ভুলে
যাওয়া শব্দ
-
স্যার একটা কল এসেছে
-
কে কল করেছে? কোন ফার্ম থেকে? নতুন
কোন ফার্ম হলে বলে দাও আমি অফিসে নেই।
-
না স্যার কোন ফার্ম থেকে নয়।
-
তবে কে?
-
একজন অজ্ঞ্যাত মহিলা কল করেছেন।
তিনি আপনার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছে।
কলম টা হাত থেকে নামিয়ে আমি
মিতুর দিকে তাকালাম,
-
হোয়াট রাবিশ? বৃষ্টি ভিজতে চাইছে মানে কি?
-
জ্বি স্যার সে কল করে বললো।
-
গেট আউট। গেট আউট আই সে!
ইদানিং মেজাজটা কেমন যেনো খিটখিটে হয়ে গেছে। নিজেকে নিজে ঠিক বুঝতে
পারছি না। কাজের চাপ ও বেড়েছে আগের চেয়ে দ্বিগুন। সকালে অফিসে ঢোকার পর থেকে
পৃথিবীর সাথে কানেকশনটা অফ হয়ে যায়। কখন সন্ধ্যা হয় কখন বিকেল হয় তাও জানা হয় না
আমার। মাঝে মাঝে কতোক্ষন অফিসে আছি তাও ভুলে যেতে বসি।
মিতু আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি।ওকে ধমক দেয়ার পর কেমন জানি খারাপ
লাগা কাজ করছে। মিতুকে ইদানিং আমি বেশি বেশি ধমকাই। হয়তো ইদানিং আমি নিজের মধ্যে
নেই। এই আমি আগে মানুষের দশটা ধমক শরবতের মতো গিলে নিতাম অনায়াসে। আর এখন আমি
নিজেই, অন্যকে অনায়াশে রাবিশ বলে ধমকে যাচ্ছি।
কিন্তু কাওকে ধমকানোর পর অনুশোচনা বোধটা আমার প্রচন্ড কাজ করে।
মিতুকে ধমকানোর পর এখন কোন কাজে মন দিতে পারছি না। রোলিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকালাম। পেছনের
পর্দাটা টেনে দিতেই একটা বিশাল কাচেঁর জানালা। এই জানালা দিয়ে পুরো শহরটা চমৎকার
ভাবে দেখা যায়। আমার পিচ্চি নুহাটাকে যেদিন অফিসে নিয়ে আসলাম ও সেদিন এসেই হা করে
বসলো। " বাবা! এতো
বড় টিভি । আমাদের বাসায় কেনো নেই? "
এতোক্ষণ খেয়াল করিনি। সত্যি সত্যি বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। যান্ত্রিক এই
কক্ষে বসে বৃষ্টির সেই মেটে মেটে স্যাতস্যাতে আভাটা এখন আর পাওয়া যায় না।টাকা দিয়ে
অনেক ছাই পাশ কেনা যায়, কিন্তু সেই বৃষ্টির মেটে
মেটে গন্ধ আভাটা কোথাও পাইনি । টিভি পত্রিকায় বড় গলায় নারী আকর্ষনের সুগন্ধির
প্রমোট চোখে লাগে।সেসব সুগন্ধিতে নারীরা আকর্ষিত হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে তাতে
মন যে আকর্ষন হয় না তা ভালো ভাবেই বুঝি। হয়তো প্রকৃতি প্রচন্ড স্বার্থপর। প্রকৃতির মাঝে না থাকলে প্রকৃতি
কাওকে কিছু দিতে চায় না। তাই
ঠিক করলাম আজ আর অফিসে নয়। বেরিয়ে পড়বো।
গাড়ি স্টার্ট করার পর আমি কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেছি। আচ্ছা আমি
কোথায় যাবো
? কে কল করেছিলো অফিসে? কে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছে আমার সাথে? মাথাটা কেমন যেনো হ্যাং হয়ে এসেছে। ভাবতে পারছি না ঠিক।
আমি বোধ হয় যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। কারন যন্ত্র আর মানুষের মধ্যে একটাই
পার্থক্য। মানুষ ভাবতে জানে আর যন্ত্র ভাবতে জানে না। সেদিক থেকে যন্ত্র আর আমার
মাঝে পার্থক্যটা বেশ কম।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে চারপাশে দেখছি । বড় বড় দোকানগুলোর সামনে
মানুষ জটলা বেধে দাড়িয়ে আছে। স্কুল ফেরত বাচ্চাদের মাথা নিয়ে মায়েরা বেশ
চিন্তাশীল। রাস্তায় দাড়িয়ে দাড়িয়েই বাচ্চাদের মাথা ঘষে ঘষে জুতার মতো চকচকে করছে।
ওদিকে বাচ্চাটা বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে নিতে সদা ব্যাস্ত।কোন কোন অতি রক্ষনশীল মা
আবার বাচ্চাদের থাপ্পড় দিয়ে বসছেন । এদিক থেকে গ্রামের বাচ্চাদের বেশি ভাগ্যবান
মনে হয়। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা ওদের কোনদিন অপূর্ণ থাকে না। হয়তো, বৃষ্টিতে ইচ্ছা কোনদিন অপূর্ণ রাখতে নেই। তাতে মন
দেবীটা রাগ করেন।
একটা কফি শপের সামনে গাড়ি পার্ক করে ভেতরেই বসে আছি। বৃষ্টিতে
ভেজার ইচ্ছা থাকলেও যান্ত্রিক টানে কেনো জানি বের হতে পারছি না। হঠাৎ করে একটা
মেয়ে গাড়ির জানালায় এসে টোকা দিলো। জানালা খুলে তার দিকে তালালাম,
-
জ্বি কিছু বলবেন?
-
আপনার কি লিফট চাই?
-
জ্বি মানে?
-
আপনার লিফট চাইলে বলতে পারেন।
-
না না। আমার গাড়ি নষ্ট হয়নি।
-
গাড়ির কথা বলছি না। ছাতার ব্যাপারে
বলছি। আপনি চাইলে আমার ছাতাটা নিতে পারেন।
-
কিন্তু আপনি ?
-
আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছি।
ছাতাটা কেমন জানি বোঝা মনে হচ্ছে। আপনি তাহলে ছাতাটা নিন। আমি যাচ্ছি। ভালো
থাকবেন।
মানুষগুলো খুব অদ্ভুদ হয়ে গেছে। ঠিক ফড়িং এর মতো। হুট করে আসে আবার
কোথায় চলে যায়। আমি তখন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই যান্ত্রিক শহরেও যে কিছু
বৃষ্টি উন্মাদ মেয়ে আছে আমি জানতাম না। বৃষ্টিতে ভিজে ওরা মজা পায় না, বরং ওরা বৃষ্টিই ভালোবাসে।
বাসায় এসেছি তখন রাত দশটা। দুপুর থেকে সারাক্ষন বাইরে ছিলাম। ভিজতে
পারিনি।গাড়ি করে শহরের একটু বাইরে গিয়েছিলাম। মেয়েটার দেয়া ছাতা নিয়ে এখানে ওখানে হেটেছি। বৃষ্টি
দেবতা হয়তো আমার উপর নারাজ। তাই হয়তো তার বৃষ্টির স্পর্শ আমাকে পেতে দিচ্ছেন না।
বাসায় আসতেই কাজের মেয়েটা
আমার সামনে হাজির।
-
সার একটা ঘটনা ঘইটা গেসে
-
কি হয়েছে বলো
-
একটা নাম্বার থেকে কল কইরা আপনারে
খুঁজে!
-
খুঁজতেই পারে
-
না সার। হে আপনার লগে বৃষ্টিতে
ভিজতে চায়।
আমি মেয়েটার দিকে অবাক
ভঙ্গিতে তাকিও রইলাম। পরক্ষণেই নিজেকে ঠিক করে বললাম, যাও এখন।
বৃষ্টি দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দেয়ার আলাদা মজা আছে। সবাই এ মজা
পায় না। যারা সিগারেট খায় তারা বৃষ্টি দেখে দেখে সিগারেট টানতে মজা পান। বারান্দায়
বসে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির শব্দ শুনছি। অনেকদিন পর হয়তো নিজেকে এমন সময় দিতে
পেরেছি। হঠাৎ মোবাইলের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ভাবছিলাম দেখবো না। কিন্তু ম্যাসেজ
ওপেন করতেই দেখলাম একটা অচেনা নাম্বার। মানুষের ভেতরটাই যখন অচেনা তখন কিছু
নাম্বার নাম্বার অচেনা হতে দোষ নেই। ম্যাসেজটা খুলে দেখলাম কবিতার মতো কিছু একটা
লেখা আছে সেখানে,
"
তুই ভুলে যেতে পারিস
তুই ভুলে যেতে পারিস চেনা মাটি চেনা বাতাস, হয়তো কোকিলে ডাকা সকালটাও।
তুই ভুলে যেতে পারিস টপ টপ
বৃষ্টি ধরতে কেমন, কিভাবে বৃষ্টিতে গা এলিয়ে
দিতে হয় পাগলাটে বাতাসে হয়তো
বৃষ্টির মাঝে তুই সুখটাও ধরতে ভুলে গেছিস।
তুই ভুলে যেতে পারিস চেনা
মাটির গন্ধ যেখানে কাদাঁ মাখা করে
আনন্দের বুনোন হতো।
তুই ভুলে যেতে পারিস প্রথম
বৃষ্টি দেখা বৃষ্টি ভালো লাগা,প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা ।
তুই ভুলে যেতে পারিস প্রথম কার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজেছিলি কার হাত ধরে চিৎকার করে বলতি বৃষ্টি ভালোবাসি।
তুই ভুলেই যেতে পারিস, বৃষ্টি-ঝড় দাপটে পৃথিবীটাই ভুলে যায় সে কষ্টে ছিলো ছিলো রবির আঘাতে বিক্ষত হওয়া শেকা বুক।
তুই কি? তুই সেখানে মানুষ। তুই ক্ষুদ্র, তুই
পাপী
তুই পাপ ভুলে যাস। তোর মাঝে আছে ভুলে যাওয়া কীট, তুই ভুলে যেতেই জন্মেছিস তুই ভুলবি, তুই
নিজেকে ভুলবি তুই ভুলবি আকাশের রং আর
বাতাসের চেনা গন্ধ।
আমি জানি তুই সব ভুলবি, হয়তো একদিন তুই ভুলে বসবি মা বলেও একটা শব্দ ছিলো।
ভুলে যাস, সব ভুলে যাস খেয়ে বসে থাক আবেগের কড়া-গন্ডা শুধু সব শেষে অভিনয়ের থালা নিয়ে আসিস না আর। জানিস তোর মা শুধু অভিনয় করতেই জানতো না অভিনেতাকে সে বড়ই ঘৃনা করে । "
মানুষ ভুলে গেলে কোনদিন বাক শূন্য হয় না। হয় ভুলে যাওয়া কিছু জানতে
পেলে ।
আমিও জানেছি। জেনেছি আমিও কিছু
ভুলে গিয়েছিলাম। প্রচন্ড বাক শূন্যতায় ভুগছি এখন। শিরা - ধমনী বাক শূন্যতায় ভুগছে
প্রবল। ওরা এক কদম জায়গা পেরোতে দিচ্ছে না।
" দিনগুলো ভোলা যায়, ভোলা
যায় রাত গুলো কিন্তু অসমাপিকা হয়ে আসা সে
ভুল গুলোকেই কোনদিন ভোলা হয় না।
ওরা ভুল, ওরা ভুলতে আসে কিন্তু ভোলাতে আসেনি মহাকালেও "
মায়ের কথা আমি একদম ভুলে বিসেছিলাম। খবর নেয়া হয় না ঠিক এগারো বছর
প্রায়।অফিসের চাপে ব্যাংকে ব্যাবস্থা করে রেখেছিলাম মা'কে টাকা পাঠানোর। তাই কোনদিন আর মনেই পরেনি মায়ের কথা। এই মায়ের হাত ধরেই আমি বৃষ্টি দেখেছি। ভিজেছি মায়ের
মুখের মিটমিটে হাসি দেখে । মা
বলেছিলো, ভালোবাসলে বৃষ্টিকে ভালোবাসো। সে তোমাকে ভোলাবে হয়তো
মাঝে মাঝে মনে করাবে খুব প্রিয় মানুষটাকে।
আর দেরি না করেই গাড়িতে উঠলাম।আজ মায়ের কাছে যাবো। শহরের গন্ডি
পেরোতেই মাটির গন্ধ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও, যেখানে আমার মা আছে। একলা বসে। যেখানে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মা
বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছে খুব। হয়তো বৃদ্ধ শরীরের মনটা এখনো আছে সেই সতেজ প্রানবন্ত।
"
ভুল করেছি খুব আজ আমি আসছি
আসছি তোর লাঠি হয়ে তুই দেখবি, বৃষ্টি
দেখবি
আর ভাববি আমার ছেলে বেলার কথা যেদিন আমি তোর হাত ধরে বৃষ্টিতে বিজতাম আজ তুই ভিজবি আমার হাত ধরে
আমি আসছি আজ, আসছি তোর লাঠি হয়ে "