রক্তের ভাষা
ক্যানবেরা এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নামল রাজীব, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছে সে।
বিদেশে পড়ার অনেক দিনের স্বপ্ন পুরণ হতে চলেছে তার। বিষয়টা মনে হতেই একটা মৃদু
অহংকার তাকে দাঁত কেলিয়ে ভেংচি দিল, ঝকঝকে
রাস্তাঘাটের ফাঁকে ফাঁকে অহংকারটা রোদের মত হাসছে। বিস্ময় আর অহংকারের খেলাটা শেষ
না হতেই ট্যাক্সি তাকে পৌঁছে দিল হোস্টেলে। বিস্ময়টাকে বগলচাপা দিয়ে আপাতত নেমে
পড়তে হল নতুন একলা সংসারের শুন্য ভাঁড়ার পূর্ণ করতে – জেটল্যাগ নিয়েই হাঁড়ি, সরা, ভাণ্ড, মোবাইল, ইন্টারনেট, ম্যাকডোনাল্ড, টিস্যুপেপার
কত কী – দুতিনটা দিন একেবারে গিগামাইল বেগে চলে গেল।
আজ ১১ ফেব্রুয়ারি, রাজীবের
প্রথম ক্লাশ। ক্লাশে মাল্টিকালচার পরিবেশ, নিজেকে
বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে না, বেশ ভাল লাগল রাজীবের।
কিন্তু দিনশেষে তার মনে হল - কী যেন নাই, কোথায়
কিছু একটা মিসিং। সেই দাঁত কেলানো অহংকারটা কোথায় যেন চলে গেছে, উল্টো একটা থুত্থুরে বিষণ্ন ব্যাঙ তার ভিতর ঘেংয়র ঘেংয়র
করছে। কী হল,
সবই তো ঠিক আছে; ফোনে, স্কাইপে
মা বাবার সাথে নিয়মিত কথা বলছে, আর সে
তো বিদেশে থাকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, তাই
ওসব হোমসিক টিক নিয়ে নিউরনকে ব্যয় করবে না সে। তবু স্বস্তির মেনিবিড়ালটা গেল কই? হঠাৎ ডানদিকে একটা ক্যাফেতে দেখল কয়েকটা ছেলে আড্ডা
মারছে, তার ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল, তার মত আড্ডাবাজ ছেলে আড্ডা দিতে পারছে না বলে হু হু
করছে মন। কিন্তু ক্লাশেতো সে আড্ডা দিল, হোস্টেলেও
দিচ্ছে। কিন্তু এসব আড্ডায় সে প্রান পাচ্ছে না কেন, কী নেই? হঠাৎ গাছের উপর একটা কোকিল
ডাকল, ক্যু - ক্যানবেরায় এখন বসন্ত চলছে। কোকিল নিয়ে
আদিখ্যেতা করার মত ছেলে সে না, ওসব
অকর্মণ্য কবিদের কাজ। কিন্তু কোকিলটার ডাক আবার শুনতে ইচ্ছা করছে যে – এত মধুর লাগছে কেন? কোকিলটা আবার ডাকল, আরে
এতো বাংলায় ক্যু বলছে; তাই কি এত আপন লাগছে! বাংলা, সে ক’দিন
প্রাণ খুলে বাংলা বলতে পারছে না। এ ক’দিনে
রাস্তায় কাউকে সে বলে নাই, ‘ও
বাবুল ভাই,
তুমুল যৌবনতো হুদাই গেল, আর কতদিন আযান দিয়া খাইবেন, এইবার আমাগো একটা ভাবী দেন, আমরা শুধু নাভী দেখুম, বাকি সব আপনার’। বাংলা
কথার জন্যই তার মন কাঁইকুঁই করছে, বাংলার
অভাবেই তার আনন্দ ভাঁড়ার খালি হয়ে গেছে। বিদেশে থাকার অস্ত্রবিদ্যা, শাস্ত্রবিদ্যা সে যথাসাধ্য ঝালিয়েই এসেছে, তার ইংরেজিও বেশ চোসত, কিন্তু মাতৃভাষা যে তাকে এভাবে পোড়াবে তা সে আগে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে
পারে নি । এই প্রথম বিদেশে এসে তার চোখের কোনে জল এল, থামাতে পারছে না, সে এত
ভালোবাসে বাংলাকে?
সে খুঁজতে লাগল আসেপাশে কোথাও কোন বাংলা শোনা যায় কিনা।
না, শুনতে পাচ্ছে না। এখানে বাংলাদেশের মত নদীর পারে লাইন দিয়ে ইটের ভাটাগুলো বাংলায়
ভটভট করছে না,
ঢাকার রাস্তার মত প্রতিটা গাড়ি
প্রতি ৩০ সেকেন্ড পরপর বাংলায় পোঁ পোঁ করছে না, এমনকি
বাংলাদেশের গরুর সমান সাইজের রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত বাংলায় একবার ঘেউ করছে না!
এক সপ্তাহেই সে যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে। এরমাঝে এক ভারতীয়
ছাত্র কৌশিক হোস্টেলে উঠল। রাজীব যেন বেশ কাছের একজনকে পেল। শুরু করল আলাপ, প্রথমে ইংরেজিতেই, কিছুক্ষণ
পর কৌশিক বলল,
তুম হিন্দিমে বাতাও না ইয়ার। হঠাৎ
যেন তার স্বরতন্ত্রে কেউ গ্রেনেড মারল। সে উঠে চলে এল। কেন এমন হল! হিন্দির প্রতি
তো তার কোন বিরাগ নেই। মাকে তো যখন তখন বলত, নেহি
হোগা, কাভি নেহি। বন্ধুদের জন্য তার প্রিয় গালি হল – ‘ছালে বঞ্চিত বাঞ্চোত’! কিন্তু এ প্রবাসে তার মুখ দিয়ে হিন্দি এল না! কৌশিকের
তো দোষ নেই,
সে নৈকট্যকে সহজ করতেই হিন্দির কথা
তুলেছিল। কিন্তু রাজিব এখন এ পরবাসে হিন্দি বলতে পারবেই না।
সে ক্যানবেরার গাছের ডালে শনশন শব্দ শোনে, ওইতো বাংলা; লেকের
জলে ছলাৎ ছলাৎ সুর - ওইতো বাংলা। হঠাৎ এক বন্ধুর ফেইসবুক প্রোফাইলে দেখল, শহীদ মিনারের উপর বাংলা অ আ দেয়া ফটো। এবার সে বুকের
মধ্যে ছলাৎ শব্দ শুনতে পেল, আর দুদিন পরেই তো একুশে
ফেব্রুয়ারি –
বাংলা ভাষার মহান একুশ, অমর একুশে। সে জীবনে কতগুলো একুশ কাটিয়েছে, ছোট্টবেলায় স্কুলে প্রভাত ফেরীতে গিয়েছে, বন্ধুদের সাথে গেয়েছেও – ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ – কিন্তু তা সবই ছিল আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু আজ যেন তার
ভেতরের কোন গোপন কোঠায় প্রতিধ্বনি হচ্ছে- একুশ, বাংলা
ভাষার একুশ,
আমার একুশ। হুম মায়ের ভাষার জন্য
বুলেটের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব, সত্যিই
সম্ভব।
অন্তর্জালে (ইন্টারনেটে) একুশের ইতিহাস পড়তে শুরু করল, একেবারে ৪৭ থেকে ৫২ পেড়িয়ে ৯৯ এ ২১শে ফেব্রিয়ারিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা পর্যন্ত, সে এক
রোমাঞ্চিত ইতিহাস, আর কোন জাতির নেই, আর কোন ভাষার এমনটা নেই। এমন রোমাঞ্চিত ইতিহাস সে এতদিন
জানত না! রাজীব ভাবল, ও নিজেই শুধু অজ্ঞ, সারা পৃথিবীর সবাই নিশ্চয়ই এ ইতিহাস জানে, অন্তত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস এখন পৃথিবীর
সকল শিক্ষিত মানুষই জানে। গর্বে তার মন ভরে গেল।
ক্লাসে গিয়েই এক অজি সহপাঠীকে জিজ্ঞেস করল মাতৃভাষা
দিবসের কথা। উত্তর পেল, স্যরি বন্ধু, সেটা কি? খুবই
হতাশ হয়ে পাশের এক চীনা ছাত্রকে বলতেই সে উত্তর দিল, স্যরি বন্ধু, চীনে
আমরা ইংরেজী এত কম পড়ি যে, ইতিহাস আমরা প্রায় জানিই
না। প্রায় সবাই একইরকম উত্তর দিল। আবার শুনল এক মেয়ে বলছে, দিস গাই ইস টকিং বুলশিট। সে ক্ষান্ত দিল, ভীষণ হতাশ। ভাবতে লাগল, এমন গৌরবের ইতিহাস মানুষ জানেই না, আর আমরা বসে আছি, আন্তর্জাতিকভাবে
আমরা জানানোর চেষ্টা করছি কি? করলে
তার ফল কই,
মানুষ জানছে কই?
আজ একুশ তারিখ- একুশে ফেব্রুয়ারি, সকাল হতেই রাজীব সব কটা খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করে খুঁজল, বাংলাদেশ হাইকমিশন নিশ্চয়ই ক্রোড়পত্র ধরনের কিছু
দিয়েছে। না কিচ্ছু নেই, মহান একুশ বা আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসের কোন নাম-গন্ধ কোন পেপারে নেই। না, এ হতে পারে না, কিছু
একটা করতেই হবে,
মানুষকে জানাতে হবে তার প্রিয়
বাংলা ভাষার বিজয় আখ্যান।
রাজীব ক’জন বাঙ্গালীকে ফোন দিল, কিছু করতে হবে। সবাই বলল, ওহ রাজীব, গ্রেট, ক্যারি অন, ক্যারি
অন, কিন্তু আমারতো আজ কাজ আছে ভাই, আগে বললে আসতে পারতাম। টেবিল কাভারের কালো কাপড়টা কেটে
কালো পতাকা বানিয়ে রাজীব সোজা চলে গেল অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট হাউসের সামনে।
সেখানে একাকী কালো পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আর কী
করতে পারে একা সে। একটু দূরে একলোক গিটারে বব মার্লোর গান গেয়ে ভিক্ষা করছে।
রাজীবকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এল, বিষয়টা
শুনে বলল, আমি লুইস, একজন
অস্ট্রেলীয় আদিবাসী, আমরা আমাদের মাতৃভাষা
হারিয়ে ফেলেছি,
আর তোমরা রক্ত দিয়ে টিকিয়েছ
তোমাদের মাতৃভাষা, গ্রেট, ক্যান আই সিং ফর ইউ? রাজীবতো
অবাক, সে গাইতে শুরু করল ‘আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ কিছুক্ষণের
মধ্যেই লুইসও গিটারে গানটা তুলে ফেলল। রাজীব গাইছে আর লুইস গিটার বাজিয়ে বাংলিশ
উচ্চারণে টান দিচ্ছে,... হামি
কি বুলিতে পারি।
কিছু দূরে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি বা পাত্তা দেয়নি, এবার কালো পতাকা আর ভীনভাষার সুর শুনে এগিয়ে এল। শুনে
বলল, বেশ বেশ, তুমি
তোমার ভাষা দিবস সেলিব্রেট করছ ভাল, কিন্তু
অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টের সামনে তো তুমি বিনা অনুমতিতে কালো পতাকা উড়াতে পার না।
লুইস পুলিশের সাথে তর্ক করছে, সে
বলল, ওয়েল, এট
লিস্ট হি ক্যান ক্যারি হিস ন্যশনাল ফ্ল্যাগ। জাতীয় পতাকা! রাজীবতো জাতীয় পতাকা
আনেনি। হঠাৎ দেখল, সামনের ফোয়াটার চারপাশ
নানান রঙের চারকোনা কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেখান থেকে একটা সবুজ কাপড় নিয়ে
লুইসকে বলল,
তোমার কাছে ছুড়ি আছে? লুইস ঝোলা থেকে ছুড়ি বের করে দিল। কেউ কিছু বোঝার আগেই
রাজীব আঙ্গুলে ছুড়ি চালিয়ে সবুজ কাপড়ের মাঝখানে ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে দিল। পুলিশ বলল, আর ইউ ক্রেইজি? রাজীব
অত্যন্ত শীতল গলায় বলল, ‘আমি
বেআইনি কিছু করিনি। এটাই আমার পতাকা, আমার
দেশের পতাকায় সত্যিই রক্ত লেগে আছে, অনেক
রক্ত নিয়ে ওই পতাকা আমাদের হয়েছে, রক্ত
ছাড়া ওই পতাকা উড়বে না।‘
রাজীব আর একটা আঙ্গুলে ছুড়ি চালাতেই পুলিশ তাকে ধরে
ফেলল। বলল,
দিস ম্যান ইস এটেম্পটিং টু
সুইসাইড। তাকে পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল। পুলিশ কাস্টডিতে পুলিশ অফিসার তার কথা
শুনছে, অনেক সাংবাদিক এসেছে, ক্যানবেরার শান্ত জীবনে ঘটনার মধ্যে বেশ চমক আছে। পুলিশ তাকে ছেড়ে
দিল। পরদিন অস্ট্রেলিয়ার সবগুলো পত্রিকায় প্রথম পাতায় রক্তপতাকা হাতে রাজীবের ছবি
ছাপা হল, সাথে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, খবরের শিরোনামঃ বাংলা – দ্যা ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ব্লাড।
রাজীব তাকিয়ে আছে পত্রিকাটার দিকে। ক্যানবেরায় পা দেবার
সময় যে অহংকারটা তাকে দাঁত কেলিয়ে ভেংচি দেয়েছিল, সে এখন পত্রিকাটার পাতায়, তাকে
বলছে, রাজীব তুমিও একুশ শতকের ভাষাসৈনিক, বাংলার ভাষাযোদ্ধা। রাজীব ভাবছে, হবে না! এ রকম আগুন রঙের ভাষা যে আর কারো নেই, এমন রক্ততিলক পরা বর্ণমালা ব্রহ্মান্ডের কোথাও খুঁজে
পাবেনা যে!