গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

সোনালি ভট্টাচার্য মুখার্জী

পুরোনো পাড়ার রহস্য



সকালের রোদটা এখনও একই রকম বেঁকে আসে এই রাস্তায় । পুনপুন আস্তে আস্তে
লেকের পাড় ধরে হেঁটে যেতে যেতে ভাবেন ; কিছু ছোটবেলা টিকে থাকে এ রাস্তা,
এই রোদের সঙ্গে।পেট্রল পাম্পের কাছাকাছি এসে রাস্তা পার । ডান দিকের ফুটপাথ
ধরে,বড় পোস্টঅফিস পেরিয়ে হাঁটতে থাকেন। যতীন দাস রোডের মোড় অব্ধি আজ
টার্গেট।

ওজন বাড়ছে বলে ডাক্তার সকালে হাঁটতে বলেছেন। ভালই লাগে পুনপুনের। এই
পাড়ায় বড় হয়েছেন। সবাইকে চেনেন। বাবা মার আদরে গোবরে ছিলেন যখন, তখন
পুনপুন বা খুকি বলত দোকানদাররা। সেই ফ্রকপরা বেলায়।পরে দিদি, এখন মাসি,
বা বেশির ভাগই আন্টি বলে।মন্দ লাগে না।ইস্কুলেও স্টুডেন্টদের থেকে ওই
সম্বোধনটাতেই ত অভ্যস্ত। এসে পৌঁছে গেছেন যতীন দাস রোড লেখা গলির মোড়ে ।

এ পাড়ার ফুটপাথদের দেখলেই অনায়াসে বোঝা যায় কলকাতা কতটা কসমোপলিটান। বড়
রাস্তার দুধারের সারি সারি খাবারের দোকান দেখে তো বটেই, ফুটপাথের এধারে
ওধারে ও। এদিকে কলা পাতার ওপর ধোসা ইডলির ঠেলাগাড়িতে দক্ষিন ভারত, তো
ওদিকে শাল পাতার বাটিতে পুরি ঘুগনি গরম জালেবি। একটু এগোলেই ধোকলা, দহি
বড়া, সামোসা, কচুরি । পশ্চিম, উত্তর,উপর নিচ, দেশের কোন দিকের খাবার বাকি
নেই।

      যা ভিড় সব কটা দোকানে, সব রাজ্যের মানুষ যে তৃপ্তি করে খেয়ে দেয়ে
দিব্যি খুসি হয়ে থাকেন কলকাতায়, সক্কাল বেলাতেই বোঝা যায়। পুনপুন দেবী ও ভারি খুশি হয়ে থাকেন। ডাক্তারের কথা শুনে মর্নিং ওয়াক ও হল। আবার রোজ নিত্য নতুন খাদ্যখাদক ও হল। নইলে ত বাড়িতে সেই স্বাস্থ্যকর কর্নফ্লেক্স দুধ, নয় ত টোস্ট আর ডিম পোচ। ধুত,পচে গেছে ।

আজ এই কোনার পুরি জিলিপির দোকানে দাঁড়িয়ে পুনপুনের চোখ পড়ল আরও একটা
খাবার দোকানের দিকে। মোমো।আবার থুপকাও। রীতিমত চিনেম্যানিও শব্দ দিয়ে
হলুদ দেওয়ালে লাল হরফে মেনু লেখা আছে। মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে দুই নং
বাড়িটাই। পুরোনো বাড়ি। পুনপুনের বাবা মায়ের আমলের। সুন্দর গ্রিল দেওয়া
ঝোলানো বারান্দা তিন কোনা মতন। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ঘসা কাঁচ দেওয়া
ডিজাইন। নতুন তেল রঙ হয়েছে একতলায়, খাবার দোকানের কল্যানেই বোঝা যাচ্ছে।
সেই সঙ্গে ওপরের জানলায় রঙ্গিন বিলিতি ডিজাইনের শেড, এসির বাক্স। এ
বাড়িটা মনে হয় মোমোওয়ালারাই প্রমোটারদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পেরেছে।

মনটা খুশি হয়ে গেলো পুনপুনের। এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনে, দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ের দিকে।

হঠাৎ খুব হই হই করতে করতে তিন চার জন মানুষ সুন্দর ছোট্ট আড়াই তলা বাড়িটার থেকে বেরিয়ে আসতে দাঁড়িয়ে গেলেন। ব্যাপারটা কি? শোনা গেলো একটু আগে দোতলার জানলার সামনের পড়ার টেবিলে একটা দামি ট্যাব আর মোবাইল রেখে ওপরের ঘরের পেইং গেস্ট ছেলেটি স্নানে গেছিল। এখন বেরিয়ে এসে দেখছে টেবিল ফাঁকা।ফোনগুলো নেই।পাশের ঘরেই বাড়ির বৃদ্ধ মালিক পেপার
পড়ছিলেন। এই ছেলেটির ঘরে কাউকে ঢুকতে হলে ওনার সামনে দিয়ে ছাড়া উপায় নেই।
তিনি কাউকেই দেখেননি। কাজের ছোকরা, রান্নার মাসি সবাই হাউমাউ করতে করতে নিচে নেমে এসেছে। ছেলেটা ভীষণ খেপে গিয়ে বলছে, নিশ্চই কেউ নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, কেউ একমপ্লিস
ছিল তুলে নিয়ে চলে গেছে। উড়ে ত আর যেতে পারে না। সবাই কোনার পুরির দোকানেই এসে কথা বলতে শুরু করলো । এখানকার কাজের ছেলেগুলোকে জিগেস করতে থাকলো কাঁদোকাঁদো মুখের পেইং গেস্ট ছেলেটা। ঠিক সে বোলিয়ে না, দেখা কিসি কো? গলি কি তরফ টার্ন লিয়া কোই ? ইয়েহি এক
ঘন্টা পাহেলে?” পুনপুন এগিয়ে এসে বললেন, ওই জানলায় গ্রিল নেই?
 কাজের ছেলেটা এগিয়ে এল। আসলে মাসিমা, অনেকটা ওপরে ত। মই ছাড়া ওখানে হাত যাবে না । সেই ভেবেই কাকু আর
” “তো হো গীয়া না লোকশান মেরা? ভাইয়া আপ দেখা কিসি কো ল্যাডার লেকে সুবে সে ?” ক্ষুব্ধ ছেলেটি সামনে দাঁড়ানো জিলিপি ভাজিয়েকেই জিগেস করে। বেচারার চোখে জল এসে গেছে প্রায়। জিলিপি ভাজা থামিয়ে , রসুইওয়ালা বলে, নহি ভাইয়া, কোই নহি ঘুসা ইস তরফ
সুবে সে। ম্য কব সে চুলা জালায়া । বাস উয়ো দেখিয়ে,দো মিস্ত্রি যা রহা হ্য
সাইকেল পে না? উও দোনো উস তরফ যাকে উও রড ঔর সাইকেল উধার ছোড় কে আয়া থা।
পুরি খাই দো প্লেট, চায়ে ভি লিয়া। আউর বাস আভি দো মিনিট পহলে চলে,আভি উস
ফুটপাথ কে পাস যা রহা হ্য।
পুনপুন তাকিয়ে দেখলেন ঠিক উলটো দিকের রাস্তায় লেকের দিকে সাইকেল চালিয়ে
যাচ্ছে সাদা ফুলহাতা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা একটা রোগা ছেলে ।সাইকেলের
গায়ে তার দিয়ে বাঁধা এক গোছা লম্বা লোহার রড। ডবল করে ভাঁজ করে বাঁধা আছে
রড গুলো। একটা হাফ প্যান্ট পরা বেঁটে ছেলে পিছনের সিটে বসে ধরে আছে রডের
পিছনদিক গুলো,আর ঘাড় কাত করে এদিকেই তাকাচ্ছে।

পুনপুন উত্তেজিত হয়ে বললেন, ওদের কাছেই আছে মোবাইল। ক্যা !”
 “দেখুন না,ডাকুন, ডাকুন ওদের ।কাজের মাসি ফুটপাথের ধারে এগিয়ে গিয়ে হাত নেড়ে চীৎকার করে ডাকতে থাকে। ওদের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখানো হচ্ছে বুঝেই আচমকা প্রচণ্ড জোরে ঝুঁকে পড়ে
স্পিড বাড়ায় সাদা শার্ট। পেইং গেস্ট ছেলেটা ফ্র্যান্টিকালি বলে , হেল্প, কোই রোকিয়ে
কাজের ছেলে তপন, জিলিবিওয়ালা, দৌড়োয় ফুটপাথ ধরে।সামনের ধোসাওয়ালা এইবার
বুঝতে পেরেছে, কেউ পালাচ্ছে।সামনের বড় মোবাইলের দোকানের গায়ে দাঁড় করিয়ে
রাখা কার একটা সাইকেল টেনে নিয়ে এই ছেলে দুটোকে ধাওয়া করে সে।

চারপাশে জোরদার চেঁচামিচি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে । ফুটপাথে খদ্দেররা চেঁচাচ্ছে। মোবাইল হারানো ছেলেটা, কাজের মাসি, আবার যার সাইকেল নিয়ে ধোসাওয়ালা দৌড়লো, সবাই পরিত্রাহি চেঁচামেচি ।

ধরে ফেলা গেছিল মিস্ত্রিদের। পুনপুন আগেই পেইং গেস্ট ছেলেটিকে বললেন, কল দা পোলিস।নো বিটিং।

সে বলল, এখনও ত কিছুই পাইনি। পুনপুন বললেন , পাবেই। ওই লোহার রড ভাঁজ করে তার দিয়ে দিয়ে বাঁধা আছে দ্যাখো। ওরা ওটাকেই দেওয়ালের গায়ে মইয়ের মত রেখেছিল।বড়জন যখন খেয়েছে, হাফ
প্যান্টপরা খোকা তারে পা রেখে উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে তুলে নিয়েছে তোমার জিনিস।

আবার আলতো নেমে এসে খাওয়া দাওয়া সেরেছে। বাট নো ম্যান হ্যান্ডলিং। আই অ্যাম কলিং টালীগঞ্জ পুলিস স্টেশান । নিজের মোবাইল থেকেই পুলিশে খবর দিয়ে ছিলেন পুনপুন। একা থাকেন বাড়িতে ,
ফোনে থানার নম্বর সেভড আছে । হ্যাঁ,পাওয়া গিয়েছিল জিনিস গুলো। পেইং গেস্ট ছোকরা গরম জিলিপি খাওয়ালো সব্বাইকে। ধোসাওয়ালার কি চওড়া হাসি। ফোন ফিরে পাওয়া ছোকরা হ্যান্ডসেক করে , মোবাইল নাম্বার নিয়ে আল্লাদে গদগদ হয়ে বলল, পুনপুন আন্টি ইউ আর গ্রেট!