গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

তাপসকিরণ রায়

পাতা ঝরার স্বপ্ন
                    


একটা দুপুর। শীতের দুপুর। মিষ্টি রোদ। ধনুষের সংজ্ঞা ফিরে এসে ছিল। 
--আমি কোথায় ?
মাটিতে অসংখ্য ঝরা পাতার ভিড়। ধনুষ সেখানে একলাটি কেন শুয়ে আছে,সে বুঝতে পারল না ! তবে চারিদিকে পরিচিত একটা ভাব তাকে ঘিরে ছিল। সব চেনার মাঝে অচেনার পর্দা ঢাকা কোথায় শুয়ে আছে ?

এক পশলা বৃষ্টি কি একটু আগে হয়ে গেছে ? সোঁদা গন্ধ তার নাকে এসে জড়াচ্ছিল। চোখ যতদূর যায়--এক দিকে ধু ধু করা মাঠের ধোঁয়াশা দিগন্ত--কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই! এবার পাশ ফিরে দেখল ধনুষ। এ দিকটায় বন বনানী হালকা থেকে ক্রমশ ঘন হয়ে সুদূর দিগন্তে পাড়ি জমিয়েছে যেন। 
ধনুষের মনে হল সে যেন বন আর মরুভূমির মাঝখানে পড়ে আছে। ওর মধ্যে উঠে বসার চেষ্টা নেই--কোথায় আছে,কেন আছে, নিরাপদে আছে,না বিপদের মাঝে আছে,শুধু মাত্র এই ভাবনাটুকু ওর মধ্যে চলছিল। 

ফুল ঝরে পড়ার দিনের কোন স্বপ্ন,বিরান ভূমির ধু ধু বেলাভূমি ছাড়িয়ে কোন এক জাগা ! যেখানটা তার খুব,খুব পরিচিত ছিল। অতল তৃষ্ণায় ধনুষ কি খুব পিপাসু !
হঠাৎ ধনুষের চোখে পড়ল তার মুখের ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বিকট চেহারার লোক। লোকগুলোকে সাধারণ মানব বলে মনে হল না। দশ ফুট লম্বা হবে আর সাধারণ মানুষের পাঁচগুণ চওড়া হবে। পরনে তাদের চকমকে কারুকাজ পোশাক। ক্লান্ত, ভীত ধনুষ তার চোখের পাতা বুঁজিয়ে নিলো।
--এর জ্ঞান ফিরেছে মনে হচ্ছে ! যমদূত চিত্রগুপ্ত ধনুষের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে নিয়ে বলে উঠলো।
--তা হলে এখন উপায় ? অন্য যমদূত বলে উঠে,একে এখানে ফেলে গেলে কেমন হয়?
--না,না,ওর পূর্ব জন্মের ভূমি এটা-- স্তরে ওকে কিছুতেই ছেড়ে যাওয়া যাবে না,চিত্রগুপ্ত জবাব দেয়।  
--কেন গুরু ? সাথী যমদূত প্রশ্ন করে ওঠে।
--গত জন্মের সব কিছু তার মনে পড়ে যাবে। আর তা হলে প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করা হবে,যমদূত চিত্রগুপ্ত বলে উঠল।  
--তা হলে উপায় ? অন্য যমদূত প্রশ্ন করল।
--সেটাই এখন ভাবতে হবে। চলো আমরা কিছু সময় গাছ তলায় বসে চিন্তা করে নিই,আমাদের যমরাজকে জানিয়ে কোন বিধান নিতে হবে।

যমরাজের সভার পাপ পুণ্যের হিসাব রক্ষক চিত্র গুপ্ত তার সঙ্গীকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ধনুষের প্রাণ নিয়ে আসতে। কথা মত যমরাজের আজ্ঞাবাহক চিত্রগুপ্ত তার সাথী এসেছে ধনুষের ছায়াপ্রাণ নিয়ে যেতে। মরার পরে প্রাণের সঙ্গে তার ছায়াদেহ নিয়ে যেতে হয় যমালয়ে। এমনটাই চিরন্তন নিয়ম। 
যমদূতেরা এসে ধনুষের রোগ শয্যার পাশটিতে দাঁড়ালো। ধনুষ তখন শেষ নিঃশ্বাসের দিকে এগোচ্ছিল। 

ধনুষ জ্ঞান হারাল--মৃত্যুর আগটায় ঠিক যেমনটা হয়। রোগ শয্যার পাশে অপেক্ষমাণ সবাই ভেবে নিলো ধনুষ  মারা গেছে। ধনুষের মা সন্তানের শোকে মৃত্যুর হাহাকার কান্নায় ভেঙে পড়ল। বাবার দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো। উপস্থিত সবার মাঝে শোকের স্তব্ধতা নেমে এলো।  
ধনুষকে নিয়ে যমদূত রওনা হল যমালয়ের দিকে। পথে দেখা দিল বিভ্রাট--মনে হল মড় দেহ নড়ে উঠলো। জ্যান্ত দেহ যমালয়ে নিয়ে গেলে যমরাজ যে তাদের আস্ত রাখবেন না! 
পথের মধ্যে ধনুষকে ওরা শুয়িয়ে দিয়ে নিরীক্ষণ করছিল মৃত না জীবিত ! ধনুষের শরীরে শ্বাস চলছিল। দুই যমদূত এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যমরাজের পরামর্শ নিতে বনের নিরালায় ঢুকে গেল। ওদের মনে পড়ল,আসার আগে যমরাজ মনে করিয়ে দিয়ে ছিল,সাবধান দেখবি,যমালয়ে জীবন্ত মানুষ যেন নিয়ে আসিস না--পরীক্ষানিরীক্ষা করে তবে আনবি। 
সব ঠিকঠাক চলছিল,কেবল ওই পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারটাই ওরা গেছে ভুলে !
এখন উপায়--যমরাজকে হওয়া ফোন লাগলো চিত্রগুপ্ত,ভয়ে ভয়ে বিশদ বর্ণনা দেবার পর বলল,ভুল যা হবার তা তো হয়েই গেছে মহারাজ,আমাদের ক্ষমা করে এবার বলুন কি করব ?
যমরাজ রেগে লাল হয়ে গিয়ে বলে উঠলো--যা তোরা,ওর ঘরে ওকে রেখে দিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি,না হলে ওকে খুঁজে পাবি না--এ জাগা ওর বিগত জন্মভূমি।
চিত্রগুপ্ত অন্য গুপ্ত ছুটে গেল ধনুষের কাছে কিন্তু কোথায় ধনুষ সে তো সেখানে নেই

ঠিক এখানটায় শায়িত ছিল ধনুষ। তার চার পাশের মাটিতে অনেক ঝরা পাতার ভিড়। শীতের দুপুরের মিষ্টি রোদ ওর গায়ে এসে ঠেকছিল। আর কি ! অসুস্থ ধনুষ উঠে দাঁড়িয়েছে ! সুদূর মাঠের দিয়ে তাকিয়ে ছিল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না--কিন্তু ওই দূরের দিগন্ত,খোলা আকাশ,সাদা মেঘের ভেলা--ওরা ওকে যেন ডাকছিল! 
ধনুষ হেঁটে চলছিল,দূরে,অনেক দূরে...ওই তো লোকালয়-- কুটিরের মত ছোট ছোট অনেক ঘর চোখে পড়ছিল। আশ্রমের মত লতাকুঞ্জ বিতানের মাঝে মাঝে ছবির মত সাজানো সব ঘরগুলি। সব কিছু স্বপ্নময় লাগছিল ধনুষের কাছে।

ধনুষের খুব চেনা চেনা লাগছিল--সবুজে ভোরে আছে চরাচর--তার কাছে আকাশটাও এবার নীল বলে মনে হল না--সবুজ সব সবুজ! কিন্তু  ফুল,ফুলের মতই  রঙ চঙে। সুন্দর। মোহময়ী।
ওই তো দূরের সেই বকুল গাছটা--ধনুষের মনে পড়ে যাচ্ছিল-- চেনা জানা সেই বকুল গাছটা ! ওর ছোট বলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওই বকুল তলায় কত খেলা করেছে। 
ও আশ্চর্য হল—ওই বকুল গাছের নিচে কে বসে আছে ! অনেক কালের পরিচিত কেউ মনে হল। কে,কে ও ! পূর্বাশা,হ্যাঁ,ওই তো পূর্বাশা,বকুল তলার বেদিতে বসে মালা গাঁথছে না!
আমি কে ? বরাভয় আমি ? ধনুষের স্মৃতিতে নিজেকে ধনুষ নয়, এখন বরাভয় মনে হচ্ছিল। সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে--ওই পূর্বাশা সে দিন মালা গেঁথে তার গলায় পরিয়ে ছিল। বলেছিল--বলে ছিল--বরাভয় দা,তোমার গলায় মালা পরালাম--আমরা কিন্তু জন্মজন্মান্তরের সাথী হলাম !
সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠছে

অনন্ত পুরের রাজা,দুরাশয়। রাজা মাঝে মাঝে আসতেন এই আশ্রমে। সঙ্গে থাকত তার একমাত্র কন্যা,পূর্বাশা। আর কিছু সিপাই সান্ত্রী।
বরাভয় আশ্রমের লালিত পালিত ছেলে। পথ হারা,কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। আশ্রমবাসী ছিল তার পরিচয়। তার রূপে,গুণে আশ্রমের সবাই তাকে ভালবাসত। 
পূর্বাশা রাজা দুরাশয়ের সঙ্গে প্রায়ই আসত আশ্রমে। এখানেই বরাভয় আর পূর্বাশার পরিচয়। সে পরিচয় অগাধ প্রেমে পরিণত হয়ে ছিল। তখন ছিল তারা কিশোর কিশোরী।
তারপর একদিন পূর্বাশা বরাভয়ের গলায় মালা পরাল—তার নিজের গাঁথা বকুল ফুলের মালা। রঙ্গিন আলোর স্বপ্নে উভয়ে ছিল বিভোর। ভালবাসার স্পর্শ লাগা ছিল ওদের মধ্যে--সে দিন ওরা প্রথম পরস্পরের শরীর ছুঁয়ে ছিল--ওরা একে অন্যকে আবেগে আবেশে জড়িয়ে ছিল। আর ঠিক এমনি সময় রাজার সান্ত্রীরা ওদের চার দিক থেকে ঘিরে ফেলল। রাজকন্যা পূর্বাশাকে বরাভয়ের বাহুপাশ থেকে ছিনিয়ে নিলো রাজা। আর সৈনিকেরা তৎক্ষণাৎ বরাভয়ের শিরশ্ছেদ করল। প্রচণ্ড মৃত্যু চীৎকারে বরাভয়ের দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
এবার ধনুষ নিজের মাঝে ফিরে আসছিল। সে দেখছিল,বরাভয়ের ছিন্নদেহ যেন তার নিজেরই দেহ--পড়ে রয়েছে তার অনতি দূরে! 
মুহূর্তে সব স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন থেমে গেল সব কিছু--রিল কাটা কোন সচল দৃশ্যচিত্র স্থির ভাবে ভেসে আছে ধনুষের চোখের সামনে। 
ধনুষ চেষ্টা করল,পূর্বাশা,বলে ডেকে ওঠার--কিন্তু কিছুতেই সে পারল না। পূর্বাশার মুখ,দেহ,তার হাতে ধরে রাখা ফুল মালা, ধনুষের প্রতি উদাসী তাকিয়ে থাকা,সব কিছু দেখতে পারছিল ধনুষ। 

ওই যেছেলেটা—দূর থেকে চিত্রগুপ্ত আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল।  
-- মরে নি ? দ্বিতীয় যমদূত বলে উঠলো। 
--না, মরবে না--ওকে আমরা পূর্ব জন্মের স্তরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এই স্তরে এসে ওর পূর্ব জন্মের সব কিছু মনে পড়ে গেছে। 
--তা হলে,উপায়?
--ওই দেখ সব কিছু থামিয়ে দিয়েছি--স্থিরচিত্র বানিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা এখন আধ ঘুমজাগরণে--এবার ভাবেই ওকে বাড়িতে ছেড়ে আসতে হবে। 
তা হলে মরবে না ? সাথের যমদূত জিজ্ঞেস করল। 
--হ্যাঁ,ঠিক তাই--যমরাজ বলেছেন,ওর আরও সত্তর বছর আয়ু বেড়ে যাবে। 
এদিকে ধনুষের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আয়োজন চলছিল। কান্নাকাটি শোকের আবহাওয়া বইছিল। দেহ ফুল চন্দনে চর্চিত--ধুপ ধুনোয় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঠিক এমনি সময় অদৃশ্য যমদূতেরা ধনুষের ছায়াশরীর নিয়ে এলোআর প্রবেশ করিয়ে দিল তার মৃত শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে ধনুষের মৃত দেহ উঠে বসলো। পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ তার কণ্ঠেই আটকে রইল। উপস্থিত সবাই তখন ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। কেবল ধনুষের মা চীৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর দু গাল বেয়ে আনন্দের অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল। ধনুষের বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল ছেলের পাশটিতে।