অলিভিয়া কিংবা সুতোকাটা
ঘুড়ির গল্প
সে চলে গেছে। অবশ্য একদিন সে চলে যাবে— এই সত্য জেনেই আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। সঁপে দিয়েছিলাম
নিজেকে। প্রথম প্রথম সে আমাকে গ্রহণ করতে চাইতো না, দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতো। আমি ফিরে যেতাম না। দরজার ওপাশে
নৈঃশব্দ্যের বিষাদলিপি নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতাম। একসময় দরজা খুলে যায়। সে চলে
যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই দরজা বন্ধ হয়নি একমুহুর্তের জন্যও।
এরপর শুরু হলো কালের নতুন প্রবাহ। আমি দেখলাম প্রেমের স্বরূপ। যদিও
একটা পিছুটান তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো, তবুও
প্রেমের আপাত জৌলুশে সে আর পেছনে তাকাতে চাইতো না।
আমার মনে আছে সেই সব ধুলো-উৎসবের সন্ধ্যায় সে আমার কানে
কানে বলতো —
'তোমাকে পেয়েছি ,আমার তো আর কোনো আফসোস নাই। ' বুঝতাম তার নিঃশ্বাসের উত্তাপে আমার অন্তরাত্মা পুড়ে
খাঁক হয়ে যাচ্ছে। কত রিকশা আর মিছিলের পাশ কাটিয়ে আমরা হেঁটেছি, হাত ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি! কথা বলেছি শব্দে, বাক্যে, কথা
বলেছি নীরবতায়। তারপর একদিন সেই সময়টা চলেই
এলো। হ্যাঁ,
যে সময়টাকে আমি ভয় পেতাম, আবার অবচেতন ভাবে যে সময়ের অপেক্ষায় থাকতাম। এই অপেক্ষা
কষ্টের, যাতনার। ডাক্তাররা যে সময়টুকু বেঁধে দিয়েছিলেন তা
ইতোমধ্যেই পার হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে অলিভিয়া ( শুনেছি কোন এক নায়িকার নামে শখ
করে এই নাম রেখেছিলেন তার বাবা) অনেক শুকিয়ে গেছে,চোখ দুটো ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি তাকে দেখতে গেলেই কোনোরকমে হাত দিয়ে
মুখ ঢেকে রাখতো। পৃথিবীতে কত অলৌকিক ঘটনাই না ঘটে! আমি একটা মিরাকলের জন্য অপেক্ষা
করতে লাগলাম। কিন্তু হায় ,তেমন কিছুই ঘটেনি। হাজারো
বাক্য,শহুরে রিকশার শব্দ, মায়া
আর সাইলেন্সকে পেছনে ফেলে অলিভিয়া চলে যায়... সেই থেকে শুরু হলো আমার চেতন-দহনের কাল ....
আজকের বিকেলের এই আলোটা একেবারে নরম একটা আমেজ নিয়ে আসছে মনে। নিজেকে হালকা লাগে। যেন পালকের মতো— ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে শরীর। এমন পালক-সম শরীর নিয়েই
বেরিয়ে পড়লাম—
উদ্দেশ্যহীন। অদূরেই একটা মাঠ।
সেখানে একদল কিশোর ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়ি দিয়ে কাটাকুটি খেলছে। আমি ঘুড়িগুলোকে লক্ষ
করি। হঠাৎ একটা ঘুড়ি কেটে যায়। সটকে পড়ে নিজ জায়গা থেকে। তারপর নিজেকে সঁপে দেয়
হাওয়ায়। যেন-বা নিজের ওপর আর কোনো দায়ভার নেই— হাওয়া
তাকে যেখানে নিয়ে যায় যাক। সুতোকাটা ঘুড়ির কোনো পিছুটান নেই। নিজেকে সুতোকাটা
ঘুড়িটার মত মনে হয়। সময় কি থেমে গেছে? নাকি
আমি নিজেই... অলিভিয়া, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো সূর্যটা কেমন স্থির? যেন ঘাসের ওপর ঘাপটি মেরে একচিলতে রোদ হয়ে এখনো জমাট
বেঁধে আছে....