গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০১৪

স্তুতি বিশ্বাস

ছুটির হিসাব


প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে বল্টু স্কুলের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল আজ নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে । গত কয়েকমাস  যা ধকল গেল । কোথা দিয়ে যে দিনরাত গেছে সে টেরই পায় নি বাংলা ,ইংরাজী, অঙ্ক , ইতিহাস , ভূগোল সব একদম গুলে খেয়েছে । চারিদিকে বইখাতার পাহাড়  তার মাঝে  ঘার গুজে কখনও অঙ্ক করেছে । কখনও ইতিহাসের  সন তারিখ মুখস্থ করেছে । কখনও ভূগোলের  ম্যাপ এঁকেছে । তার ওপর ছিল বাবার কড়া নজর । একটু উঠলেই তার হুঙ্কার – কোথায় যাচ্ছ ? মা , তিনিও কম যান না । সকালের ঘুম বল্টুর খুব প্রিয় । তা কি একটু রেহাই আছে । কাকভোরে মা ঠিক ডেকে তুলতেন বল্টুকে । সকালটা যে কি বাজে লাগতো সে বলার নয় ।  মাঝে মাঝে সে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতো । কতকিছু আবিস্কার হয় রোজ । এমন ওষুধ কেন  বের হয় না । যা  এক চামচ খেলেই । সেই মোঘল আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত । ইতিহাসের সব সন তারিখ ঝরঝরে মুখস্থ হয়ে যাবে । বা একটা ক্যাপসুল গিলে ফেললেই  মাথাটা এমন খুলে যাবে যে পাটিগণিত ,বীজগণিতের সব অঙ্কের উত্তর মিলে যাবে সটাসট । আর যদি হাতে এমন ক্রিম লাগিয়ে নেওয়া যায়  ।যাতে ভারতের ম্যাপটা পরোঠা না হয়ে ভারতের ম্যাপই হবে । এসব ভাবাই সার ।কিছুই হয় নি । বল্টুকে সেই  রাত জেগে পড়া মুখস্থ করতে হয়েছে ।পাতার পর পাতা  উত্তর না মেলা অঙ্ক কষতে হয়েছে । আজ সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নময়  দিনগুলি  থেকে মুক্তি। বোর্ড পরীক্ষা শেষ । এখন অখণ্ড অবসর । যদিও অঙ্কটা নিয়ে একটু কিন্তু কিন্তু আছে । বল্টু সেটা ঠেলে সরিয়ে ফেললো মাথা থেকে ।   
         সকালের ঘুম বল্টুর খুব প্রিয় । ইসসস......। কতদিন সে ভাল করে ঘুমায় নি । আজ বাড়ি গিয়েই লম্বা ঘুম দেবে । উঠবে তিনদিন পরে । সবাইকে বলে দেবে তাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না  করে ।
     গেটের বাইরে আসতেই নিখিলের সাথে দেখা । নিখিল বল্টুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ।   
 সে বললো -  নাইট শোয়ে সিনেমা যাবি ?
 ‘নাইট শোয়ে ? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? বাড়িতে আস্ত রাখবে না’ – আঁতকে উঠে বলে বল্টু । মনে ইচ্ছা থাকলেও সে সাহস দেখাতে পারলো না ।  বললো  না রে আজই পরীক্ষা শেষ হল । আর আজই সিনেমা যাব । বাড়িতে দারুন বকুনি খাব’ । নিখিল কাঁধ ঝাকিয়ে বললো  ‘তুই আর বড় হবি না কোনদিন’ ।

   যদিও বল্টু ভেবেছিল বোর্ডের পর সে সাবালক হয়ে যাবে । কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঠিক সাহসে কুলালো না । পাখির মত হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সে বাড়ি ফিরল ।উঃ কি আরাম । কি স্বস্তি ।চারিদিকে এত আলো । তাই যেন ভুলে গেছিল এত দিন । এখন অনেকগুল আলোময় দিন পাবে সে ।আচ্ছা এতগুলো দিন নিয়ে কি করবে সে ? কি করা যায় ? আড্ডা দেবে । বেড়াবে । ঘুমাবে । গল্পের বই পড়বে । টিভি দেখবে নাকি স্রেফ নেট সার্ফিং করে দিন কাটাবে ।নাঃ এতগুলো দিন নষ্ট করা যায় না । ভাল একটা কিছু করতে হবে ।

      বল্টুর বাবা বললেন – এটা অমূল্য সময় হেলাফেলা করে নষ্ট কোরো না বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে তো কিছুই জান না বাংলা সাহিত্য পড় তোমাদের ইংরাজী মিডিয়ামের বিদ্যায় তো শরৎচন্দ্র , বঙ্কিমচন্দ্র পড়তে পারবে না গল্পগুচ্ছ দিয়েই শুরু কর ইচ্ছা করলে রামায়ণ  মহাভারতটা পড়ে ফেলতে পার বল্টু সতৃষ্ণ নয়নে তাকের রাখা মোটা গল্পগুচ্ছের দিকে তাকাল মোটা বই পড়তে তো পুরো ছুটিই  শেষ হয়ে যাবে বাবা আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন  ‘ম্যাট্রিকের পর আমিও সব ক্লাসিক বইগুল পড়ে ফেলেছিলাম’

        পাশের বাড়ির কাকু সেদিন বাজারে যাবার পথে  বল্টুকে একা পেয়ে ধরলেন বললেন বল্টু হাতে তোমার অগাধ সময় পরীক্ষা পরীক্ষা করে তো চেহারাটার বারোটা বাজিয়েছ এবার একটু স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও একটা ভাল জিমে ভর্তি হয়ে যাও আজকাল তো সব কিছুরই প্যাকেজ দেখেশুনে একটা ভাল প্যাকেজ নিয়ে নাও ।এই কয়েক মাসেই বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে যাবে   টাকা পয়সা নিয়ে বেশী মাথা ঘামিও না’  

    বল্টু শুনেছে এককালে নাকি কাকু বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন সকালে ভিজা ছোলা আর গুড় খেয়ে মুগুর ভাজতেন । কিন্তু এখনকার এই প্যাকাঠি মার্কা কাকুকে দেখে সেটা বিশ্বাস করা খুব মুশকিল সবই নাকি পেটের দোষে

      হঠাত সেদিন পিসতুতো দাদা বাবলাদা এসে উপস্থিত  এসেই বললে  ‘কি রে বল্টু খেয়ে আর ঘুমিয়ে মোটা হচ্ছিস তোরা হলি দেশের ভবিষ্যত এভাবে সময় নষ্ট করছিস কাল আমার সাথে পার্টি অফিসে যাবি ওখান থেকে প্রতিবাদী মিছিল বেরবে তাতে যোগ দিবি’

   বল্টূর মাথা গেল  ঘুরে সে মলিন মুখে বললো ‘এই গরমে কাঠফাটা রোদে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল’ শুনে বাবলাদা বললো  - ‘আমরা করছি না অলসতাই জীবনের সেরা শত্রু বুঝলি পৃথিবীতে করবার কাজের কোন শেষ নেই যত পার কাজ কর’

    কথাটা বেশ ভাল লাগলো বল্টুর বেশ মহান-মহান যেন বিবেকানন্দের বাণী শোনাচ্ছে বাবলাদার কথাই সে শুনবে

     প্রথমে কয়েকদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে সিনেমা দেখবে ।তারপর বাবলাদার সাথে লেগে পড়বে দেশের কাজে ।বাবা ,পাশের বাড়ির কাকু যে যা বলেছে সব করবে এসবের ফাঁকে ফাঁকে নেট সার্ফিং , ফেসবুক এসব করবে ।আর বিকালে ফুটবল প্রেকটিস চালিয়ে যাবে

      ওদিকে বল্টুর  মা  ঠিক  করেছেন  তাকে  মামারবাড়ি  পাঠাবে শহরে থাকার দরুন আত্মীয়-পরিজন কাউকেই তো ভাল চেনে না কদিন ওখানে থেকে সবার সাথে মেলামেশা করলে । সবাইকে জানবে চিনবে বাড়ির গরুর দুধ, ঘি খেয়ে শরীরটা ভাল হবে কিন্তু বল্টুর দুর্ভাগ্য সেদিন মামা ফোন করে বললেন তাদের বাসন মাজার ঝি নেই রান্নার লোক পালিয়েছে মামীর হাঁটু ব্যথা বেড়েছে বাড়ির পাম্প খারাপ হয়ে গেছে । পুকুর থেকে জল এনে সব কাজ করতে হচ্ছে এসব অসুবিধা সহ্য করে  যদি বল্টু থাকতে পারে তবে আসুক

     শুনে  একগাল হেসে বাবা বললেনতোর মা তোকে মামারবাড়ি পাঠাচ্ছিল । এই গরমে কেউ গ্রামে যায় ওখানে তো কখনও কখনও কারেন্ট থাকে তুই একদম আলু সিদ্ধ হয়ে যেতিস মাঝখান থেকে তোর গল্পগুচ্ছটাই শেষ হত না   
                                             
          বল্টুর বুকের ভিতরটা ধড়াস করে ওঠে । গল্পগুচ্ছ শুরুই সে করল কবে ? না এখনও  অনেক সময় আছে কালই শুরু করবে সেই শুরু কি আর হল
   
      হঠাত সেদিন খেলার মাঠে নিখিল বললোসামনের  সপ্তাহে  রেজাল্ট  বেরচ্ছে  

         বল্টুর  মনে  হল  কে  যেন  বুকে  হাতুড়ির  ঘা  মারলো পরীক্ষা  যদিও  ভাল  হয়েছে তবুও  কেমন  ভয় ভয়  করতে  লাগলো    যদি খাতা হারিয়ে যায় রোল নম্বরে যদি কিছু গড়বর হয় ।এগজামিনারের মুড যদি ভাল না থাকে খাতা দেখার সময় হাজার আতঙ্ক এসে জড় হতে লাগলো তার মনে । ভাল পরীক্ষা দিয়েছি বলে যে সাহসটা ছিল এতদিন সেটা কোথায় হারিয়ে যেতে লাগলো

      এরমধ্যে বাবলাদা এসে বললো ‘খুব তো দেশের কাজ করলি      তোদের দিয়ে কিসসু হবে না’ । বল্টুর কান্না পেয়ে গেল কোন কিছুই তো ঠিক করে করা হল না অর্দ্ধেক কাজ তো শুরুই করতে পারলো না । যেগুলো শুরু হল তারাও তো মাঝ পথে ।  ছুটি তো শেষ কি করলো সে এত বড় ছুটিটা ? এর হিসাব  কে করবে ? বড় কঠিন অঙ্ক  উত্তর কিছুতেই মিলতে চায় না