গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০১৪

মৌ দাশগুপ্তা


 মিথ্যে

 আমার বাবার বন্ধু ছিলেন সৌরীন চক্রবর্তী । বয়সে বাবার চেয়ে বড় হলেও এক অজানা কারণে বাবাকে দাদা বলতেন, একদা বাবার অফিসে টেম্পোরারি কাজ করতেন, পরে নিজের বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন। এক পাড়াতেই বাস। প্রায় রোজ  আমাদের বাড়িতে আসতেন । আমরা জানতাম তিনি অনর্গল মিথ্যে বলে যেতেন, তবে ওনার বিশেষত্ব ছিল নিজের বাড়ির লোকেদের নামে বলতেন আর তাদের কল্পিত গুণাবলীই পেশ করতেন। ।

বাবা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হ'লেও আমার নরম মনের মা বলতেন, “আহা, মানুষটা বড়ো দুখী রে, কারো নিন্দেমন্দ তো করেনা, নির্দোষ মিথ্যে বলে, তাতে যদি ও শান্তি পায় তো পাক না”, বলে আমাদের সামলেদিতেন 

            কাকিমা মারা গেছিলেন যখন তখন ওনাদের তিনছেলেই খুব ছোট। তাদের নিয়েই বাড়াবাড়ি রকমের মিথ্যে বলতেন কাকু। ওনার বড়ছেলে ভানুদা তখন সদ্য চাকরী পেয়েছে,নিকলসন এন্ড জনসন কোম্পানীর জুনিয়ার ক্লার্ক, কিন্তু মাইনেটা ভারতের রাষ্ট্রপতির থেকেও বেশী। আর টাইপিংর যা স্পিড না ভানুদার, ফ্যানের ব্লেডও লজ্জা পাবে। আমরা মজা পেতাম। আমার দাদাভাই ক্লাশে র্ফাস্ট হয়ে প্রোমোশন পেয়েছে শুনে উনি নিজের ছোটছেলে, পানুদার যে মার্কস বললেন তা যোগ করলে পরীক্ষার টোটাল মার্কস থেকে বেশী হয়। পানুদা দাদার সাথেই পড়ত। দাদা মুচকি হেসে সরে গেল। ওনার মেজছেলে কানুদা কলেজ কম্পিটিশনে দৌড়ে সেকেন্ড হওয়ায় যে টাইমিং শুনলাম তা শুনে মিলখা সিংএরও হিংসা হবার কথা। আর প্রশংসা করতে করতে লোকে কে কি বলেছে শুনতে শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা। মা খুব খুশী হয়ে গরম গরম লুচি ভেজে দিলেন কাকুকে । কাকু খেতে খেতে বললেন আমাদের অকালপ্রয়াতা কাকিমার হতের ঘরে বানানো গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি খেলে আমার মা লুচি বানাতেই নাকি লজ্জা পেতেন। কাকুর ছেলেরা কাকুর এই  প্রয়োজনহীন মিথ্যে বলা স্বভাবের কারণে প্রথমে লজ্জা পেতো, পরে বিরক্ত হত, ঘরে নাকি খুব রাগারাগি অশান্তিও করতো কাকুর সাথে। আমরাও বড় হতে কাকুকে এড়িয়েই যেতাম। উনি আসতেন, বাবার সাথে গল্প করতেন, মা রোজই কাকুকে সন্ধ্যার জলখাবারটা খাইয়েই বাড়ী পাঠাতেন। কাকু থাকাকালীন আমরা দরকার পড়লেও বাইরের ঘরে যেতাম না। আমি কলেজে ভরতি হবার পরই শুনলাম ভানুদার বিয়ে। মেয়ের বাবা নাকি বিশাল বড়লোক। ঐ টাটা বিড়লা গোছের। মেয়ের গুণ শুনে মনে হল বুঝিবা কল্পকথার রাজকন্যা হবে কেউ। বাবা খুব খুশী হলেন, মাও খুব আনন্দিত । ঘরে মিষ্টি ছিল । প্লেট ভ'রে কাকুকে খাওয়ালেন। বিয়ের দিন দেখি কনে তো আমার মাসতুত দিদির বান্ধবী সুধাদি। ওর বাবার মেন রোডে কাপড়ের দোকান আছে। কালো বেঁটে বলে বিয়ে হচ্ছিলনা সুধাদির। শুনলাম মোটা বরপণ দিয়ে বিয়ে হয়ছে। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন।

            পড়াশুনোর পর্ব মিটিয়ে চাকরী নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে গেছিলাম, মা মারা যাবার পরে বিয়েও করি প্রবাসী পরিবারে। ফলে বাড়ীর সাথে যোগাযোগটা ঐ মেল, সেলফোন আর অবরে-সবরে চিঠিতেই যা টিঁকে ছিল। বাবার শেষ খবর পেয়ে যখন বাড়ী গেলাম তখন  চিরপরিচিত পাড়াটাই কেমন অচেনা লাগছিল। বাবার কাজের দিন সন্ধ্যাবেলায় বাবা-মায়ের মালা-চন্দন পড়ানো যুগল বড় ফটোটার সামনে ধূপ প্রদীপ জ্বালিয়ে দরজা ভেজিয়ে রেখে বেরিয়ে আসছি দেখি মেন দরজার পাশে অন্ধকারে মিশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীভরতি লোকজন। এদিকটায় বিশেষ কেউ নেই। ভিখারী না চোরছ্যাঁচর কে জানে। জিজ্ঞাসা করলাম,
কে, কে ওখানে?
আমি
আমিটা কে?
দেবু আছে বাড়ীতে?
দাদাভাই প্যান্ডেলে আছে, ওখানে যান। বাড়ীতে নেই।
মিষ্টি এলি মা ? সেই তো এলি, এত দেরীতে ?
কে আপনি ? আরে সৌরীন কাকু, এ কি চেহারা হয়েছে আপনার ? আসুন, আসু্ন‌ ভেতরে আসুন।

         বৌদির কাছে শুনলাম, তিনছেলের বিয়ের পর পালা করে এক এক ছেলের কাছে দুমাস করে থাকতেন কাকু, এক বউয়ের কাছে থাকার সময়ে অন্য দুই ছেলের বউয়ের এত ফলাও করে প্রশংসা করতেন, তারা কিভাবে ওনার খেয়াল রাখে, আদর যত্ন করে, এসব ঢালাও ব্যাখা করতেন যে শ্রোত্রীর ধৈর্যের বাঁধ থাকত না। সুতরাং কোন ছেলের সংসারেই আর ঠাঁই হয়নি কাকুর। সারাদিন পুরোনো বইয়ের দোকানেই বসে থাকেন, সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে ফেরার সময় নিয়ম করে বাবার কাছে এসে বসে থাকতেন, এখন তো সেটাও বন্ধ।

বাবার বাৎসরিকের সময় গিয়ে শুনলাম সৌরীনকাকু আর নেই। বন্ধঘরেই মরে পড়েছিলেন। কেউ জানতেই পারেনি, পচাগন্ধ বার হতে আশেপাশের লোক দরজা ভেঙে বডি বার করে। বাবার বাৎসরিকের পরদিনই কাকুর কাজ ছিল, ভানুদা কানুদা পানুদা একযোগে আমাদের বাড়ী এসেছিল নিমন্ত্রণ করতে। জীবনে প্রথমবার চর্তুমুখে বাবার প্রশংসা করল ছেলেরা । খালি কাকু নিজের কানে সেটা শুনে যেতে পারলেন না, এই যা।