গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

পরোপকার


নিমাই দা আমাদের পাডার সকলের দাদা । বুড়ো থেকে ছুঁড়ো , ছেলে মেয়ে , মা বোন সকলের প্রয়োজন এ হাজির নিমাই দা । এমন পরোপকারী , সদা মিষ্ট হাস্য  এক অমায়িক ব্যক্তিত্বের লোক সচর আচর পাওয়া মুস্কিল । কারুর কোন বিপদ  হলে নিমাই-দা ঝাঁপিয়ে পডে তার বিপদে সাহায্য করেন । পাডায় কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাঁসপাতালে নিয়ে যাবেন নিমাই-দা । কেউ ডাকলেই হল  এক ডাকে নিমাই-দা সঙ্গে সঙ্গে হাজির ।  ডাক্তার বদ্যি সব ই নিমাই-দার চেনা। পাডায় কোন ফাংসন হবে , পূজো হবে , নিমাই-দাকে না জানিয়ে কেউ কিছু করতে পারে না । সবাই কেমন জেন নির্ভরশীল ওর ওপর । থানা পুলিস সব জায়গায় নিমাই-দাকে সবাই চেনে । আর সুধু চেনা নয় কাজেও লাগেন নিমাই-দা  এরকম নিঃস্বার্থ পরোপকারী লোক এ যুগে পাওয়া মুস্কিল। তাই সকলের প্রিয় নিমাই দা ।  এল আই সির এজেন্ট এবং  আরো কিছু ছোট খাটো কাজ জেমন টীভী মেরামত , কম্প্যুটার এর কাজ করে নিজের খরচ চালান। অনেক সময় টাকা না নিয়েই কাজ করে দেন।  বিয়ে করেন নি জদিও বিয়ের বয়েস পার হয়নি ।বলেন বিয়ে করলে বৌকে খাওয়াবো কি? ওটা আমার কাছে বিলাসিতা । এইতো তোদের নিয়ে দিব্বি আছি ।    
নিমাই-দার বাডির লোক বলেন , উনি নাকি খাওয়ার থালা ফেলে চলে জান কেউ ডাকলে । নিমাই-দার বাবা অনেক দিন অসুস্থ থেকে হঠাৎ মারা জান । তাই সেইথেকে উনি মুসডে পডেন । বাবাকে খুব ভালো বাসতেন ত । বাবা চলে জাওয়াতে ওনাদের বাডিতে উনি সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন , কেউ না জানুগ পাডা পড়শি জানে সে কথা। মনের কথা মনেই রাখেন । ভাইরা যে যার স্বার্থ নিয়ে চলে । অন্য কারুর সঙ্গে সেরকম কারুর জানাশোনা নেই শুধু নিমাই দা কেই সকলে খোঁজে । সামনে কর্পোরেশনের ভোট। আমাদের পাডার অনেকেই চায় নিমাই-দা কর্পোরেটর হলে কিছু কাজ হবে । কিন্তু নিমাই-দাকে কোন পার্টি টিকিট দেবে ? সবাই তো গুছনর জন্য ভোটে নামে !

নিমাই-দার মতন নিঃস্বার্থ লোক ভোটে নামলে পার্টির কি লাভ হবে ? তাই পাডার কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে স্থির করেন নিমাই-দা নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে ড্যাংড্যাং করে জিতে দেখাগ । সকলে দেখুক  জানুক লোকের জন্যে কাজ করলেই লোকে তাকে ভোট দিয়ে জেতায় । যেমন ভাবা তেমন কাজ । সকলে ধরল নিমাই-দাকে ভোটে দাঁড়ানোর জন্য ।
 নিমাই দা কিন্তু গরে রাজি হলেন। সবাইকে হাত জোড় করে বললেন ওই ভোটে দাঁড়ানোর জন্য যেন কেউ তাঁকে  অনুরোধ না  করেন। লোকের জন্য কিছু করতে পারলে তিনি ধন্য হন। তিনি একটি ইংরাজি প্রোভার্ব কে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন সেটা হল, “সার্ভিস টু হিউম্যান বিইংগ ইস সার্ভিস টু গড ।” তাই মানুষের সেবার মাধ্যমে তিনি ভগবানের সেবা করেন এটাই তাঁর ধারনা। পাডার সবাই কিন্তু বলেন, “নিমাই দা তুমি ভোটে না দাঁড়ালে আমরা ভোট বর্জন করবো , তুমি কি সেটা চাও !”  

অগত্যা নিমাইদা সকলের জেদের কাছে মাথা নুইয়ে সকলের মুখে হাসি দেখার জন্য নমিনেসন ফর্ম ভরলেন। ২৮ নাম্বার ওওার্ডের প্রার্থিপত্র দাখিল হল মহা ধুম ধামে  রিটার্নিং অফিসারের কাছে । নির্দল প্রার্থি ভাবে নিমাই দার নমিনেসন দাখিল হওয়াতে আমাদের পাডার প্রোমটার জগদীশ মন্ডল  যে কিনা মিউনিসিপাল কন্ট্রাক্টার তার স্বার্থে বাধা পডল । রুলিং পার্টির হয়ে সেই টিকিট পেয়েছে কিন্তু জেতার আশা ক্ষীণ । অগত্যা বিধায়ক মহাশয় হস্তক্ষেপ করলেন এই ব্যাপারে কারণ বিষয়টা জটিল আর সম্মানের ব্যাপার । তিনি নিমাই দাকে নমিনেসন তুলে নিতে বললেন ।
বলেন, “লোকে তাঁকে দাঁড় করিয়েছে তাই তারাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে” ।  বিধায়ক মহাশয় কথাটায় খুব একটা খুশি হলেন না। যাওয়ার আগে বলে গেলেন ব্যাপারটা ভাল করে ভেবে দেখতে ।
           
জগদীশ মণ্ডলের কথা বলে রাখা ভাল । প্রথমে বিল্ডিং মেটিরিয়াল সাপ্লাই করতো । এখন এলাকায় ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লাগিয়ে জমি জলের দরে কিনে এপার্টমেন্ট করে । পুকুর , ডোবা বুজিয়ে নিম্ন মানের সিমেন্ট , লোহার ছড ব্যাবহার করে এপার্টমেন্ট করে মোটা টাকা কামাচ্ছে । কারো টুঁ শব্দ করার উপায় নেই । রুলিং পার্টির লোক , হাতে মাথা কাটতে দু মিনিট সময় লাগবেনা । পাডার কিছু ছোঁড়া জগদীশের কাছে নেশা করার টাকা পায়, তারা দাপিয়ে বেডায় । জগদীশের  এরাই সৈনিক ।
নিমাই-দাকে বাডির সকলে এই ঝামেলাতে মাথা ঘামাতে বারন করেন । মা বলেন কেন সুখে থাকতে ভুতে কিলোয় তোকে জানিনা । পরের জন্য মাথা ঘামিয় নিজের জীবনটা বরবাদ করলি ।
নিমাই দা হাসি মুখে বলেন , মা কেন তুমি বোঝনা আমি এই নিয়ে শান্তিতে আছি । বেশ ত চলে যাচ্ছে । আমার কি চাহিদা বল ? তুমি আছ বৌদিরা আছেন  এইতো বেশ ।
চোখের জল মুছে মা বলেন তোর চিন্তায় আমার ঘুম হয়না । বাউণ্ডুলে জীবন বেছে নিলি । অন্য সব ভাইরা যে যার গুছিয়ে সংসার করছে তুই ব্যতিক্রম । আমি মলে কে তোকে ভাতের থালা মুখে ধরবে ? খেয়াল রাখিস কিছু ! এখন ওই অলক্ষুণে জগদীশ মণ্ডলের বিপরীতে ভোটে দাঁড়াচ্ছিস। তোর কোন ক্ষতি হলে পাডার লোক আসবে তোর কাছে ? সব্বাইকে চিনিরে ।  
বালাই সাট তুমি কোন দুঃখে মরবে ? ও সব ভেবোনা । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
না ভাববো না ! উনি চলে গেলেন আমার হয়েছে জত মরণ।
আমার লক্ষ্মী মা । তুমি না তারাপীঠে যাবে বলছিলে মায়ের পূজো দিতে । চল সামনের মঙ্গলবার তোমায় তারাপীঠ নিয়ে যাবো । এখন খিদে পেয়েছে কিছু দাও খেতে।
ও নিমাই দা ! নিমাই দা !!
কিরে কি হল বল্টু ?
আর বোলনা । ঝন্টু গিয়েছিল কলেজে । ওকে কলেজ ইউনিয়নের ছেলেরা মেরেছে ।
কেন?
ও তোমার নমিনেশনে সমর্থন করেছিল বলে । বলেছে , কলেজে যদি পডতে চাস আমাদের কথা মত চলতে হবে ।
সে আবার কি ?
তাইতো ! এর একটা হেস্ত ন্যস্ত করতে হবে । জগদীশ হন্যে হয়ে লেগেছে । এতো মাল কামাচ্ছে তাও পেট ভরছেনা ।  ও বলেছে নিমাই কে বল নমিনেশন উইথ-ড্র করতে নাহলে যা হবে তার জন্য তৈরি থাকতে । 
নিমাই কিছু ভাবছিল । হঠাৎ কিছু লোক ঘরে ঢুকে ওকে জবরদস্তী নিয়ে গেল ।
মা চিৎকার করে পাডার লোকেদের ডাকলেন । কেউ এলোনা কাছে । মা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন “আমার ছেলে কি দোষ করেছে ওকে ছেডে দাও ! ওকে ছেডে দাও !! তোমাদের পায়ে পডি। ও সারা জীবন পরের উপকার করেছে । এই কি তার প্রতিদান ?” 
পাডার বুদ্ধিজীবীরা থানায় গিয়ে ডায়েরি করলেন। থানার বডবাবু বলেন, “আপনারা কেন উটকো ঝামেলা বাড়ান বলুন তো আপনাদের কি কোন কাজ নেই ? আমি দেখছি কি করা যায়।
না আমাদের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি চাই ।
প্রতিশ্রুতি ! ‘কেন মশাই আমি কি মন্ত্রী না এম এল এ ? আমার অনেক কাজ । আসুন’ হাত জোড করে বলেন বডবাবু ।    
রাতে নিমাই দাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেল পুকুর পাডে । মাথায় শক্ত আঘাত । পাডার ছেলেরা সব্বাই মিলে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায় । চার বোতল রক্ত লাগে । মাথায় ছটা স্টিচ লাগে । এখন শয্যাশায়ী । পাশে মা আর দুট ছেলে ।
পরের দিন বিরোধী পার্টির মিছিল বেরোয় । জুলুম বাজি চলবে না । চলবে না ......
হায়রে বিধাতা । তুমি কি সত্যি আছো ? মনে ত হয় না। মিথ্যাচারে ঘৃণ্য রাজনীতিতে দেশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে তবুও তুমি দিব্বি বসে আছো ভোগ খাচ্ছ চোখ,মুখ,কান বন্দ করে । বাঃ বেশ !