গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ডঃ সুজাতা ঘোষ

লাল গোলাপ


সুজয়বাবু নাইট ডিউটি করে সকাল সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরে কলিং বেল বাজালেন বেশ কয়েকবার, তাতেও দরজা না খোলাতে ধাক্কা দিতে থাকেন ক্রমশ। এবারে আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা এসে জড়ো হন। সবাই উদ্বিগ্ন মনে তাকিয়ে থাকে, ফোনও করা হয়, ভিতর থেকে তার শব্দও ভেসে আসে বাইরে। অথচ ওনার স্ত্রী জয়াদেবীর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এতো বড় চিন্তার বিষয় হল। এবার সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলেন। শেষবারের মত আবারও কয়েকবার কলিং বেল বাজালেন সুজয়বাবু দরজা ভাঙার আগে।

শোওয়ার ঘরের বিছানায় জয়াদেবী পড়ে আছেন, মুখটা হাঁ করে খোলা, চোখ দুটো বেড়িয়ে আসছে, হাতদুটো বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে আছে। গলার কাছে অল্প অল্প রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাশের জানালাটা খোলা, জানালার ঐ পাশে একটা ছোট্ট বারান্দা আছে যেটা রেলিং দিয়ে ঘেরা। সুজয়বাবু সেখানেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন। মাথাটা একেবারেই কাজ করছে না, বাকিরা জড়ো হয়েছেন ডেডবডির কাছে। এমন সময় একজন বলে উঠলেন, সরে যাও, সরে যাও, ওখানে দাড়িও না, আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে তাদের কাজ শুরু করেছে, ছবি তোলা, মার্কিং করা, সমস্ত জিনিসের নমুনা সংগ্রহ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনই মনে হয়, গলার কাছে অসংখ্য গোলাপ গাছের কাঁটা ফুটে আছে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, বাইরের কেউ আসেনি। এদিকে বিছানার পাশের জানলার ওপাশে ছোট্ট বারান্দাটা  রেলিং দিয়ে ঢাকা, তাই বাইরের কারোর ঢোকা সম্ভব নয়। একটা গোলাপ গাছ রাখা আছে, সে সম্পর্কে সুজয়বাবুর বক্তব্য হল – পাশের ফ্ল্যাটের সেন পরিবার এক সপ্তাহের জন্য মানালী বেড়াতে গেছে, তাই ওনাদের প্রিয় গোলাপ গাছটা জয়াদেবীর কাছে রেখে গেছেন, আর বলে গেছেন প্রতিদিন জল দিতে আর সপ্তাহের মাঝে একবার মাছের রক্ত দিতে। তাতেই নাকি এই গাছে এত বড় বড় ফুল হয়।

পুলিশ মাথা চুলকে প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে বডি পোস্টমর্টাম করতে পাঠিয়ে দেয়। বাড়িটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই যে যার কাজে চলে গেছে, কারোর পক্ষেই সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। সুজয়বাবু কোথায় যাবেন? একাই হতাশ ভাবে মেঝেতে বসে আছেন মাথায় হাত দিয়ে।  
এলোমেলো সমস্ত পুরনো চিন্তা ভাবনা মাথার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে সুজয়বাবুর। কোন ক্লু খুঁজে পাচ্ছেন না যে, কোথা থেকে কি হয়ে গেল। এটা তো কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। গোলাপ গাছের কাঁটা ফুটে মৃত্যু! কি করে সম্ভব? জয়াদেবী নিশ্চয়ই নিজে গাছের ডাল নিজের গলায় পেঁচিয়ে মারা জান নি। তাহলে কে করল এমন কাজ? কিছু বুঝতে পারছেন না সুজয়বাবু। একসময় বেড়িয়ে এলেন শোয়ার ঘরের বাইরে, একটু স্নান করলে হয়তো শরীরটা একটু ভালো লাগবে। মাথা মনে হচ্ছে আর মাথায় নেই। 

এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, সেন পরিবার ফিরে আসে নি। সুজয়বাবু ওনার স্ত্রী জয়াদেবীর মৃত্যু শোককে মনে রেখেই আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আজ হঠাৎই মিঃ সেন ফোন করে তাকে জানায় যে, ওনাদের বিশেষ কিছু কারনে আর কয়েক দিন দেরি হবে ফিরতে, উনি যেন দয়া করে গোলাপ গাছটার যত্ন নেন। ওটি ওনার স্ত্রীর অত্যন্ত প্রিয় গাছ। সুজয়বাবু  সন্মতি জানিয়ে ফোনটা রেখে আবার কাজে মন দেন। কাজের ফাঁকেই তার মাথায় নাড়া দিয়ে ওঠে, গোলাপের কাঁটাতেই জয়াদেবীর মৃত্যু হয়, মাথার চুল টেনে ছিঁড়লেও কোন উত্তর খুঁজে পান না সুজয়বাবু।

সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া মনটাকে বেশ ফুরফুরে করে তুলেছে। পাশের টবে রাখা গোলাপ গাছটার দিকে চোখ যায় সুজয়বাবুর। সমস্ত ডালপালাগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে, অনেকদিন জল দেওয়া হয় নি। দেখে খুব খারাপ লাগল সুজয়বাবুর। চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে রেখে, ঘরের ভিতর থেকে জলের বোতলটা এনে জল ঢালতে শুরু করলেন টবে। কিভাবে যেন হাতটা ভিতরের দিকের ডালগুলোর সাথে পেঁচিয়ে গেল। টেনে বের করতে যাওয়ার সময় সারা হাতে কাঁটা ফুটে রক্ত ঝরতে লাগল। এবারে অন্য হাত দিয়ে ডালগুলো সরিয়ে ঐ হাতটা বার করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হাত থেকে জলের বোতলটা পড়ে গেছে অনেক আগেই, তা খেয়ালই করেন নি সুজয়বাবু। দু-টো হাত গোলাপের কাঁটা ভরা ডালগুলোর সাথে  অস্বাভাবিকভাবে পেঁচিয়ে গেছে, কিছুতেই বের করতে পারছেন না। টপটপ করে তাজা লাল রক্ত ঝরতে লাগল গোলাপ গাছের সমস্ত ডালের উপর। আস্তে আস্তে সেটা ছড়িয়ে পড়ল গোলাপ গাছের সমস্ত পাতা আর টবের মাটিতে।

দেখতে দেখতে গোলাপ গাছটা ক্রমশ সতেজ হয়ে উঠতে লাগল সুজয়বাবুর চোখের সামনেই।।