ভারসাম্য
কর্মক্ষেত্র বদল হলেই ফের একটা নতুন করে শুরু করার
ব্যাপার থাকে । বিদিশা সেটা উপলব্ধি করলো ।
বিদিশার এটা প্রথম চাকরি নয় , কিংবা চাকরির মেয়াদও তার নয় নয় করে খুব কম দিনও হলো না
। ফলে চাকরি নিয়ে প্রথম জীবনের চাপা টেনশন এখন থাকার কথা নয়। অবশ্য এটা ঠিক যে
আগের জায়গায় বহুদিন থাকার ফলে একটা স্বাচ্ছন্দ্য তৈরী হয়েছিল । সহকর্মীদের
সম্বন্ধে মোটামুটি একটা আন্দাজ তৈরী হওয়ায় অফিস পলিটিক্স সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছিল সে ।
যদিও অফিস পলিটিক্সে একেবারেই উত্সাহ নেই তার । কিন্তু কৃশানুর উপদেশ মত চোখ কান
খোলা রাখার অভ্যেসটা বজায় রেখেছিল ।
- রাজনীতি করার দরকার নেই । যারা বলে অফিসে টিকে থাকতে
গেলে অফিস পলিটিক্সে অংশ গ্রহণ করতে হবে , তারা
ভুল । অফিস পলিটিক্স ক্যান মেক অর ব্রেক ইয়োর কেরিয়ার কারণ রিস্ক
ফ্যাক্টর থেকেই যায় । কিন্তু যদি তুমি স্রেফ অবজার্ভ কর , তাহলে দেখবে জাল কেটে বেরিয়ে আসার রাস্তা পেয়ে যাবে ।
নিরপেক্ষ থাকার মজাটা হলো, যুদ্ধে জয়ী এবং বিজিত দুই
পক্ষই খানিকটা ইনসিকিউরড । কারণ এই যুদ্ধে তো আর কোনো ফাইনাল ভার্ডিক্ট হয় না ।
তাই দু পক্ষেরই নিজের এলাকা মজবুত করতে নজর থাকে নিরপেক্ষদের দিকে । ব্যালেন্সিং
এক্ট বলতে পারো , ঝুঁকি কম থাকে ।
ঝুঁকি না নিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখাটা কৃশানুর চারিত্রিক
বৈশিষ্ঠ্য ,
বিদিশা এতদিনে বুঝে গেছে
।প্রথম দিকে এটা মানতে একটু অবাকই হয়েছিল , কারণ
বিয়ের আগে প্রায় চার বছরের মেলামেশায় তার কখনই মনে হয়নি যে কৃশানু এতটা হিসেবী ।
বরঞ্চ বেশ চিন্তাতেই ছিল , এমন উদাসী, খানিক ছন্নছাড়া লোককে নিয়ে কিভাবে ঘর করবে । বিয়ের পরে
এই পরিবর্তনটা চোখে পড়াতে প্রথম দিকে বেশ ভালই লেগেছিল , কিন্তু দিনে দিনে বড়ই চোখে ঠেকছে আজকাল । এতটা ? এতটা পরিবর্তনের কি কোনো দরকার ছিল ? এমন তো নয় যে বিদিশার চাহিদা অপরিসীম আর সেটার তাল
রাখতে গিয়ে কৃশানু একটা ঝুঁকিহীনতার নিরাপত্তায় নিজেকে আবদ্ধ রাখে । বিদিশা ভালো
করেই জানে ,
জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার
আগমনে সে বিচলিত হবে না , বরং খুব শক্ত ভাবেই পাশে
থাকবে কৃশানুর । তবুও ।
এই পরিবর্তন মেনেই নিয়েছে বিদিশা । অবশ্য তার নিজের চিন্তাধারাতেও
কি কোনো পরিবর্তন আসে নি ? একটা সময় ছিল যখন খুব ন্যায়, নীতি এসব নিয়ে মাথা ঘামাত সে । কৃশানুই তার জীবনে
একমাত্র পুরুষ ,
এটাই মনে মনে মেনে নিয়েছিল । তাই
এদিক ওদিক থেকে ছিটকে আসা টুকরো টাকরা প্রস্তাব, ইঙ্গিত এসব থেকে খুব শক্ত ভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নিত । চাকরিসুত্রে
বাইরে যাতায়াতের ফলে বিয়ের পরেও প্রস্তাব কিংবা ইঙ্গিতে ভাঁটা পড়েছে তা নয় ।
এমনিতেই সে খুব সুন্দরী না হলেও আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব এবং সুন্দর কথাবার্তার জেরে
সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয় । ফলে বর্ম ভেদ করে আশেপাশের পুরুষদের তার
কাছে আসার চেষ্টা এখনও অব্যাহত ।
এই তো সেদিন, বেশ
সেজেগুজেই কলেজ গিয়েছিল সে । কপালে হালকা টিপ , চোখে
একটু বেশি ঘন কাজল এইটুকু পরিবর্তনেই নিজেকে বেশ অন্যরকম লাগছিল আয়নায়। সেদিন
সহকর্মী সঞ্জয়ের মুগ্ধ দৃষ্টিও তার চোখ এড়ায় নি । ভালো কি লাগে নি, যখন কিছু একটা দেওয়ার ছলে সঞ্জয়ের হাতের সাথে হাত
ঠোকাঠুকি হয়ে গিয়েছিল এবং হাতের তালুটা সঞ্জয় একটু বেশিক্ষণ ছুঁয়ে থেকেছিল ? এই স্পর্শে চোরা পাপের ইঙ্গিত নাকি নিষ্পাপ মুগ্ধতা , সে নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি বিদিশা । সামান্য স্পর্শটাকেই
সে বেশ উপভোগ করেছিল , ক্ষনিকের জন্য হলেও ।
তাই সেদিন যখন কৃশানু এসে খবরটা দিল , প্রথমে চমকে উঠেছিল সে ।
- এই
অফারটা আমার কাছে খুব ইম্পর্টান্ট বিদিশা । আমার মনে হয় এটা নেওয়া উচিত । তুমি কি
বল ?
কৃশানু ঝুঁকি নিচ্ছে ভাবতেই একটা শিহরণ খেলে গেল
বিদিশার শরীরে । শারজাতে দু বছরের প্রজেক্ট , সাথে
প্রমোশন । আপাতদৃষ্টিতে এটা ঝুঁকি নয় , বরং
উন্নতির সোপান বলতে হবে ।কিন্তু চোখমুখ দেখে বিদিশা বুঝতে পারছে মনের ভেতর কিছু
একটা কাটাকুটি খেলছে কৃশানু । ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো একটু পরেই ।
অফারটা নিয়ে নি , কি বল
?
- অবশ্যই
নেবে , এতে দোনামোনার কিছু নেই । তুমি তো এই অফারটার জন্যই
ওয়েট করছিলে,
তাই না ?
দ্যাটস ট্রু , বাট
আমার চিন্তা অন্য জায়গায় ।
অর্থাত , সেই হিসেবী পদক্ষেপ । প্রোজ
এন্ড কন্সের চুলচেরা পর্যালোচনা । অধীর আগ্রহে কৃশানুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে
বিদিশা ।
- আমার
মনে হয় , তোমাদের সাথে নিয়ে যাওয়াটা ওয়াইজ ডিসিশন হবে না । তোমার
চাকরির গ্যাপ পড়ে যাবে , সেটা তোমার কেরিয়ারের পক্ষে
খুব একটা ভালো হবে না । তার ওপর যখন বাইরে সেটল করবই না , তখন খামোখা টানা হ্যাঁচড়া করে তৈরী সেট আপ নষ্ট করা কি
ঠিক হবে ?
প্রশ্নটা যদিও বিদিশার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে , তবুও বিদিশা ভালো করেই জানে যে এর উত্তর কৃশানু তৈরী
করেই রেখেছে ।
আমার কেরিয়ারের জন্য আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই কৃশানু
, কথাটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল বিদিশা । থাক , এ কথা বলে আর কৃশানুর সামনের রাস্তাকে জটিল করে তুলবে
না । চাকরির ব্যাপারে তার সেরকম মোহ নেই , সে কথা কৃশানু ভালো করেই জানে । তবুও যখন তার সেই
চাকরির অজুহাত তুলেই মনের দ্বিধা প্রকাশ করলো , বিদিশা
খুব ভালোভাবেই বুঝলো যে কৃশানু আসলে সেই চিরাচরিত ঝুঁকিহীনতার পথটাই বেছে নিচ্ছে ।
সবকিছু ছেড়ে নতুন জায়গায় যাওয়া মানে আবার নতুন করে শুরু করা , অর্থাত সেই তো ঝুঁকি থেকেই যায় । তাই কেরিয়ার এবং
দায়িত্ব , এই দুটোর ভারসাম্য বজায় রাখতে কৃশানু সিদ্ধান্ত নিয়েই
ফেলেছে ।
চমকটা আসলে অন্য জায়গায় অপেক্ষা করছিল ।
- আমি আরেকটা জিনিস ভাবছি । তুমি এখানে বাপ্পাকে নিয়ে একা
থাকবে , সেটাও আমার একটা চিন্তার কারণ । বাপ্পার এখন স্কুলিং
স্টার্ট হয় নি ,
এখনো কম করে বছর দেড়েক , এই সময়টা আমি ভাবছি তুমি বাবা মায়ের কাছে গিয়ে
শিলিগুড়িতে থাকো । ওখানে একটা কলেজে আমার বন্ধু সম্বিত আছে । তার সঙ্গে কথা বলেছি
। দে হ্যাভ এ ভ্যাকেন্সি । তোমাকে রেফার করেছি ওখানে । আমি তাহলে অত দুরে থেকে
একটু নিশ্চিন্ত হতে পারব ।
তাহলে এতসব ঘটে যাওয়ার পরে অবশেষে বিদিশার কাছে সব খুলে
বলা ? কৃশানুকে মনে মনে তারিফ না করে পারল না সে । কি অসম্ভব
সুন্দর ভাবে ছক কষে, সব দিক আটঘাট বেঁধে তারপর
কিনা বিদিশার কোর্টে বল ঠেলা ? বিদিশা
বেঁকে বসে কৃশানুর সব ছক নষ্ট করে দিতে পারে , কিন্তু
কোথায় যেন আত্মসন্মানে বাধলো । এতে অধিকার প্রমানিত করা যাবে , কিন্তু সেই ঠুনকো অধিকারবোধের প্রতি বিদিশার কোনো মোহ
নেই ।
ফোনের ওপারে নিভা সতর্কবাণী দেন , " ভুল করছিস মিষ্টু । কৃশানু না চাইলেও তুই জোর করে চলে
যা । একসাথে থাকলে অনেক ব্যাপার ঠিক হয়ে যায় । পরে কি হবে, সেটা এখন থেকে ভেবে কি লাভ মা ? কে আর ভবিষ্যতটা দেখতে পায় বল ?
ভবিষ্যত আমরা কেউ দেখতে পাই না মা , কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তো আমাদের সব পদক্ষেপ । বর্তমানকে তো
আমরা উপেক্ষি করি , তাই না ?
নিভা আর কথা বাড়ান নি । মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন , অতএব মেয়ের দায় দায়িত্ব সব শেষ , ঠিক এরকম ধারণার বশবর্তী না হলেও তিনি জানেন যে মেয়ে
জেদী । অতএব কিছু একটা ঠিক করে ফেললে আর তাকে টলানো মুশকিল ।
বাক্স প্যাটরা গুটিয়ে বিদিশা শিলিগুড়িই চলে এলো ।
কলেজের চাকরিটাও পেতে কোনো অসুবিধে হলো না । শ্বশুর সদ্য রিটায়ার করেছেন, হাতে অঢেল সময় । বাপ্পা এখন শ্বশুর -শাশুড়ির কোলেই ঘোরে
। কাছেই একটা প্রি নার্সারী স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে , সকাল দশটায় যায় , বারোটার
সময় ফিরে আসে । প্রথম দু দিন কান্নাকাটি করছিল , কিন্তু তারপর বেশ জমে গেছে । দুপুরে ফিরে এসে স্নান করানো এবং
খাওয়ানোর দায়িত্ব ঠাকুমার । যদিও একজন সারাক্ষণের কাজের মেয়ে থাকে , তবুও এইসব কাজে শাশুড়ি এখনও বেশ দক্ষ ।
সেরকম বলতে গেলে বিদিশারও যে খুব চাপ তা নয় । খুব ভোরে
ওঠা তার বহুদিনের অভ্যেস । সকালে নিজের জন্য এক কাপ চা বানিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসে।
খানিক পর শ্বশুরমশাই ঘুম থেকে উঠলে ফের এক রাউন্ড চায়ের জোগাড় । একটু পরে রান্না
ঘরে গিয়ে নিজের লাঞ্চ বানিয়ে নেয় টুকটাক , সাথে
এক আধখানা পদ রেঁধে রাখে । ততক্ষণে অবশ্য মিনুও পৌঁছে যায় , শাশুড়িও ঘুম থেকে উঠে পড়েন । ফলে তাদের রোজনামচা শুরু
হবার আগেই রান্নাঘরের কাজকর্ম সেরে নেয় সে । এরকম নয় যে রান্নাঘরের দখল নিয়ে কোনো
চাপা টেনশন আছে শাশুড়ির সাথে । কিন্তু বিদিশা ঠিক এই জায়গায় স্বচ্ছন্দ হতে পারে না
। ঘরের বাকি সব জায়গাতে সে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে , ব্যালকনি , ড্রয়িং
রুম , নিজের শোবার ঘর । কিন্তু রান্নাঘরটাকে নিয়েই তার মনে যত
দ্বিধা । সকালের জলখাবারের বাদে আসল রান্না শুরু হয় বেলা এগারটার পর । মিনু সব
কাটাকুটি ,
জোগাড়যন্ত্র করার পরে তবে শাশুড়ি
রান্নাঘরে ঢুকবেন । বিদিশার কেমন জানি না মনে হয় , শ্বশুরমশাইও শাশুড়ির রান্নাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ।
এরপর সে বাপ্পাকে ঘুম থেকে তুলবে খানিক যুদ্ধের পর ।
সকালের কাজকর্ম করিয়ে , খাইয়ে দাইয়ে তারপর একটু
তাড়াহুড়ো করেই বাথরুমে ঢোকে সে । স্নান করে , নাকে
মুখে অল্প গুঁজে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছনো , সারাদিনে
বিদিশার এইটুকুই হাঁকপাঁকের সময় । অনেকবার ভেবেছে , আরেকটু
আগে বাপ্পাকে তুলে বা খানিকটা এদিক ওদিক সময় বাঁচিয়ে এই হাঁকপাঁকটাকে এড়িয়ে যাবে ।
কিন্তু
এখন মনে হয়,
সারাদিনের নিস্তরঙ্গ রুটিনে এইটুকু
দৌড়ঝাঁপই খানিকটা অক্সিজেন যোগায় বোধহয় ।
সম্বিত অবশ্য একদিন প্রস্তাব দিয়েছিল , "আমি তো আপনার বাড়ির পাশ দিয়েই আসি । আপনাকে তুলে নেব
আমার গাড়িতে । "
এই প্রস্তাবে বিদিশা খুব সচেতনভাবেই না বলেছে । এই নয় যে শশুরবাড়ির
লোক কিংবা কৃশানু জানলে খারাপ লাগবে বলে । কিংবা অযাচিত ভাবে একজনের উপকার গ্রহণ
করতে বিদিশার বাধো বাধো ঠেকছে । আসলে সম্বিতের সাথে সে সহজ হতে পারে না ।
সম্বিত কৃশানুর বন্ধু , বিদিশাদের ডিপার্টমেন্টের হেড । পরিচয় এবং যোগ্যতা , দুয়েরই ফলে এই কলেজে চাকরি পেতে বিদিশার অসুবিধে
হয় নি । এই পরিচয়ের ব্যাপারটা অবশ্য সহকর্মীদের সাথে আর আলোচনা করে নি সে ।
আলোচনার দরকারও পড়ে নি । এমনিতেই স্টাফ রুমে খুব বেশি লোকজন থাকে না
সবসময় । অধিকাংশই পুরুষ সহকর্মী , শুধুমাত্র
মনীষা ছাড়া । দুজন মেয়ে থাকলে সখ্যতা গড়ে ওঠা একটা স্বাভাবিক । কিন্তু এক্ষেত্রে
ঠিক যেন নিয়ম মেনে হলো না ব্যাপারটা । মনীষা সর্বদা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে ।
বহুদিন অনেক পুরুষ সহকর্মীর মাঝে একা কাজ করার ফলে যে অভ্যেস গড়ে তুলেছে , সেই ছক থেকে মনীষা ঠিক বেরোতে পারল না , হয়ত বা চাইলও না ।
বিদিশাও সেরকম গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে । ক্লাস নেওয়া , ক্লাসের ফাঁকে ল্যাপটপ খুলে টুকটাক পড়াশুনো , ফেসবুকে খানিক আড্ডা , এইসব নিয়েই কলেজে সময় কাটিয়ে দেয় সে। কৃশানু একদিন বলল , "পি এইচ ডি টা তো শুরু করতে পারো ।" উত্তরে হেসে
পাশ কাটিয়ে যায় । করতেই পারে , হাতে
এখন অফুরন্ত সময় । কিন্তু করার ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে গেছে । উচ্চাশাকে রাশ দিতে নয় , উচ্চাশা শব্দটাই জীবন থেকে যেন হারিয়ে গেছে বিদিশার ।
একটাই সমস্যা । সম্বিত ।
অবশ্য সম্বিতকে সমস্যা বলা চলে কিনা সেটাও ভেবে দেখেছে
বিদিশা । প্রথমে জয়েন করার কিছুদিন পর সম্বিত নিজে এসে সব খবরাখবর নিত । কোনো
অসুবিধে হচ্ছে কিনা , ক্লাস ঠিকঠাক মত হচ্ছে কিনা
, কিছু রেফারেন্স বা জার্নালের জন্য রেকমেন্ড করতে হবে
কিনা -এইসব টুকিটাকি কথা । সদ্য যোগ দেওয়া সহকর্মী , তার ওপর বন্ধুর স্ত্রী - ফলে এইসব কথাবার্তা তো খুবই
স্বাভাবিক । কিন্তু ইদানিং ব্যাপারটা একটু বেশি চোখে লাগছে বিদিশার । হয়ত স্টাফরুমে
বসে আছে , সেইসময় সম্বিতের ফোন ,একবার আমার ঘরে আসবেন ?
অগত্যা ।
সম্বিত কিছু একটা কাজ করছিল । বিদিশা ঘরে ঢুকতে কাজ বন্ধ না করেই
ইশারায় বসতে বলল ।
খানিকক্ষণ পরে বলল , "হায়ার এডুকেশন মিনিস্ট্রিকে একটা মেল করেছি , একটু দেখুন তো মেলের ফর্মাট খানা ঠিক হলো কিনা ?"
মেলটা ল্যাপটপেই আছে , সম্বিতেরও
তার দিকে ঘুরিয়ে দেবার কোনো উদ্যেগ নেই । অগত্যা উঠে গিয়ে সম্বিতের চেয়ারের কাছে
গিয়ে খানিক ঝুঁকেই দেখতে হলো বিদিশাকে ।
এরকম খুচখাচ প্রয়োজনে প্রায়ই ডাক পড়ে বিদিশার , এবং কোনোসময়েই খুব তাড়াতাড়ি
ছাড়া পায় না সে । অবশ্য কিছু বলাও যায় না । সম্বিত অসম্ভব ভদ্র , খেজুরে আলাপের দিকে তার বিন্দুমাত্র উত্সাহ নেই , কোনো ইঙ্গিতও করে না বিদিশাকে । কিন্তু বিদিশা ভালই
বুঝতে পারে ,
কাজের অছিলায় তাকে ডেকে এনে বসিয়ে
রাখার মধ্যে একধরনের অদ্ভূত তৃপ্তি কাজ করে সম্বিতের । অপরপক্ষের পছন্দ অপছন্দকে
তোয়াক্কা না করে তাকে সামনে বসিয়ে রাখার মধ্যে এক ধরনের
অদ্ভূত সাইলেন্ট অর্গ্যাজম আছে , সেটা বিদিশা বুঝেও কিছু বলতে পারে না ।
তাই যখন সম্বিত বাড়ি থেকে তাকে গাড়িতে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব
দিয়েছিল , তখন একফোঁটা চিন্তা না করেই সে প্রস্তাব নাকচ করে
দিয়েছিল , অবশ্যই খুব ভদ্রভাবে । সম্বিতও আর জোরজার করে নি ।
সেদিন অবশ্য একটু অন্যরকমই ঘটল ।
কলেজের মাঝে ফোন এলো মিনুর , "বৌদি , বাপ্পার খুব জ্বর গো । "
ফোনটা পেয়েছিল যখন , তখন
সম্বিতের ঘরেই বসেছিল সে । খানিক দিশাহারা হয়ে পড়ে । শ্বশুর শাশুড়ি আগেরদিনই
দক্ষিন ভারত ভ্রমনে গেছেন । যাওয়ার আগে প্রথমে একটু দোনামনা করছিলেন দুজনেই , একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়েছে বিদিশা ।
শাশুড়ি একবার বললেন , "তুমিও চল না আমাদের সাথে ? না হলে বাপ্পাকেই নিয়ে যাই । ও আমি ঠিক সামলে নেব
।"
- না মা
, তোমরা যাও । বাপ্পাকে নিয়ে গেলে তোমরা ভালো করে ঘুরতে
পারবে না ।
ফোনের ওপ্রান্তে কথা শুনে সম্বিত জিজ্ঞেস করে , "এনিথিং রং ? "
- ছেলেটার
হঠাত খুব জ্বর এসেছে । বাড়িতে কেউ নেই । আমাকে চলে যেতে হবে ।
খানিক অসহায় ভাবেই বলে বিদিশা ।
মাসিমা মেসোমশাই কোথায় ?
ওনারা গতকাল গেলেন সাউথ ইন্ডিয়া ।
- আই সি
। ডাক্তার দেখাতে হবে তো ?
- হ্যা , ওকে যিনি দেখেন এখানে , তাকেই দেখাতে নিয়ে যাব । তবে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে । বাড়ির
ড্রাইভারটাও দুদিন ছুটি নিয়েছে । হুট করে বললে এখন ড্রাইভারও পাব কোথায় ?
- এটা
কোনো সমস্যায় নয় বিদিশা । চলুন , আমি
আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসছি ।
এই বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে সম্বিত উঠে পড়েছে । প্রাথমিক দ্বিধা
ঝেড়ে পেছনে পেছনে বিদিশা ।
সেদিন সম্বিত এই উপকারটা না করলে সত্যি খুব অসুবিধেতে পড়ত বিদিশা ।
বাড়ি ফিরে বাপ্পাকে ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ কেনা পর্য্যন্ত সম্বিত না থাকলে একা একা এত
মসৃনভাবে সামলাতে পারত কিনা সন্দেহ । তার ওপর খুব বেশি পরিচিতিও নেই এখানে ।
কৃতজ্ঞতাবশত তাই বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামার সময় বলল , "আসুন , একটু
চা খেয়ে যান ।"
- আজ নয়
, পরে আসবো একদিন । আজ আপনি ব্যস্ত থাকবেন ।
এই বলে সম্বিত চলে গেল ।
রাতে বাপ্পার জ্বর খানিক কমেছে । লাইট টা নিভিয়ে দিয়ে হালকা একটু
ঘুম চোখে এসে বসেছে বিদিশার , এমন
সময়ে ফোনটা বেজে উঠলো ।
ছেলে ভালো আছে ?
- হ্যা , জ্বরটা একটু কমেছে । ওষুধ দিলাম একটু আগে ।
- আপনি
খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করেছেন তো ? নিজের
যত্ন নেবেন । আর কোনো দরকার হলে নির্দ্বিধায় ফোন করবেন ।
ফোনটা রাখার পর ঘড়ির দিকে তাকায় বিদিশা । রাত এগারোটা । সম্বিতের
গলাও কি খানিক শিথিল শোনালো ? কানটা
একটু একটু করে গরম হতে শুরু করে বিদিশার। হতে পারে সে একটু সাহায্য নিয়েছে , কিন্তু তাই বলে রাত এগারটায় ফোন ? খুব অস্বস্তি শুরু হতে লাগলো শরীরে । বাথরুমে গিয়ে হাতে
মুখে একটু জল ছিটিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে ।
সত্যি তো , এইটুকু
তো প্রতিদান দিতেই হবে । জীবনে খুব সামান্য মুহুর্তগুলো অনেক সময় প্রয়োজনীয় হয়ে
ওঠে । তাই এই সামান্য সাহায্যের মূল্যও তো বিদিশা অস্বীকার করতে পারে না । তার
প্রতিদান হয়ত এইভাবেই দিতে হবে । রাত এগারটার সময় সম্বিতের ফোন ধরে , তার সঙ্গে হেসে কথা বলে । আরো বেশিক্ষণ হয়ত বসতে হবে
চেম্বারে ,
কাজে কিংবা বিনা কাজে । আরো বেশি
সময় ভাগ করে নিতে হবে সম্বিতের পরিশীলিত কোটরে ঢুকিয়ে রাখা অবদমিত ইচ্ছেগুলোর সাথে
।
কৃশানুই তো বলে , জীবনে
ভারসাম্য রাখাটা ভীষণ জরুরি ।