গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সালিনা লীজা

পাখিটা আকাশে উড়তে চেয়েছিল

                                             ১

          ছেলেবেলায় ভোর হলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। না, কাঁচা হলুদ রোদ্দুর গায়ে চড়িয়ে দিনটি কেমনে আসে শুধু তা দেখার জন্য নয়; ভোর হলেই আমাদের বাড়ির উপরে যে আকাশটুকু আছে, ঐ আকাশ দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যেত। উড়ে উড়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে একদম নীল দিগন্তের আড়ালে হারিয়ে গেলে মনটা ভারি খারাপ হয়ে যেত; সন্ধ্যায় সবাই ঘরে ফিরলে চারপাশে যখন নীরব হয়ে আসত তখন গুটি গুটি পায়ে আঁধারেরা চারপাশ ঘিরে ধরত আর ঠিক তখনই রূপকথার কোনো এক অন্ধ জাদুকর আকাশের সমস্ত গা ফুটো করে দিত,- আমাদের বাড়ির উপর সেইসব তারকাগুলো আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। যেহেতু আমাদের বাড়ির উপরের আকাশটুকুতে ঐ তারাগুলো ফুটে থাকত, তাই আমি বলতাম এই তারাগুলো আমার! কিন্তু ভোরে আর সন্ধ্যায় ঐ একই আকাশ দিয়ে পাখিগুলো উড়ে গেলেও মনে হত ঐগুলো আমার না। অধরা। বাবা আমার এই দুঃখ বুঝতে পেরে সুন্দর দেখে একটা ময়নাপাখি কিনে দিলেন আমাকে। খাঁচায় পুরে ময়নাটাকে যেদিন বারান্দায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল সেদিন পাখিটাকে আমার সন্তানের মত মনে হতে লাগল। মুখটা খাঁচার কাছে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম- ঠোঁট গলার মালা চিক চিক কালো পাখা আর হলদেটে পা দুটি। খাঁচা থেকে বের হবার জন্য পাখিটি খাঁচার চারপাশে ছটফট করছে আর বারবার আমাকে তাকিয়ে দেখছে! আমি বিজয়ীর গলায় পরম সুখ আর উত্তেজনাকে যথাসম্ভব সংযত রেখে আলতো করে বললামঃ

যা, এখন উড়ে যা, এত পারিস! এতদিন তো আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে উড়ে উড়ে চলে যেতি!...

                                          ২

পাখিটা অচিরেই আমার খুব আপন হয়ে গেল। খাঁচায় সারাদিন বসে বসে পর্যবেক্ষণ করে কে কখন কী করছে। আর সুযোগ পেলেই খাঁচার মাঝে ফাঁক-ফোঁকর খুঁজতে থাকে। মাঝে মাঝে আমার খুব হিংসে হত; আমার কত্ত কাজ করতে হয়- সকালে প্রাইভেট তারপর সোজা স্কুলের দিকে দৌঁড়াও, ফিরে আবার প্রাইভেট রাতে আবার পড়তে বসা- আর কত কী! আর শাহজাদা শুধু বসে বসে খায় আর ঘুমায়।

ও মা! এতো দেখি চমত্‍কার কথা বলতে পারে! ঠিক মানুষের বাচ্চার মতন। সকাল আর বিকেল নাই, খাঁচার পাশ দিয়ে কেউ গেলেই উনি নাকি সুরে বলে ওঠেনঃ

"শুভ সকাল! কই যান?"

প্রতিদিন সকাল বিকেল রাত- তিনবেলা রুটিন করে খাওয়াতাম। স্কুল থেকে ফিরেই চলে আসতাম খাঁচার দিকে। বসে গল্প করতাম অনেক ক্ষণ। বেয়াদপ পাখিটা গল্প শোনা বাদ দিয়ে খালি শিক কামড়াত আর ফাঁক গলে আকাশের দিকে উঁকিঝুকি মারত। খাঁচাটা ঝাঁকি দিয়ে তারপর আদপ শেখাতে হত! মাঝে মাঝে কিন্তু আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনত।

একদিন খুব করে ঝড় ওঠেছে। আমরা ভেতরে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছি। মজা। বাইরে শো শো করে বাতাস আর বৃষ্টি বইছে। আমি আড্ডার মাঝখান থেকে আসতে করে ওঠে আসলাম। যাতে বৃষ্টির ফোঁটা ভেতরে এসে ঘরের ভেতরটা ভিজিয়ে দিতে না পারে সেই জন্য সবকটা জানালা বন্ধ। আমি ধীরে ধীরে কোনো এক জানালার কপাট ধীরে ধীরে খুলে কপাট দুটির মাঝে মাথা সেধিয়ে দিলাম যাতে ভেতরে আলো খুব একটা যেতে না পারে। বৃষ্টির কনাগুলো সিটকে এসে আমার সারা মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কী ঠান্ডা! সারা শরীর শিরশিরিয়ে ওঠল। একটু দূরে একটা কদম কাছের সবকটা পাতা ভিজে একসা, গা বেয়ে বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটা শালিক নিচু এক মগডালে একটার সাথে একটা গা সেধিয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। কী ভালোবাসা! মাঝখানের দুটো মনে হয়ে ওদের বাচ্চা। মা পাখিটি মাঝে মাঝেই ঠোঁট দিয়ে ওদের শরীর আচঁড়িয়ে দিচ্ছে। নিচে একটা অন্ধকার মতো ঝোঁপের মাঝখান থেকে হঠাত্‍ করে একটা টুনটুনি বের আসল। ঝোঁপটার মাঝে সবচেয়ে যে বড় গাছ আছে তার চিকন একটা ডালে বসে আঁতিপাতি করে কী যেন খুঁজছে। একটা ফড়িং ঠোঁটের ফাঁকে সেধিয়েই আবার ফুরুত্‍ করে ঝোঁপটার মাঝে হারিয়ে গেল। পাথিরা কী সুন্দর স্বাধীন! দুইটা ডানা আছে, যেখানে খুশি যখন ইচ্ছে উড়ে উড়ে যেতে পারে। আল্লায় কেন যে মানুষের দুইটা ডানা দিল না!

এই যা! আমার ময়নাটিকে তো আজ খাওয়ানোই হয় নাই! বেচারা সেই কাল থেকে উপোস।বাইরে এখনো বাতাস আর বৃষ্টি। বাতাসে খাঁচাটা দুলছে। ময়নাটিও ভিজে গেছে। বের হবার জন্য খাঁচার চারপাশে ফাঁক খুঁজছে। খিদেয় নাকি ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টির জন্য জানি না- খাঁচার শিকের উপর বসে থাকা পা দুটি তিরতির করে কাঁপছে! আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। ঠান্ডা বাতাসে মুহূর্তে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠল আমার। এতক্ষণ তাহলে বেচারি কেমনে ছিল এখানে? কাছে যেতেই দুর্বল দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকাল। ঘোলাটে দুটি চোখ। আগে শরীরে চিকচিকে একটা ভাব ছিল- আজ কেমন যেন মলিন মলিন লাগছে।

রাগ করেছিস আমার উপর ? হাঁ রে ? কথা বলছিস না কেন? খুব খিদে লাগছে? বল ? আমার ঠিক মনেই ছিল না, সত্যি বিশ্বাস কর! এমনটি আর হবে না। দেখিস!
                                                                 
                                               ৩

বাড়িতে কী যেন একটা কাজে দুই দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। পাখিটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়তেই আঁতকে ওঠলাম। না খেতে পেরে বেচারি বোধহয় অনেক কাবু হয়ে গেছে। রাগ করে হয়ত আমার সাথে কথাই বলবে না। তা কেন করবে না রাগটা? একটু যদি খেয়াল থাকত! ধ্যাত্‍! এরপর থেকে আমি যদি আর অবহেলা করছি তবে...
 'রানু দেখতো ময়নাটা কী বলে?'

ময়না আর কথা বলে না কেন?আর নড়ে না কেন?আমার দিকে আর তাকায় না কেন ? লোমগুলো অমন ধুসর কেন?আকাশে উড়ে যাবার জন্য আর ছটফট করছে না কেন ? উড়ে উড়ে দূর থেকে দূরে দিগন্তের নীলে আর হারিয়ে যাবে না।

অতলান্তিকের মহাশুন্যতায় ডুবে গেলাম। যেন আমার মাঝে আমি নেই।... প্রিয়জন মারা গেলে কবর দিতে হয়। না হলে গুনাহ হয়। আমরা ভাইবোনেরা মিলে পাখিটিকে কবর দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়ি থেকে একটু দূরে কবর খোড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

এইখানে আমবাগান। ঘন পাতায় ঢেকে আছে আকাশ। ঝড়ে ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টিতে ভিজবে না আমার পাখিটা। ঘাসগুলোও কী সবুজ! একটা পিঁপড়েও তো দেখছি না এখানে! মরে গেলে কবর দেবার পর শরীর নাকি পিঁপড়ে খায়? মা বলছে। এইখানে পিঁপড়ে নাই, খেতে পারবে না। মাথার উপর সবুজ ঘাস তার উপর জোড়ায় জোড়ায় ঘন আমপাতা তারও উপরে নীল আকাশ- তাদের একদম নিচে আমার পাখিটা।
 -'আমি আগে মাটি দিমু!'-'তুই পরে দিবি, বড় মানুষের আগে মাটি দিতে হয়!'-'ওর মাটি দেওয়া যাবে না। ও মেয়ে মানুষ। পাখির আত্মায় কষ্ট পাবো।'
 থাক, আমি নাহয় পরেই মাটি দেই। তবু, তুই শান্তি পাস... আর আর আমাকে মনে রাখিস...