শূণ্যতার
দাহজ্বালা
কার্তিক
মাসের শেষ দিকের কোন একটা সময় । হালকা কুয়াশারা চারদিক ঢেকে আস্তে আস্তে এগুচ্ছে
হাত নাগালের মধ্যে । ঘাসের ডগায়
শিশির কণা জেঁকে বসতে আর বেশি দেরি নেই গোছের নিস্তেজ হয়ে আসা প্রায় সন্ধ্যালগ্ন ।
কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে মুল গেটের উল্টো দিকে পচা কাকার দোকানে হালকা চাদর মোড়া
দিয়ে বসে চায়ের অপেক্ষায় আমি । গোধূলির ম্লান আলোকছটার রেশ
এক মায়াবি আবহ তৈরি করে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, ঠিক ঐ রকমএকটা পরিবেশে
আমাদের দিপেন যাকে অনেক সময় মদনা বলে ডাকি, দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথম তার
আসার খবরটা জানায় ।
“দাদা,
বলেছিলাম না তোমাকে একটা মেয়ে আসার কথা ছিলো ? ঐ যে রিকশা করে আসছে ওরা ।”
ঠিক তখনই
পরপর দু’টি রিকশা থামে কলেজ গেটে । প্রথমটা থেকে দুই জন মেয়ে নেমে গেটের গা ঘেঁষে
দাঁড়ায় । দ্বিতীয়
রিক্সা থেকে নামা মাঝ বয়সি দুই জন পুরুষ ইতস্তত এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজে ।
“দাদা, চল
তো একটু, ওদের সাথে কথা বলে আসি ?”
গায়ে
পড়ে পরিচিত হতে যাওয়াটা আমার কাছে বরাবরই হ্যাংলামো মনে হয় । দিপেনকে বলি, তুই পরিচিত হ
গিয়ে, আমি যাচ্ছি না । কিন্তু দিপেনটাব রাবরের নাছোড় বান্দা, একরকম জোর করে আমাকে
নিয়ে যায় গেটের কাছে । কাছে যেতেই তার এতটা আগ্রহ নিয়ে দেখা
করার কারণটাও স্পষ্ট হয় । মেয়েদের সাথে আসা অভিভাবক
দুইজন দিপেনের মায়েরপূর্ব পরিচিত এবং দু’একবার দিপেনের সাথে দেখাও
হয়েছে দেশে । এখানে আসার আগে দিপেনের মাধ্যমেই সব খবরাখবর
নিয়েছে ওরা । দিপেনের সাথে নানা কথায় ভদ্রলোকদ্বয় বেশ
জমে যায় দেখে আমি একটু তফাতে দূরত্ব রেখে দাঁড়াই । আরসন্ধ্যা
হয়ে আসা পাটভাঙা সূর্যের আলোয় শুধু দেখি তন্ময় হয়ে । টোলপড়া শ্যামলা গালে কিভাবে শেষ
বিকেলের আলোরা নাচে অবলীলায় । কি অনায়াসেই না পরশ বোলায়
নাকে-ঠোঁটে-চিবুকে-বুকে আর কণ্ঠার হাড় জুড়ে । এক্ষণে
যদি শেষ বিকেলের এই কুসুম কুসুম মোলায়েম রোদ হতে
পারতাম টাইপের একটা অজানা শিহরিত দুঃখ মোচড় দিয়ে উঠে
ভেতরে । সম্বিত ফিরে পাই দিপেনের ডাকে ।
“দাদা,
এদিকে একটু এসো তো ?” এগিয়ে যেতেই পরিচয় করিয়ে দেয় সবার সাথে । দু’একটা কথাবলে
সেদিনের মত ওরা চলে যায় কোলকাতায় । মেয়েটির নাম জানা হয় না আমার । আর
আশ্চর্যের বিষয়,নাম জানার ইচ্ছেও অনুভব করি না নিজের ভেতর থেকে । দিপেনেতো
আছেই এরকম একটা বোধ হয়তো কাজ করছিলো মাথায় । পরে
অবশ্য দিপেনের মুখেই শুনেছি
অন্য একটা কলেজে এডমিশন নিয়েছে কেতকী।
প্রথম
দেখাতে এতটা গভীরভাবে হৃদয়ে গেঁথে যায় তার চাহনি, তার
কথা বলার ঢং, পরে অনেকবার স্বপ্নে দেখেছি কেতকীকে। দেখা থেকেইস্বপ্নে
হাত
ধরাধরি করে হেঁটেছি পর্যন্ত সোনাইয়ের তীরে । সোনাই আমার
ছেলেবেলাকার জলকেলির নদী । শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ বিরাজে সারা বছর আর ভরা বর্ষায়
পোয়াতি মায়ের পেটের মত ফুলে উঠা মায়াবী সৌন্দর্য ছড়ায় । সেই
সৌন্দর্য দেখতে দেখতে শিশুকালে যেভাবে ছুটেছি সোনাইয়ের পাড়ে, ঠিক ওইরকম রূপছটা দেখতে
দেখতে জেগে উঠেছি অনেক বার কেতকীতে আচ্ছন্ন স্বপ্ন ভেঙ্গে । বছর-দু’বছর
গড়িয়ে সেই স্বপ্নও যখন একদিন ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছিলো বিস্মৃতির পটে, ঠিক
তখনইমিলিয়ে যেতে যেতেও আবার জেগে উঠেছিলো একেবারে শেষ
হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ।
প্রথম
দেখার বছর আড়াই পরের ঘটনা । কিছুদিন ধরে দিপেন টিউশনি পড়তে যাচ্ছে এক স্যারের কাছে
সোদপুরের দিকে। প্রতিদিন সকালে
উঠে সাতটার আগে বেরিয়ে যায় । দু’ঘণ্টা
টিউশনি পড়ে এগারটা নাগাদ বাসায় ফিরে আসে । দিপেন বেরিয়ে
গেলে আমাকে উঠে দরজাটা লক করে দিতে হয়, এ আরেক উপদ্রব এই
সাত সকালে । কাঁচা ঘুম ভেঙে কি যে বিরক্তি নিয়ে কাজটা
করি ! তেমনি কোন এক সকালে দিপেনের ফোনে দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙ্গে ।
“হ্যালো
দাদা, কেতকীকে দেখতে পেলাম এখানে । আমি যে স্যারের কাছে টিউশনি পড়ি সেও একই
স্যারের কাছে আসে । আমার পরের ব্যাচে
।”
“তাই নাকি
? বেশ তো ?”
“ফোন
নাম্বারটা নিয়ে আসবো নাকি ?”
“পারবি ?
নিয়ে আয় তো দেখি ?”
বলাটা
আমার হেঁয়ালির ছলে । কারণ আমি
জানি আর যাই হোক অন্তত এ কাজ হবে না দিপেনেকে দিয়ে । মেয়েটিকে
দেখার পরথেকেই সত্যি সত্যি তার প্রতি একটা ঘোর আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল আমার
। ঠিক
প্রেম বলতে যা বোঝায় তা নয়,
আবার এ যে প্রেম না এও
কি বলা যায় ? তবে
সব কিছু ছাপিয়ে একে হৃদশিহরণ বলে চালিয়ে দেয়া যায় অনায়াসে
। বন্ধুদের কাউকেই সেকথাবলি
নি এমনকি আমার সব সময়ের সঙ্গী দিপেনকেও না । কিন্তু দিপেন
কি আগেই টের পেয়েছিলো ? নয়তো ফোন নাম্বার নিয়ে আসার বিষয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করবে কেন
? ওর টের পাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাই না । এদিকে লাভের মধ্যে একটা লাভ, সেই পুরনো
আকর্ষণ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । সাত
সকালে আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয় কেতকী । তখনো আমি বিছানা ছেড়ে নামিনি কেতকীকে ভেবেই
চলেছি, এর মাঝেই দিপেন ফিরে আসে ।
“দাদা, এই
ধর তোমার নাম্বার ।”
“আমার
নাম্বার মানে ? তুই কি সত্যি সত্যি নাম্বার নিয়ে
আসলি ?”
“হ্যাঁ,
তোমার কি মনে হয়েছিলো, আনতে পারবো না ? এটা এমন কি কঠিন কাজ !” নিজেই আমার মোবাইলটা
নিয়ে নাম্বারটা সেইভ করে দেয় ।
পরবর্তীতে
মোবাইল হাতে নিয়ে কন্টাক্ট নাম্বারগুলো ঘাটতে গিয়ে
যখনই কেতকী নামটা চোখে পড়েছে কেমন যেন আঁতকে উঠেছি । তখনই
মনের মাঝে কেতকী কেতকী ভাবটা পোক্ত করার একটা সুপ্ত বাসনা মাথাচারা দিয়েছে, দমিয়ে
রেখেছি ।
সেবারই
দশ দিনের টুরে বেরিয়েছিলাম আমরা পাঁচ জন । কল্যাণী-দার্জিলিং-গ্যাংটক-জলদাপাড়া
হয়ে আবার কল্যাণী । ফেরারপথে আলীপুরদুয়ারে বন্ধু তাতাইয়ের
মামাবাড়িতে যাত্রাবিরতি । প্ল্যান
ছিল একদিন থাকবো কিন্তু মামাবাড়ি বলে কথা ! এক
দিনের জায়গায় দুইদিন কাটিয়ে তারপর শিলিগুড়ি হয়ে কল্যাণী ফিরলাম । ঘুরতে
যাওয়ার কিছুদিন আগে শুরু হওয়া রীতা আর
অরিত্রের প্রেমটা সবে জমাট বেঁধেছে সাঙ্গুলেকের বরফের মত । এরই মাঝে এই এক
সপ্তাহের বিরহ । অরিত্র মানলেও রীতা
মেনে নেবে কোন দুঃখে,অবশ্যমানতে পারে নি বলেই আমাদেরকে জ্বালিয়েছে মনের আক্রোশে,
যখন তখন । সদ্যগড়ে উঠা কাঁচা প্রেম
বাঁচিয়ে রাখতে একজন আরেকজনকে মেসেজ দিয়েছে অনবরত, ফোনে কথা বলছে ঘন ঘন । হেন কোন
ন্যাকামি নেই যা তারা করেনি । কোন কারণে অরিত্রকে মোবাইলে না পেলেই
ব্যস, শুরু হয়ে গেলো আমাদের কারো না কারো মোবাইলে একের পর এক ফোন
কিংবা মেসেজ । এই হাড় ফুটোকরা উৎপাতে স্বভাবতই একসময় আমরা অতিষ্ঠ হয়ে বন্ধ করে
দিলাম মোবাইল সেট একেবারে । হস্তগত করা হল অরিত্রের মোবাইলও । অবশ্য ফিরে আসার পর
প্রেমটা টেকাতে অনেক ধকল সামলাতে হয়েছিলো আমাদের । প্রেমিক
হিসেবে অরিত্রের যথেষ্ট নাম ডাক আছে সার্কেলে । প্রেমে যে প্রজ্ঞা, সংযম আর দেমাগি
প্রেমিকাদের পিছু পিছু ঘুরে লজ্জার শেষপর্দাটা খসিয়ে ফেলতে হয়, তার শতভাগ আছে
অরিত্রের মাঝে । ভেবেছিলাম কেতকি কাহিনীটা ওকে বলবো, কিন্তু রীতার
হাতে প্রতিনিয়ত নাকানি চুবানি খাওয়া দেখে মায়া হল । বলিনি
শেষে ।
দুই দিন
দার্জিলিং-এ কাটিয়ে গ্যাংটক যাচ্ছি পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথ ধরে । টাটাসুমোর পেছনের
সিটে আমি আর দিপেন । হঠাৎ করেই দিপেন বলল,
“দাদা,
আজকে কিন্তু কেতকীর জন্মদিন ।”
“তাই নাকি
? তুই জানলি কি করে রে মদনা ?”
“গেল মাসে
বলেছিলো আমাকে । দাও
তো তোমার মোবাইলটা, বার্থডে উইশ করে একটা
মেসেজ পাঠিয়ে দেই।”
“আমার মোবাইল
থেকে কেন ? তোরটা থেকে পাঠিয়ে দে না যত খুশি!”
শেষ
পর্যন্ত যে আমার মোবাইল থেকেই পাঠিয়েছিল মেসেজটা তা
টের পেয়েছিলাম পরের সপ্তাহে । পরে এও জেনেছি প্রতিদিন সকালে একটা করে মেসেজ
পাঠিয়েছে নিয়মিত আমার নাম করে । গ্যাংটকে তিন দিন থেকে জলদাপাড়া ফরেস্টে একদিন
কাটালাম আমরা । ফরেস্টের বাংলোয় তিনটি রুম
আমাদের নামে বুকিং দেয়া ছিলো । ওখান থেকে আলীপুরদুয়ার
পৌঁছলাম এক ভোরে । আগেই আমাদের
পছন্দের খাবার তালিকা পৌঁছে গিয়েছিল তাতাই মারফত । সেই
সাথে দুই মামি তাদের পছন্দসই খাবার বানিয়ে রেখেছেন আমাদের জন্য । দীর্ঘ এক সপ্তাহ
ঘুরাঘুরির ধকল শেষে মামাবাড়িতে পৌঁছে কোথায় যেন
হাওয়া হয়ে গেল ক্লান্তি সব আর অবসন্নতা । শুধু
খাওয়া, ঘুম আর ভরপুর আড্ডা ।
কল্যাণী
পৌঁছেই যে আমাকে এমন একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি
হতে হবে ভাবতেও পারিনি । যেদিন কল্যাণী ফিরে আসি সেদিন
সারা সকাল-দুপুর-বিকেল ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই । রাতে একটা অচেনা
ল্যান্ড নাম্বার থেকে ফোন আসে । পরপর তিন
বারের মাথায় রিসিভ করি ।
“হ্যালো,
কে বলছেন ?”
“আপনার এই
নাম্বার থেকে আমাকে প্রতিদিন সকালে একটা করে মেসেজ পাঠানো হয় । এরপর আর যদি কোন
মেসেজ আসে তাহলে কিন্তু আমি থানায় রিপোর্ট করবো, বলে
দিচ্ছি ।” আচমকা ফোনটা রেখে দেয় ।
কথাটা শোনার
পর একেবারে থ’ হয়ে যাই । একে তো আমি
কোন অপরিচিত নাম্বারে মেসেজ পাঠাই না, তার উপর একটা অচেনা মেয়ে মুখের উপর কিছু কথা শুনিয়ে
দিলো, একেবারেই অনাহুত আমার কাছে । মোবাইলের
মেসেজ অপশনের সেন্ট বক্সে গিয়ে দেখলাম কেতকীর নাম্বারে গোটা দশ মেসেজ পাঠানো হয়েছে
প্রতিদিন সকালে । এটা যে দিপেনের কাজ বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না । তার মানে, এই
মেয়েটা নিশ্চয়ই কেতকী হবে ! ব্যাপারটা যে উদ্দেশ্য
প্রণোদিত নয় কিংবা আমার দ্বারা
সঙ্ঘটিত হয় নি সেটা খোলাসা করার জন্য কেতকীর নাম্বারে এই প্রথমবারের মত কল দিলাম ।
“হ্যালো,
আপনি আবার আমার নাম্বারে ফোন দিয়েছেন কোন সাহসে ?”
“হা, না
মানে আমার কথাটা শুনুন প্লিজ । আমি আপনাকে মেসেজ টেসেজকিছু পাঠাই নি । অন্য কেউ
হয়তো আমার নাম্বার থেকে মেসেজ দিয়েছে । সে জন্য আমি দুঃখিত
।”
“আপনার
মোবাইল থেকে অন্য কে মেসেজ পাঠাবে শুনি ? মেয়ে পটানোর এসব কায়দা বেশ পুরনো, হে!
প্রথমে মেসেজ তারপর কথা বলার চেষ্টা, যত্তসব । আবার ফোন
দিলে আমি সত্যি সত্যি পুলিশে জানাবো ।”
রেখে দেই
ফোন । পুলিশে জানাবে সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা
ব্যথা নেই । বঙ্গের পুলিশদেরঅনেক ব্যস্ততা । তাদের খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই এই ধরনের
ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করবে না । এখানে অবশ্য
কেতকী বেচারিকে দোষ যায় না । জগতের সব নারীই বলবে এটা পুরুষের নারী পটানো কৌশল । কিংবা
যতই একজন অপরিচিত পুরুষ বলুক এটা তার কাজ নয় কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না কোনদিন । আমি যদি
বলতাম এটা আমার মোবাইলই নয় তবে কি আমি বেঁচে যেতাম তার আক্রোশ
থেকে ? তারপরও যদি কিছু কথা শুনিয়ে দিতো, পরোক্ষভাবে
কি এই আক্রোশ আমার উপরই পড়তোনা ? মিথ্যের আড়ালে প্রকৃত সত্যটা সব সময়ই কি উকি দিত
না আমার মনে ? যাই হোক, দিপেনকে এই ঘটনার কিছুই না
জানিয়ে, দিব্যি চেপে যাই । এদিকে
দিপেন যে আমার অগোচরে প্রতিদিন একটা করে মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে, আমি বুঝেও সম্পূর্ণ না
বুঝার ভান করি । নাহ, আর কোন
ফিরতি থ্রেট আসে নি, উপরন্তু এই মেসেজগুলোই পরে একদিন সাপে বর হয়ে
দেখা দেয় ।
ছাত্র
জীবনের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরেছি তাও বছর দশেক হয়ে
গেলো । সময়
গড়াচ্ছে আপন নিয়মে । কেতকীর সাথে মান-অভিমান পর্বের সমাপ্তি হয়েছে,
কখনো চোখের জলে আবার কখনো না বলা কথার মধ্য দিয়ে । জীবন পাঠের চড়াই উতরাই পেরিয়ে
আজ যার যার অবস্থানে রয়েছি একরকম আত্মতুষ্টি নিয়েই । দিপেনটা
এখনো ছায়ার মত আমার সাথে সাথে থাকছে । চাকুরি করছে, নিজের সংসার হয়েছে কিন্তু
প্রতিদিন একবার হলেও আমার সাথে তার দেখা করা চাই । শুনেছিলাম কেতকী তার বাবার
পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করেছে শেষে । এই শোনা
পর্যন্তই, খোঁজ নেয়া হয় নি আর ।
আগামী কাল দিপেনের
ছেলের জন্মদিন । কিছু একটা উপহার কিনবো বলে বসুন্ধরায় যাব এই
ভেবে বাসা থেকে বের হলাম । বাসা
বলতে সেই কলাবাগ কোয়ার্টারের একশ তেত্রিশ নম্বর বিল্ডিঙ-এর তিনতলা, একজোড়া
বুড়োবুড়ির সাথে সাবলেট । প্রায় শ্রীহীন গোলাপি রঙের বাসাটায় আছিআজ সাড়ে সাত বছর । বাসা থেকে
বেরিয়ে গ্রীন রোড ধরে দিপেন আর আমি হেঁটে হেঁটে
এগুচ্ছি । পান্থপথ সিগন্যালে আসতেই দিপেন আমাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিল ।
“দাদা,
কেতকী’দি না ? দেখ তো ভালো করে ?”
দেখলাম
একজন মহিলা বছর ছয়েকের ফুটফুটে ছোট্ট একটি মেয়ের হাত
ধরে এগিয়ে আসছে । আশ্চর্য, কেতকীই তো ! কিন্তু এখানে কি করছে ? ওর না বিয়ে হয়েছিলো
ওপারে ? আসাম না কোলকাতায় ?
ততক্ষণে
দিপেন এগিয়ে গিয়ে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে । কথার ফাঁকেআমার দিকে দু’একবার আড়চোখে
তাকালো কেতকী । তাকানো চোখে রাগ-অভিমান নাকি হিংস্রতা টের পেলাম না দূর
থেকে । তফাতেই
দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ, এগিয়ে যাবার তাড়না অনুভব করলাম না । শুধু সৌজন্য বশত হাত
নেড়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম । আদৌ কি আমার সৌজন্য দেখানোর দরকার ছিলো ? কেতকীও
তো মাথা নেড়ে সায় দিলো । হয়তো ওটাও শ্রেফ সৌজন্য । কেতকীর পায়ের
কাছে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে বিস্ময় অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে ফুটফুটে বছর ছ’য়েকের
ছোট্ট মেয়েটা কখন যে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, বেমালুম টের পাই নি ।
আর আমি
সোডিয়াম আলোর সাথে সিগন্যালের সবুজ আলোর মাখামাখিতে দেখছি টোল পরা শ্যামবর্ণের গাল,
কোমল ঠোঁট আর ছোট্ট চিবুকে এক ঝাঁক আলোছায়ারা খেলা করছে । অজান্তে হাতটা বাড়িয়ে
দেই মেয়েটির দিকে । কি নিশ্চিন্তেই না আমার আঙ্গুলগুলো ছোট্ট হাতের সাথে মিশে যায়
একাকার হয়ে, শিহরিত হই । হঠাৎ কেতকীর দিকে চোখ পরে যায় । তারচাহনি যেন আজ অনেক
কিছু বলে দিতে চাইছে শূন্যে
ভাসিয়ে ।
তার
পাথর দৃষ্টিতে দেখছি বুক ভেদকরা নীলকষ্টের তীব্রতা । আমার গোটা সত্ত্বা
জুড়ে ছেয়ে যাওয়া এই তীব্রতা থেকে
আমি পালিয়ে উদ্ধার পেতে চাই ।
এখন ই ।