গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৪

মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী


মৃগনয়নী


প্রথম এগজিবিশনেই যে এত ভালো সাড়া পাবে মানসপ্রতিম ভাবতেও পারেনি। বোনের পরিচিতির সুত্র ধরে বিখ্যাত পেইন্টার মিঃ কাপুর কে উদ্বোধনের জন্য আনতে পেরেছে; কিন্তু মিঃ কাপুরও যে সত্যি সত্যিই ওর আঁকা ছবি গুলোকে পাত্তা দেবেন, রেটিং করবেন সেটা স্বপ্নাতীত। বেশ ভিড়ও হলো, আশাতীত ভাবে গোটা পাঁচেক ছবি বিক্রিও হয়ে গেল। পরে অবশ্য খবরের কাগজে প্রশংসার পাশাপাশি খোঁচাও খেতে হলো; ছবি সুন্দর বলে নাকি আঁকিয়ে সুন্দর বলে এত ভিড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ওর মেমরি বুকে চেনা অচেনা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ছবির প্রশংসা, অশির্ব্বানী, উৎসাহ ব্যঞ্জক কথা ভালই সংগৃহীত হয়েছে; বেশ লাগছিল। পরবর্তী এগ্জিবিশনের খোঁজ এখনি করছেন কেউ কেউ। প্রথমদিকে হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিল, কারণ মিঃ কাপুর থিম নিয়ে আঁকার বা অন্তত থিম দিয়ে এগ্জিবিশন করার কথা সাজেস্ট করেছেন, আজ এখানে দাঁড়িয়ে কি ভাববে মানসপ্রতিম ? বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবে তার পরেই তো জানাতে পারবে সবাইকে । কিন্তু না, পরের থিম যেন সশরীরেই সামনে এসে দাঁড়ালো । একটা হালকা মিষ্টি মিষ্টি কমলা রংয়ের চুরিদার পরা, মানসপ্রতিমের ছোটবোন মঞ্জিরার বন্ধু সুনয়নী। এমন সার্থক নাম্নী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। হরিনের চোখের মত কালো কালো বড় বড় দুটো চোখ আর তাতে অসম্ভব গভীর একটা দৃষ্টি। মেয়েটা সর্বাঙ্গ সুন্দর, কিন্তু চোখ এবং তার দৃষ্টি যেন পারিপার্শিককে ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়। মানসপ্রতিমের পরবর্তী থিম 'দৃষ্টি'

জীবনের দ্বিতীয় এগজিবিশনএমন প্রেস্টিজিয়াস গ্যালারীতে প্রায় অকল্পনীয়। মানসপ্রতিমের ক্ষেত্রে সেটাই বাস্তব হলো। কি জানি কোন অজান্তে জাদু কাঠি ছুঁয়ে গেছে তার ভাগ্যকে। মঞ্জির কাছে খবরটা পেয়ে নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হয়নি প্রতিমের। মঞ্জিরা, তার ছোটবোন নাচের,অভিনয়ের জগতের সাথে যুক্ত থাকায় এবং ফাইন আর্টসে খুবই আগ্রহ থাকার ফলে সে বুঝি মানসপ্রতিমের চেয়ে কিছু বেশিই খবর রাখত। কোথায় কার কোন এগজিবিশন হচ্ছে, কে কেমন কাজ করছেন, এক্ষুনি বাজারের ঠিক ট্রেন্ডটা কি, কোন মাধ্যমে এখন বেশি আঁকছে সবাই এইসব খুঁটিনাটি ঠোঁটস্থ; আর এইসব ঘুরে ঘুরেই জনসংযোগও বাড়িয়েছে যথেষ্ট। সে-ই মানসপ্রতিমের সেক্রেটারি হয়ে বসেছে। ঠিক কখন কোথায় এগজিবিশন করলে ভালো, কোন ছবির কত দাম ধার্য্য করা উচিত, কিভাবে ছবি গুলোকে এগ্জিবিশনে দেওয়া হবে, কোনকোন গুলোকে দেওয়া হবে সব ঠিক করে মঞ্জিরাই। প্রতিম তো শুধু ছবি এঁকেই শেষ। যেহেতু সখের শিল্পী কাজেই তার ঠিক কি করা উচিত সেগুলোও সে মঞ্জির কাছ থেকেই শিখল, জানলো। পৌলমী যখন ছেড়ে যায় "গুড ফর নাথিং" বলে; মানসপ্রতিম নিজেও সেটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। সেটা পাল্টানোর পদক্ষেপ নিল মঞ্জি। আর তার প্রথম এগজিবিশনে পরবর্তী আঁকার ইন্স্পিরেশন কেও তো নিয়ে এলো সে ই। প্রথম এগ্জিবিশনের পরে মনে মনে কতবার গাছে ঢাকা সাদার্ন এভিন্যু ধরে হেঁটেছে, তার প্রথম এগজিবিশন যেখানে হয়েছিল তারই আসেপাশে; স্বপ্নে ঘুরে ঘুরে আসত কারণ প্রথম সেই খানেই তো দেখেছিল সুনয়নীকে। তার কি অসামান্য দৃষ্টি মুহুর্মুহু বদলে যাচ্ছিল; যখন মানসপ্রতিমের সামনে দাঁড়ালো ওর মনে হয়েছিল মেয়েটা প্রতিমের অন্তর অবধি দেখে ফেলছে। অস্বস্তি হলেও সম্মোহিত হয়ে গেছিল যেন, চোখ সরাতে পারছিলনা। আবার সেই মেয়েই যখন বন্ধুদের সাথে, চাহনিতে কেমন চপলতা; মানসপ্রতিমের এক বন্ধুর ছোট্ট পুতুলের মত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে মাতৃসুলভ স্নেহ বর্ষণ চোখে। সেই রাত্রেই পরের এগ্জিবিশনের জন্য ক্যানভাস পেতে ছিল প্রতিম; রাত কখন ভোর হয়েছে খেয়ালও হয়নি। পর পর কয়েকদিন স্নান খাওয়া ভুলে শুধু এঁকেছে, কারণ চোখ বুজলেই দেখত দুটো হরিন চোখ; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই চোখ দুটোর বিভিন্ন দৃষ্টিকে বন্দী করতেই হবে, না হলে যেন সব হারিয়ে যাবে, সব তোলপাড় হয়ে যাবে।

এবারের এগজিবিনের আগে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে প্রতিমের; বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বকে নিজে গিয়ে গিয়ে আমন্ত্রণ পত্র পৌঁছে দিয়ে এসেছে। শুধু আঁকার জগতেরই নয় আরও অন্যান্য ক্ষেত্রের স্বনামধন্য দেরও নিমন্ত্রণ করেছে সে। যদিও এবারে একটা দুঃখ যে মঞ্জি তার নিজের অনুষ্ঠানের জন্য এখানে উপস্থিত নেই। তবে এবারের ছবি গুলো আগের বারের চেয়েও বেশি প্রশংসা পাচ্ছে। কি আশ্চর্য্য এক থিম "দৃষ্টি"; সেখানেও আবার বিভাগ উপবিভাগ রয়েছে। যেমন মায়ের দৃষ্টি একটা বিভাগ তাতে উপবিভাগ হলো মায়ের স্নেহ মিশ্রিত আশকারা, শাষন, গর্ব, পরিতৃপ্তি, নিশ্চিন্দি, আনন্দ, সুরক্ষা; আবার প্রেমিকার দৃষ্টিতে আশকারা, আমন্ত্রণ, সুখ, আত্মসমর্পণ। এ ছাড়াও ক্ষুধার্ত দৃষ্টি, ভয়ার্ত দৃষ্টি এবং সব শেষে মোক্ষ ভগবান বুদ্ধের নিমীলিত দৃষ্টি; প্রতিটাই যেন মনকাড়া। মানসপ্রতিমের একটু খুঁতখুঁতানি, তার মনে হচ্ছে ছবি গুলোতে সে সেই দৃষ্টি টাই ধরতে পারেনি যা তার অন্তর অবধি দেখে নেয়; তার কাছে ছবি গুলো প্রাণহীন, যদিও দর্শকদের প্রশংসা পেয়ে একটু শান্ত হয়েছে মন। কিছু নবীন প্রতিভা, কিছু আর্ট কলেজের ছাত্র ছাত্রী ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে মানসপ্রতিমের সাথে; সে এবারে যে ভাবে দু তিন রকম মিডিয়াম একসাথে ব্যবহার করেছে সেই আইডিয়াটা দারুন। চারকোল, অ্যাক্রেলিক, জলরঙ, তেলরঙ, পেন্সিল স্কেচ, সব কিছুরই যেন প্রয়োজন ছিল। প্রতিটা চোখ চারকোলে আঁকা; ফলে ছবিতে সবার আগে নজর কাড়ছে চোখ বা দৃষ্টিটাই। ছবির বাকি অংশ যে ছবি যেমন ডিম্যান্ড করে, কোনোটা জলরঙ কোনোটা স্কেচ কোনটা তেলরঙ বা হয়ত সব গুলোরই কিছু কিছু ব্যবহার।
হঠাৎই ওর মনেহলো চারদিক অন্ধকার আলো পড়েছে শুধু প্রবেশ পথের দিকে। একটা হালকা হলুদ চান্দেরী শাড়ী পরে ঢুকছে সুনয়নী। কেন ও এলে মানসপ্রতিমের দুনিয়া লুপ্ত হয়? আজ কি সুন্দর করে সেজেছে; চুলটা খোঁপা ধরনের করে বাঁধা, তাতে শাড়ীর রঙের সাথে রঙ মিলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ফুল লাগানো। কানে একটা কাঁধ অবধি ঝোলানো দুল, বাঁ হাতের মধ্যমায় একটা ডায়মন্ড শেপের বড় সাইজের আংটি, ডান হাতের কব্জি তে চিকচিক করছে একটা সরু ব্যান্ডের ঘড়ি, একটু খাটো হাতার ব্লাউজ পরা আর ডান হাতেরই বাহুতে একটা বাজুবন্দ; সেটাও একটা রিঙের গায়ে ছোট্ট ডিজাইন আর তার থেকে একটা মুক্ত ঝোলানো আর কিছুই না, কিন্তু সব মিলিয়ে কি অসামান্য রূপসী দারুন অ্যারিস্টক্রেটিক লাগছে। ঠোঁটে একটা হালকা হাসি নিয়ে ওর চোখ খুঁজছিল কাউকে। মানসপ্রতিম যেন সম্বিত ফিরে পেল; যাদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তাদের থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল সুনয়নীর দিকে।
"তুমি এসেছ?"
"আসতে নেই বুঝি?" গলার আওয়াজেও কি ব্যক্তিত্ব; আগের বার কথা হয়নি তাই শুনতেও পায়নি।
"
নাঃ, তা নয় আসলে মঞ্জি তো নেই, তাই, ভাবলাম"

"এবারের গুলো কিন্তু আরও বলিষ্ঠ; আর এই যে দুটো তিনটে মিডিয়ামের একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন অসামান্য লাগছে আমার" কথা ঘোরায় সুনয়নী।
"
হ্যাঁ, সকলেই সেটার প্রশংসা করছেন"
"
আমি সবকটা ছবি দেখেনি, তারপর আপনাকে একটা প্রশ্ন করব"
"
তুমিও? আচ্ছা বেশ কোরো প্রশ্ন। তবে আন্দাজ করতে পারছি প্রশ্নটা কি"
"
কি বলুনতো?"
"
এই যে, এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি কোনটা?" হাসছে দুজনেই
"
প্রশ্নটা বুঝি সবাই করেছেন?" ঘুরে ঘুরে ছবি দেখতে দেখতে বলে সুনয়নী।
"
হ্যাঁ, তা বলতে পারো, তবে সঠিক উত্তরটা একজনই পাবেন"
"
কি সেই 'সঠিক' উত্তর? অবশ্য আমি কি পাব উত্তরটা?"
"
হ্যাঁ, পাবে কারণ__" অন্য একজন কথা বলতে আসায় মুলতুবি রইলো বাকি কথা। মানসপ্রতিম টের পায় তার বুকের ভিতর অশ্বক্ষুরাদ্ধ্বনি।
"
তুমি দেখো, আমি আসছি" মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাকি ছবিগুলোর দিকে মন দেয় সুনয়নী।
দর্শক মোটামুটি সবাই চলে গেলেও কিছু অফিসিয়াল কাজকর্ম্ম থাকেই, সেগুলোও চটপট সেরে নিল মানসপ্রতিম; কারণ অপেক্ষায় রয়েছে সুনয়নী। বাড়ি চলে যায়নি সে, প্রতিমও অবশ্য এটাই চাইছিল যদিও মুখে কিছু বলেনি। গাড়িতে উঠেই
"
কোথাও বসে কফি খাবে?"
"
এখন?" হাসছে সুনয়নী
"
কেন এখনে কি অসুবিধা?"
"
নাঃ আমি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি"
"
বুঝলাম না"
"
আচ্ছা এত গুলো দারুন দারুন ছবি দেখার পর কোনো দোকানে একগুচ্ছ অচেনা মানুষ, হইচই, উচ্চৈস্বরে গান, এই সবের মধ্যে বসে কফি খেতে ইচ্ছে করবে?"
"
প্রথমদিনেই কিকরে বলি আমার ষ্টুডিওতে চলো, সেখানে কফি বানিয়ে খাওয়াব। পারি অফার করতে?"
"
আজকের দেখা হওয়াটা সেই অর্থে 'প্রথমদিন'নয়; আর___"
"
আর?"
"
সত্যিই কি মনেহচ্ছে প্রথমদিন? মানে আমাকে অফার করতে দ্বিধা হওয়া কি উচিত? আমি হলে কিন্তু এতটুকু দ্বিধা করতাম না। আসলে আমার না মনেহয় যেন কতদিনের পরিচয়" মাথাটা সিটের পিছনে হেলিয়ে বসে বলছে।
"
সাদার্ন এভিন্যু দিয়ে হাঁটো কি আমার সঙ্গে?" একটু অবাক চোখে তাকায় সুনয়নী
"
না, মানে আমি বোধহয় রোজ হেঁটেছি তোমার সাথে, আর ঘুম ভাঙ্গলে খুব মন খারাপ করত, মনেহত কেন ভেঙ্গে গেল ঘুম" বাইরের দিকে তাকানো সুনয়নী;
"
কি হলো, অন্যদিকে তাকিয়ে যে"
"
ইচ্ছে করেই, নইলে ড্রাইভার যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে অ্যাক্সিডেন্ট অনিবার্য্য"
"
ওহ! অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলে বুঝি ড্রাইভারও অন্য দিকেই দেখে?" হাসছে দুজনেই
"
আমরা কিন্তু ষ্টুডিওতেই যাচ্ছি এখন তাহলে"
"
আজ থাক, আমি পরে একদিন সরাসরি যাব; অনেকটা সময় না থাকতে পারলে মন ভরবেনা। আজ রাত হয়ে গেছে বাড়ি ফেরার তাড়া হয়ে যাচ্ছে"
"
সেটাও ঠিক" একটু মনক্ষুন্ন
"
আমি কিন্তু উত্তরটা পাইনি এখনো"
"
কিসের?"
"
ওই যে, এবারের এগ্জিবিশনের কোন ছবিটা সব চেয়ে পছন্দের?"
"
ওহ! ওটা যেদিন ষ্টুডিও যাবে সেদিন বলব"
"
তাহলে তো কালই যেতে হয়, না হলে আমার খুব ছটফটানি থাকবে; কাল আসতে পারি?"
"
তোমার জন্য এনি ডে, এনি টাইম, কোনো পারমিশনের দরকার নেই। আমি খুব খুশি হব তুমি আমার ওপর জোর খাটালে"

ডোরবেল বাজলে মা দরজা খুলে অমন দারুন মূর্তি সামনে দেখবে ভাবেনি; লুকোতে পারলনা মুগ্ধতা, চোখে মুখে ফুটে উঠলো অভিব্যক্তি সুনয়নীকে দেখে। এক কথায় ষ্টুডিওতে নিয়ে গেল। প্রতিম একটা অসাধারণ ঘোড়ার স্কেচ করছিল; সকালের রোদ এসে পড়েছে ঘরের বিভিন্ন জায়গায়। আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠায় কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পিছন ঘুরল সে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে, আনন্দ সুনয়নীর চোখেও
"
এই বুঝি সুনয়নী?" মায়ের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল দুজনেরই
"
হ্যাঁ, মা এ-ই" মাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করায় আরো বিগলিত
"
তুমি বোসো, আচ্ছা কফি কি আমি করব না তুই?"
"
না মা আমিই বানিয়ে নেব" ছেলের ইশারা বুঝলো মা
"
শুধু মনে করে বানাস; ভুলে যাসনা"
"
মা-আ"
"
না-আঃ, তুই এমনিতেই ভুলো, আর এক্ষেত্রে তো ভুল হওয়াটা জাস্টিফায়েড" বলে হেসে মাথা নেড়ে চলে গেল মা।
"
আমার এখন আফসোস হচ্ছে; কেন কবিতা লিখতে পারিনা" চোখ তুলে তাকিয়ে আছে সুনয়নী, হঠাৎ কবিতা কেন সেই জিজ্ঞাসা চোখে।
"
তাহলে তোমার আজকের এই আসাটাকে কি সুন্দর করে বলতে পারতাম বলো?" হাসছে দুজনেই। ইজেলের কাছে গিয়ে ক্যানভাসটায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল
"
কাল রাত্রেও আমি স্বপ্ন দেখেছি"
"
কি ঘোড়া?"
"
ঘোড়া শুধু নয় ঘোড়সওয়ার। আমি বেশ কিছুদিন ধরেই দেখি; হয়ত স্বপ্নের রাজ্যে থাকতে ভালোবাসি বলেই। আমার স্বপ্নের রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে আমার সামনে। তবে ঘোড়ার মধ্যে বেশ একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে, একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব, একটা স্পিডের রিপ্রেসেন্টেশন বলে মনেহয় আমার; যেটা আমায় খুব টানে।"

প্রতিমের ষ্টুডিওটা দারুন সুন্দর; মনেহয় যেন লগ কেবিন সেভাবে বানানো দেওয়াল ছাদটাও ঢালু করা সেখানে একটা সানরুফ বা ফ্যানলাইট গোছের জানলাও করা, সেখান দিয়েও সকালের সোনালী রোদ ঘর ভরিয়ে দেয়। জানলা দিয়েতো আসেই। বেশ বড় ঘরটা তার ঠিক মাঝখানটায় চওড়া একটা দেওয়ালের মত পিলার। ঘরে ঢুকলে মনেহয় যেন ওটা ঘরটাকে দুটো করেছে কিন্তু ও পাশে গেলে বোঝা যায় ওটা নেহাৎই চৌকো চেহারার বড়সর পিলার একটা। অনেক কটা ইজেল, প্রায় প্রতিটাতেই ক্যানভাস পাতা। একটার পায়া ভাঙ্গা তবু সেটাতেও ক্যানভাস। ঘুরে ঘুরে দেখছে সুনয়নী; পিলার থেকে আড়াআড়ি ঘরের মধ্যে আরেকটা প্লাইউডের হাফ পার্টিশন। সেটার গায়েও ছবি এঁকেছে; আর তার ওই পারে প্রতিমের কুকিং স্টেশন। ঠিক কুকিং নয় চা কফি বানানোর বন্দোবস্ত। যখন সুনয়নী দেখছে সব ঘুরে ঘুরে মানসপ্রতিম কফি বানানোর জন্য লেগেছে। কুকিং স্টেশনের ঠিক ওপাশেই ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে একটা বেড পাতা জানলার ধারেই।  আগে শুধু রাত হয়ে গেলে এখানেই ঘুমত মানসপ্রতিম; এখন অবশ্য এটাই ঘুমের জায়গা। ঘরে বসার ব্যবস্থা বলতে মূলতঃ এটাই, এছাড়া একটা রকিং চেয়ার ঘরে ঢুকেই ডান হাতে রাখা। প্রতিটা ইজেলের সামনে আলাদা আলাদা করে গুচ্ছ ভরে রঙ তুলি রাখা।

সুনয়নী বেডটায় বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে। আজ একটা লাল ঢাকাই শাড়ী পড়েছে উজ্জ্বল হলুদ ব্লাউজ দিয়ে, চোখে কাজল ছাড়া আর কোনো প্রসাধন নেই। চুলটা দুই গুছির বেনুনি করা, সামনে দুপাশে দুটো স্প্যাঘেতি ঝোলানো। খুব সাধারণ ছোট্ট দুটো সোনার দুল আর আঙ্গুলে একটা ছোট্ট ফুলকরা আঙটি ছাড়া কোনো গয়নাও নেই। ঘরে কফির সাথে ক্রসাঁত টোস্টের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। ছোটো মত একটা আভেনে টোস্ট করে নিচ্ছে প্রতিম। সুদৃশ্য বিশাল মাগে করে কফি আর হ্যান্ড পেইন্টেড ডিশে করে ক্রসাঁত নিয়ে সে ও মুখোমুখি বসলো। হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালো সুনয়নীকে
"
প্লিজ, মা একটু পরেই ছুটির দিনের জল খাবারের বড়সড় আয়োজন করবে, এঘরেও আসবে সেসব ততক্ষণ___" কফি সার্ভ করার রকম দেখে সুনয়নী চোখের ইশারায় বোঝালো "গ্রেট"; ফেনায়িত কফিতে চুমুক দিয়ে চমৎকৃত
"
দারুন হয়েছে; একজন প্রকৃত শিল্পীর মতই। না, মানে ঠিকঠাক যেকোনো কাজ করাটাই তো এক একটা শিল্প। কি রান্না, কি বাজার, কি ঘরগেরস্থালির কাজ।
"
ভালো লেগেছে তোমার? একটু ভয় ভয় পাচ্ছিলাম"
"
কেন?"
"
আসলে আমার বোধহয় সেল্ফ কনফিডেন্সের অভাব; পারিনা করতে তা নয় সবেতেই কিন্তু কিন্তু লাগে। পৌলমী মানে আমার প্রাক্তন স্ত্রী, আমায় বুঝিয়েছিলেন আমি "গুড ফর নাথিং" আমিও সেটাকেই ধরে বসে ছিলাম ওভার লুক করে যেতে পারিনি। খুব অবশ্য ভুলও বোধহয় বলেন নি; আমি আদর্শ স্বামী, আদর্শ সন্তান, আদর্শ দাদা কোনো কিছুই হবার অনুপযুক্ত। যেগুলো মনে রাখলে অন্য মানুষকে খুশি করা যায়, সে সব কিছু মনে রাখতে পারিনা। কম্পারেটিভ লিটারেচার নিয়ে মাস্টার্স করে শুধু ছবি আঁকা নিয়ে পড়ে রইলাম। বাবাদের পারিবারিক বিজনেস, আমি কোনদিন ভেবেই দেখিনি যে, আমারও রোজগার করা উচিত, না হলে আমার স্ত্রীয়ের মানহানী হয়। আমি বেশ হই হই করে সবাইকে নিয়ে সিনেমা,শপিং,রেস্তরা এগুলো পারিনা। ছবি আঁকতে বরাবরই ভালোবাসি দাদামশায় সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, কিন্তু সেটাকে যে পাঁচজনের কাছে নিয়ে যেতে হয়, সেটাই আমার উপার্জনের রাস্তা হতে পারে এগুলো মাথাতেই আনিনি। আমাদের বিয়েটা আসলে, ছিল একটা বিজনেস ডিল; পৌলমীর বাবা আমার বাবা কাকাদের বিজনেস পাটর্নার ছিলেন। কাকিমারই মনেহয় এই বিয়েটা দেবার কথা; কাকিমার মতই পৌলমীও কাজ করতেন ওদের সাথে। যেমন হঠাৎ করেই অন্যদের ইচ্ছায় সে এসেছিল, তেমনি আচমকাই তার নিজের ইচ্ছেতে চলেও গেল। সে চলে যাওয়াতে বাবাদের বুঝি কিছু ক্ষতি হয় বিজনেসের তাই বাবা, কাকা, কাকি খুবই অসন্তুষ্ট আমার ওপর। পৌলমী চলে যাওয়াতে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছিল আমি সত্যিই গুড ফর নাথিং; নাহলে আমার মত ঘরের এক প্রান্তে আপন মনে থাকা মানুষের সঙ্গও কারোর কাছে বিষময়? আমি রাগ করতে পারিনা, ঝগড়া বিবাদ আসেনা, ক্ষিধে তেষ্টার বোধও বুঝি কমই; দুবার চা কফি খেতে ইচ্ছে করলে বলতেও পারিনা মুখ ফুটে। পড়াশোনা চলাকালীন কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল এখনতো তাদের সাথেও যোগাযোগ নেই; আমার কারণে অনেক লোক যাতায়াত করেন বাড়িতে এমনও না। বাড়ির মানুষেরা আমায় নির্বিবাদি, নির্বিরোধি এইসব আখ্যা দিয়ে দিয়ে আরওই বারোটা বাজিয়ে রেখেছেন। মঞ্জির কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ যদিও শক্ত হাতে হাল না ধরত সময় মত, আজ তাহলে তোমায় পেতামনা সু।" গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মানসপ্রতিম; এই প্রথম যেন লজ্জা পেল সুনয়নী। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য উঠে একটা ইজেলের সামনে গিয়ে সেখানে টুপ টুপ করে রাখা রঙ গুলো একটা একটা করে আঙ্গুলের ডগায় এক এক রঙ তুলে দেখতে লাগলো। মানসপ্রতিম টিপিক্যাল প্যালেট ব্যবহার করেনা, একটা লম্বা ট্রে বা ছোটো ছোটো সুদৃশ্য বাটিতে করে রঙ নেয়।
"
আচ্ছা রঙ তুলি দেখলেই মনটা কেন পেইন্টার হয়ে ওঠে?" 

উত্তর না দিয়ে আসতে করে পিছন থেকে এসে সুনয়নীর হাত দুটো ধরল মানসপ্রতিম। অচেনা ভালোলাগায় কেঁপে উঠলো সু। ঠিক যেন পিয়ানোর রিডে আঙ্গুল ছোঁয়াচ্ছে সেই ভাবে ধরে ধরে আঙ্গুলে ভর্তি করে রঙ লাগাতে লাগলো। তারপর ওই ইজেলের ক্যানভাসে সুনয়নীর দুই হাত দুই দিকে ঘুরিয়ে টানা টানা লম্বা লম্বা আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট তৈরী করলো
"
এই ক্যানভাস শুধু তোমার, যখনি আসবে ছাপ দিয়ে যেও" কানের কাছে মুখ নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল। তারপর ওই ভাবেই হাত ধরে কুকিং স্টেশনের পাশের ছোট্ট সিঙ্ক টায় নিয়ে গিয়ে সরু করে কল খুলে ধীরে ধীরে রঙ ধুয়ে দিল সুনয়নীর আঙ্গুল থেকে; পাশে রাখা তোয়ালের মধ্যে হাত দুটোকে ভরে সযত্নে মুছিয়ে আঙ্গুলের ফুল আঙটি টা কে ঘুরিয়ে ঠিক করে হাত ধরে বেডে বসালো। মানসপ্রতিমের মুগ্ধতার সামনে নিজের পরনের শাড়ীর মতই লাল হয়ে উঠেছে সুনয়নী। একটা হাত কোলের ওপর আলগোছে রাখা, মাথা নীচু করে হাসছে; আরেকটা হাত মানসপ্রতিমের হাতের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আজ চুলে দুটো স্প্যাঘেতি করা ছিল, সে দুটো গালের পাশ দিয়ে ঝুলে নীচে নামছে। হঠাৎ করেই
"
নোড়না একদম প্লিজ,একটুও নড়বে না" বলে সুনয়নীর হাতটা ওর কোলের ওপর সযত্নে ফেরত রেখে উঠে গেল একটা ইজেলের কাছে। বাচ্চাদের ব্যবহারযোগ্য ক্রেয়নেও আঁকে কখনো কখনো মানসপ্রতিম। দ্রুত হাতে খসখস করে টেনে টেনে সুনয়নীর লজ্জাবনতা বসে থাকার দৃশ্যটা বন্দী করলো। পুরো ছবিটা ক্রেয়নে হলেও চোখের পালক আর কাজল টানা কিন্তু সেই চারকোলে।  একটা স্বর্গীয় আলো যেন এসে পড়েছে সুনয়নীর ওপর ছবিটা তেমন করেই আঁকলো; তারপর একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে এক্সট্রা রঙ সরিয়ে দিতে লাগলো আর এই কাগজ ঘষার ফলে একটু আবছা মত নরম মত হয়ে উঠলো ছবিটা, রঙগুলো পরস্পরের সাথে মিশে একটা স্বপ্নের দৃশ্য তৈরী করলো যেন, এ তো তার স্বপ্নই। শুধু আবছা হলনা চোখ আর ঠোঁটের অনুনকরণীয় হাসিটা। কাগজ ঘষবার আওয়াজে কৌতুহলী সুনয়নী উঠে এসে দেখল ছবিটা
"
এই তো, কে বলল তুমি কবিতা লিখতে পারনা?"
"
আরেকবার বলবে?"
"
কি?"
"
এই যে মাত্র যেটা বললে"
"
কেন? কিছু ভুল বললাম?"
"
উঁহু ঠিক উল্টো, এতক্ষণে ঠিক বলেছ; কাল থেকে তো হয় আপনি নাহয় উহ্য রেখে বলা হচ্ছিল কিনা" বলে হাত ধরে কাছে টানলো মানসপ্রতিম, লজ্জা পায় সুনয়নী
"
, সেটাও খেয়াল করা হয়েছে?"
"
হবেনা? আমি, 'তুমি' শোনবার জন্য কবের থেকে বলে অপেক্ষা করছি" মাথা নীচু করে হাসে সুনয়নী।
"
আচ্ছা আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু পাইনি এখনো; কাল বললে যে আজ নাকি বলবে"
দরজায় নক করে কাজের লোক ঢুকলো এক গাদা খাবার দাবার নিয়ে
"
মা বললেন দাদামশয়ের ঘরে একবার ওনাকে নিয়ে যেতে"
"
হ্যাঁ, মনে আছে, যাব"
"
সেটা কি ব্যাপার?"
"
আমাদের পরিবারে একটা নিয়ম মানেন সকলে, দাদামশায় এখনো জীবিত আছেন তো, প্রথমদিন কেউ এলে আগে ওঁর সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যাওয়াই রীতি; এবং যার অথিতি সে ই নিয়ে যাবে পরিচয় করাতে"
"
বাঃ, বেশ তো; তবে চলো আগে দেখা করে আসি, এসে নাহয় খাওয়া দাওয়া করব। যদিও এত খাওয়া আমার কম্ম নয়" একটা মানুষ সারাক্ষণ কি করে এত হাসি মুখে কথা বলে অবাক হয়ে দেখে মানসপ্রতিম।
"
নাহ, আগে খেয়ে নাও; খাবার ফেলে রেখে যাওয়া নিয়ম নয়"
"
, আচ্ছা বেশ তাহলে এবারে খেতে খেতেই উত্তরটা শুনি"
"
এগ্জিবিশনের একটাও না"
"
মানে?"
"
মানে, আমি তো আসলে সেই দৃষ্টিটাই ধরতে পারিনি সু; তুমি আমার ইন্স্পিরেশন রাদার বলা ভালো তোমার চোখ বা দৃষ্টি। কিন্তু যেমন গভীর দৃষ্টি তোমার, আমার সৃষ্টির একজনেরও সেই দৃষ্টি আমি দিতে পারলাম কই?" বাকি খাওয়াটা দুজনেই চুপচাপ।

পরের অংশ আগামী সংখ্যায় )