গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জয় চক্রবর্তী

প্রত্যাশা


বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেই অনুর কেমন একটা অস্বস্থি শুরু হয়েছিল । যাদবপুর থেকে বাসে উঠে গোল পার্কে নামল , কিন্তু অস্বস্থিটা যাচ্ছে না । রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে এগোতে এগোতে বারবার দাঁড়িয়ে পড়ছে । কেবল মনে হচ্ছে , কেউ যেন প্রথম থেকেই ওর পিছু নিয়েছে । অথচ পেছনে তাকালে দেখছে কেউ নেই । অনু কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ায় , চোখ পড়ে কর্তব্যরত পুলিশটার দিকে । কিন্তু কি বলবে ওকে ! পেছনে কেউই তো নেই । অনু আবার এগিয়ে চলে , ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে । স্পোকেন ইংলিশের লাস্ট ক্লাসের কথা ভাবতে ভাবতে মিশনের গেটের দিকে পৌঁছতেই মনে হল কেউ যেন পেছন থেকে ডাকল । ফিরে তাকিয়ে কোন চেনা মুখ দেখতে না পেয়ে এবার সত্যিই বিরক্ত হয় । ক্লাসে ঢুকে আস্বস্থ হয় অনু , সেই সুন্দর পরিবেশ , পরিচিত বন্ধুদের মুখগুলো । ম্যাডাম তখনও আসেননি । সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা শুরু করতে যাবে , অমনি ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন । সবাই দাঁড়িয়ে “Good morning, Madam” বলে ক্লাস শুরু হল । অনু সব অস্বস্থি ভুলে ডুবে গেলম্যাডামের লেকচারে । এমনকি ওকে যখন বলা হল , ওর নিজের সম্পর্কে ইংলিশে কিছু বলতে , অনু কিছু না ভেবে একমনে যা যা মুখে এল বলে গেল । ম্যাডাম খুব প্রশংসা করলেন । ওর স্মার্টনেসের তারিফও করলেন । খুশী খুশী মন নিয়ে ক্লাস শেষ করে অনু বাস স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াল । কিন্তু রাস্তায় নামতেই আবার সেই সমস্যা , কে যেন পেছনে আসছে । গোল পার্ক বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বোলাতেই নজর পড়ল , ওদের উলটো দিকের ফ্ল্যাটের সেই নতুন আসা ছেলেটা --- যে সারাদিন গলা ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে । মাঝে মাঝে অচেনা কবিতাও পড়ে । খারাপ লাগে না অনুর । কবিতাগুলোও সুন্দর আর ওর গলাটাও বেশ সুরেলা । সেদিন অনু ব্যাল্কনিতে চায়ের কাপ হাতে যেতেই দ্যাখে , ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ওদের ব্যাল্কনিতে । চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে , চুলের মধ্যে আটকে রাখা চিরুনিটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল একটাও চুল উঠেছে কিনা । ছেলেটা নিস্পলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে ---- অনুর নজর এড়ায় না । মনে মনে ভাবে , এভাবে দেখার কি আছে ! আমি কি অন্যদের থেকে আলাদা ! চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে আরেকবার তাকায় --- ছেলেটা একইভাবে তাকিয়ে আছে । ধ্যাত ! অসভ্য , এভাবে কেউ দ্যাখে ? অনু ওর চুলের ঢালটা এক ঝটকায় পিঠ থেকে বুকে এনে , চায়ের কাপ হাতে ভিতরে চলে যায় । এভাবে মাঝে মাঝেই চলতে থাকে । ব্যাল্কনিতে ওর অপলক তাকিয়ে থাকা আর সন্ধ্যার পর ওর সুন্দর আবৃত্তি । অনু রোজকার জীবনের পাশে পাশে যেন একটা স্বপ্নের ঝুলন তৈরি করছিল । যেখানে বাড়ি ঘর নেই , বাস ট্রাম নেই , রাস্তা নেই । শুধু দুটো ব্যাল্কনি । চারপাশে মেঘের দল । এক ঝাঁক পাখীর মত কতগুলো কবিতা এক ব্যাল্কনি থেকে আরেক ব্যাল্কনিতে উড়ে আসছে , আবার একরাশ ফুল হয়ে আগের ব্যাল্কনিতে ফিরে যাচ্ছে । কোথায় যেন একটা খুব মিষ্টি গন্ধ ভরিয়ে দিচ্ছে আকাশ বাতাস ।


অনুর চমক ভাঙল ফুলওয়ালী একটা ছোট্ট মেয়ের ডাকে , “ও দিদি , বেলফুলের মালা নেবে ?” অনু চমকে উঠে বলল , “না, যা ! পালা !” কিন্তু নিজে পালাবে কোথায় ? ওর পা দুটো যেন কেউ মাটিতে গেঁথে দিয়েছে । হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দশহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে । ছেলেটা হাসিমুখে ওর দিকে এগিয়ে আসছে । ওর একেকটা পদক্ষেপ যেন অনুর বুকের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে । তবে কি --- ছেলেটা --- আজ ওকে --- ! অনু জীবনে কখনও এত অপ্রস্তুত হয়নি । ওর স্মার্টনেসের কদর বন্ধুমহলে বেশ । কিন্তু আজ অনুর একী হল ! ছেলেটা দু তিন হাতের মধ্যে চলে এসেছে । কোথাও মেঘ নেই , ব্যাল্কনির দুরত্ব নেই , কবিতা পাখীর বাসা যেন অনুর হাতের নাগালে । একগাল হেসে ছেলেটা সামনে দাঁড়াল --- বলল, “হাই !” অনু নির্বাক । যেন খুশীর এক বিরাট আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। ছেলেটা বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা বন্ধ খাম বের করে অনুর দিকে বাড়িয়ে দিল --- “ম্যাডাম ! এটা যদি আপনার দিদিকে দিয়ে দেন , বড় উপকার হয়