলে । সবাইকে জানবে চিনবে । বাড়ির গরুর দুধ, ঘি খেয়ে শরীরটা ও ভাল হবে । কিন্তু বল্টুর দুর্ভাগ্য । সেদিন মামা ফোন করে বললেন । তাদের বাসন মাজার ঝি নেই । রান্নার লোক ও পালিয়েছে । মামীর হাঁটু ব্যথা বেড়েছে । বাড়ির পাম্প খারাপ হয়ে গেছে । পুকুর থেকে জল এনে সব কাজ করতে হচ্ছে । এসব অসুবিধা সহ্য করে যদি বল্টু থাকতে পারে তবে আসুক ।
শুনে একগাল হেসে বাবা বললেন – তোর মা তোকে মামারবাড়ি পাঠাচ্ছিল । এই গরমে কেউ গ্রামে যায় । ওখানে তো কখনও কখনও কারেন্ট থাকে । তুই একদম আলু সিদ্ধ হয়ে যেতিস । মাঝখান থেকে তোর গল্পগুচ্ছটাই শেষ হত না ।
বল্টুর বুকের ভিতরটা ধড়াস করে ওঠে । গল্পগুচ্ছ শুরুই সে করল কবে ? না এখনও অনেক সময় আছে । কালই শুরু করবে । সেই শুরু কি আর হল ?
হঠাত সেদিন খেলার মাঠে নিখিল বললো – সামনের সপ্তাহে রেজাল্ট বেরচ্ছে ।
বল্টুর মনে হল কে যেন বুকে হাতুড়ির ঘা মারলো । পরীক্ষা যদিও ভাল হয়েছে । তবুও কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো । যদি খাতা হারিয়ে যায় । রোল নম্বরে যদি কিছু গড়বর হয় ।এগজামিনারের মুড যদি ভাল না থাকে খাতা দেখার সময় । হাজার আতঙ্ক এসে জড় হতে লাগলো তার মনে । ভাল পরীক্ষা দিয়েছি বলে যে সাহসটা ছিল এতদিন । সেটা কোথায় হারিয়ে যেতে লাগলো ।
এরমধ্যে বাবলাদা এসে বললো ‘খুব তো দেশের কাজ করলি । তোদের দিয়ে কিসসু হবে না’ । বল্টুর কান্না পেয়ে গেল । কোন কিছুই তো ঠিক করে করা হল না । অর্দ্ধেক
কাজ তো শুরুই করতে পারলো না । যেগুলো শুরু হল তারাও তো মাঝ পথে । ছুটি তো শেষ । কি
করলো সে এত বড় ছুটিটা ? এর হিসাব কে করবে ? এ বড় কঠিন অঙ্ক উত্তর কিছুতেই মিলতে চায় না ।