গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সাঈদা মিমি

প্রিয়নাথ বাবুর বাড়ি


            উনিশ একাত্তর এর তেইশ এপ্রিল, অনেকদিন পর প্রিয়নাথ বাবু একটু শান্তিতে ঘুমালেন যদিও পরিস্থিতী এখন শান্তিতে ঘুমানোর মত নয়, জোর গুজব বেরাইদ হাইস্কুলে পাকিস্তানী মিলিটারীদের ক্যাম্প বসলো বলে নিজেকে নিয়ে ভাবেন না তিনি, ভাবনা ছিলো স্ত্রী বিভা আর কন্যা আরতির জন্যমার্চের পর থেকে পাগল প্রায় অবস্থা হয়েছিলো তার, আরতির বয়স মাত্র চৌদ্দ তার ওপর অপূর্ব সুন্দরী সে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি আসন্ন যুদ্ধের যে বাতাস বইতে শুরু করেছিলো, প্রথমদিকে প্রশান্তির অনুভব জন্মালেও পঁচিশ মার্চের পর তা আতঙ্কে রুপ নিতে শুরু করলো সেইসময় গুলোতে প্রয়াত পিতা কান্তশ্রীনাথের কথাগুলো বেশী মনে পড়তো প্রিয়নাথের


প্রিয়নাথবাবু জমিদারের ছেলে যদিও ছেলেবেলায় সে জমিদারী কর্মকাণ্ড দেখেছে অনেক এবং বড় হতে হতে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের বাড়ির রীতি-রেওয়াজ, আদান-প্রদান, দান-দরবার ঠিক সেইরকমই ছিলো কান্তশ্রীবাবু সুশাসক ছিলেন, নীতিবান এবং কঠোরও তার জমির বর্গাচাষীরা ভাগ বুঝিয়ে দিতো ঠিকঠাক, আবার অনেককে নিষ্কণ্টক জমি লিখে দিয়েছিলেন শর্তহীন সে হিন্দু হোক কিংবা মুসলমান কান্তশ্রীনাথকে লোকে ভয় পেতো অথচ মান্য করতো পীরের মতন প্রিয়নাথ তার বাবার মত হয়নি, সে আমুদে, খরুচে এবং বিলাসী কান্তনাথ আক্ষেপ করে বলতেন, এই সম্পত্তি তুমি ধরে রাখতে পারবে না প্রিয়, আমার ভয় হয় পারবে না, তুমি ব্যাক্তিত্বহীন সম্পদের একটা বিশাল অংশ তিনি দান করলেন স্কুল প্রতিষ্ঠায়, দেবোত্তর করে দিলেন, কেউ বিক্রী করে খেতে পারবে না তবুও রইলো অনেক রাজসিক বসতভিটার অন্দর মহল ,কাচারীঘর তারপর বাইরের বৈঠকখানা, তিনমুখী সিঁড়িঘাটের দীঘি আর দুইমহলা নাচঘর কান্তবাবু কট্টর শাক্ত ছিলেন ,কোন ক্ষণে তিনি কালীমাতার শরণ নিয়েছিলেন জানি না, নাচঘর উপরে সেখানে গড়ে তোলেন বিশাল কালীমন্দির প্রধান পূজারী থাকতো সেখানে আর মন্দিরের লাগোয়া ভিটা তিনি দান করেছিলেন আমানুদ্দিন জোলা কে কি বিস্ময়! একজন মোছলমানের উপস্থিতী ওখানে বেমানান কিন্তু আমান জোলা ছিলো কান্তনাথবাবুর সবচেয়ে বিস্বস্ত মানুষ আজীবন সে বিস্বস্ত থেকেছে এবং তার পরবর্তী প্রজন্ম সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে অবলীলায়


কান্তশ্রীনাথ মারা যাওয়ার আগে প্রিয়নাথ কে শত্রুমিত্র বিষয়টা খানিক বোঝাতে পেরেছিলেন, সেটাই ভরসা হয়েছিলো প্রিয়নাথের কাচারীর প্রধান মুন্সির বদলে যাওয়া দেখেছেন প্রিয় যে কিনা তার বাবার খাস হিসেবরক্ষক ছিলো, মুন্সি সোহরাব খাঁ বুড়ো হয়েছে তাই তার বড় ছেলে ইসমাইল খাঁ এখন দায়িত্ব পালন করে; হ্যাঁ, পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী সে উনিশ একাত্তর সাল যখন প্রিয়নাথের দুই ছেলে কোলকাতায় পড়ছে এবং তিনি স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে বাংলাদেশে, ঈসমাইল খাঁ প্রিয়নাথবাবুর বাড়িটাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্নটা পাকাপাকিভাবে দেখতে শুরু করলো তার প্রথম পদক্ষেপ ছিলো অত্যন্ত চাতুর্যমণ্ডিত, একদিন সে যুদ্ধের আভাসবার্তা জানালো, আরেকদিন শোনালো পঁচিশে মার্চের গল্প, কিছুদিন পর মস্ত জিন্না টুপি মাথায় দিয়ে প্রচার করতে শুরু করলো, তার পরম প্রিয় পাকিস্তানি জওয়ান ভাইয়েরা শীঘ্রি বেরাইদ গ্রামে আসছেন; কাফের মুক্তিদের খেল খতম এরপর হাত কচলে সে দাঁড়ালো প্রিয়নাথবাবুর সামনে, ‘হুজুর আপনার কন্যা ডাগরডোগর হয়ে উঠেছে মাশাল্লাহ, তেনারা স্কুলঘরে ক্যাম্প করবে, মেয়েটাকে সাবধানে রাখতে হবে, চিন্তা করবেন না, আমি সামাল দেবো, দরকার পড়লে নিজের বাসায় নিয়ে রাখবো সব শুনে চক্কর দিয়ে উঠলো প্রিয়নাথবাবুর মাথা কি বোঝাতে চাইলো ধাঁড়ি শয়তানটা!


সেই রাতেই তিনি দেখা করলেন  আমানের ছেলে নঈমুদ্দিনের সাথে। আমানুদ্দিন মারা গেছে গেলো শীতে, তার স্ত্রী বিয়োগের এগারো দিন পর। নাঈমুদ্দিনই এখন সব সামলায়, তেইশ বছরের নাঈমুদ্দিন ট্রেনিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সঙ্গে আরো সতেরজন প্রিয়নাথবাবুকে হাত জোড় করে দাঁড়াতে দেখে কেঁপে উঠলো নাঈম, এইসব কি কাকা! হুকুম দেন। একজন বিধ্বস্ত পিতার এই ভঙ্গুর রূপ সইতে পারছিলো না নাঈমুদ্দিন। সাধারন একজন তাতীর ছেলে সে কিন্তু বোঝার বয়স থেকে প্রিয়নাথের স্নেহের হাত পেয়েছে, কোন জমিদারী ঠাটবাট নয়, প্রিয়বাবু তাকে বলেছিলো, আমাকে কাকা ডাকবি।সেই কাকা কেন তার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াবে?প্রিয়নাথ বললেন, আরতি কে আগরতলা পৌঁছে দে নাঈম, সেখান থেকে ওর মামারা ওকে নিয়ে যাবে, ইসমাইলের নজর পড়েছে ওর দিকে।  কিভাবে কি করবে নাঈমুদ্দিন? একটা মেয়েকে নিয়ে এই বিশাল পথ পাড়ি দেয়া? ধরা পড়ে যাবে নির্ঘাত! বুদ্ধিটা এলো বিভার মাথা থেকে, আরতি কে ছেলে সাজিয়ে পাঠাবে সে সেই রূপময়ী মেঘকন্যা কাঁদতে কাঁদতে কাটলো তার চুল, ছোপ ছোপ কালিঝুলি মাখলো মুখে, বাড়ন্ত বয়সকে ঢাকলো ভুসভুসে প্যান্ট আর মোটা খাদির শার্টে, একদল মুক্তিযোদ্ধার সাথে পথ চলা শুরু হলো তার

প্রিয়নাথবাবুর বাড়ির অন্দরমহল তখনো সুরক্ষিতঈসমাইল খাঁ যার নজরে গ্রামের সব খবরই থাকে তবুও সে ঘুনাক্ষরও জানতে পারলো না আরতির ব্যাপারে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বহির্বাড়িতে আরতি কে দেখা যেত না কখনই ঈসমাইল খাঁ গুপ্ত বাসনা রাতের অন্ধকারে রঙ ছড়াতো, প্রিয়বাবুর কন্যাটিকে তিন নম্বর বিবি করার সুযোগ এসেছে, মিলিটারী জওয়ানরা স্কুলঘরে ঘাটি পাতলেই জমিদার মশাইকে কাবু করা সহজ হয়ে যাবে এইসব স্বপ্ন তাকে বিভোর করে রাখতো সঙ্গে জমিদারের বিশাল দোতলা বাড়ি, তিন কোনা জোড়া আঙিনার শেষ মাথা; অনেক সময় খালি চোখে বোঝা যায় না যখন এইসব স্বপ্ন ঈসমাইল খাঁ কে তাড়িত করছে আসন্ন মসনদী খেয়ালে, প্রিয়নাথ বিভা তখন পড়ে আছে দেবীর চরণে, আমাদের মেয়েকে রক্ষা করো মা, ওকে নিরাপদে পৌঁছে দাও লোক এলো বাইশ এপ্রিল গভীর রাতে, মন্দিরের সুরঙ্গপথ ধরে পাতালঘরে, আরতি পৌঁছেছে ট্রেনিং শেষ করে ফিরেছে ওরা, নিজামের ট্রেনিং চলছে কিন্তু সহযোদ্ধাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে সে বিপদসংকুল সময়, ছেলেগুলো অপেক্ষা করলো না মূহুর্তকাল, গোপন সংবাদ আছে, মিলিটারীরা আসছে   মিলিটারী এলো চব্বিশ এপ্রিল দুপুরে, ঠিক সেদিনই ঈসমাইল খাঁ জানতে পারলো তার প্রাণপাখি উড়ে গেছে প্রিয়নাথের পরিবারের রক্ষাকর্তা হয়ে তাদেরকে সরিয়ে নিতে এসেছিলো সে, প্রিয় নড়েনি; বিভাও না। আরতি কই? বিভাই বলেছিলো, এক মেসোর সাথে মেয়েকে কলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছে তারা ঈসমাইল খাঁর মাথায় বাজ পড়লো   কোন মেসো? আমি দেখলাম না কেন? সব তোমাকে দেখতে হবে কেন ঈসমাইল? কঠোর হলেন প্রিয়নাথবাবু। নিশপিশে ইচ্ছে দলা পাকিয়ে উঠতে শুরু করলো ঈসমাইল খাঁ, মেরে ফেলবে নাকি হারামজাদা কে?


উনিশ একাত্তরে নিজামের বয়স ছিলো তেইশ, যুদ্ধ যাওয়ার আগে স্ত্রী মমিনা আর ছোট্ট জবা কে রেখে গিয়েছিলো সে, ফিরে এসে পেয়েছিলো পুড়ে ভস্ম হওয়া ভিটেবাড়ি। ফেরার চারমাস পর ফিরে পেয়েছিলো মমিনা আর জবা কে, ঈসমাইল খা ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে ওরা, উদ্বাস্তুদের সঙ্গে মাইলের পর মাইল ছুটেছে, দিন পার করেছে অর্ধাহার অনাহারে। সাঁইত্রিশ বছর পর নাঈমুদ্দিন কে আমি প্রথম দেখি, বয়সের চাইতে বেশী বৃদ্ধ, একটা হাত নেই জিজ্ঞেস করি প্রিয়নাথবাবুর কথা। তার কি হলো? ঈসমাইল কি ওদের মেরে ফেললো? আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিলো না, ওরা বেঁচে যায় বাড়িটার বিনিময়ে, ঈসমাইল ওটা নিজের নামে লিখিয়ে নেয় তারপরেও তার উদ্দেশ্য ছিলো মেরে ফেলার, পাছে সম্পত্তি দখল প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এই ভয়ে ওদের রেহাই দেয় সে, অত বিশাল সম্পদশালী মানুষটা একবস্ত্রে গিন্নিমা কে নিয়ে দেশ ছাড়েন, তার আর কোন খবর পাইনি হাতের উল্টাপিঠ সে চেপে ধরে চোখের ওপর আর ঈসমাইল খাঁ? হঠাৎই জ্বলে ওঠে নিজামুদ্দিনের ঘোলাটে চোখ, ঈসমাইলকে যমের বাড়ি পাঠিয়েছি একাত্তরের নভেম্বরে, এই একটা হাত দিয়েই ঝাঁঝরা করেছি ওকে কেউ লাশ নিতে আসেনি, জানাজা হয়নি, ওকে পুঁতে দিয়েছি তেলিখোলার জলায়; পিশাচের শেষযাত্রা পচা কাদার মধ্য থেকে শুরু হোক প্রিয়নাথেবাবুর বাড়ি? ওখান থেকে ঘুরে এসেছি আমি, কেউ নেই কেবল ধ্বসে পড়া ইমারত ঘিরে বুনোলতার ঝাঁড়! কে থাকবে বাড়িতে? ঈসমাইলের বড় ছেলে প্রিয় কাকার ঘরেই মরে পড়ে ছিলো, চোখ উলটে একদিন কারণ ছাড়াই লাগলো আগুন, পুড়লো দুই বৌ, সমাইলের নাতি মরলো দীঘিতে ডুবে বাড়িতে প্রিয়নাথ কাকার আত্মা ঘুরে বেড়ায়


ছেলেবেলায় প্রিয়নাথবাবুর বাড়ির সুড়ঙ্গপথগুলোতে আমিও ঘুরেছি, শুকনো পাতার গন্ধে মিশে থাকতো ধূপের ঝাঁঝ, আলো-বাতাসহীন।শুনেছিলাম একবার, কে নাকি মরেছিলো সাপের কামড়ে, তারপর পথগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন অবশ্য সুড়ঙ্গ কেবল নয়, পুরো বাড়িটাই বন্ধ, কেউ যায় না ওদিকে, পাঁড় নেশাখোরও না।বেলা পড়ে আসে, গ্রামপথে সন্ধ্যা শুরু না হতেই রাত নামে, ফেরা দরকার।   প্রিয়নাথবাবুর বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়ে ফিরছি, সুনসান অস্তবেলা, পাখিদের তাড়াহুড়ো চোখে পড়ছে। এপাশে জমিদারীর অন্দরদীঘি, ওখানে এখন শেষ সুর্যের আভা নেই হঠাৎ ক্যাঁচ শব্দ তুলে একটা খড়খড়ি খসে পড়া জানালা দুলে উঠলো কে ওখানে? নিবিড় তাকাই কেউ নেই আত্মাদের কখনো দেখা যায় না