গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০১৪

শৌনক দত্ত


আবছায়া


করুণা করছ ? মা হতে পারছি না তাই চাকরি করতে বলছো ? এরপর আর কী বলা চলে ? বিয়ের পর দরথী যখনই চাকরির চেষ্টা করেছে তাকে নিরুত্‍সাহিত করেছি তাকে বোঝাতে চেয়েছি চাকরির দরকার নেই আমাদের সংসারে তাছাড়া এটাও বুঝিয়েছি স্বামী স্ত্রী দুজনেই যদি চাকরি করে সেই সংসারের বাচ্চাদের অবস্থা হয় অনেকটা অনাথের মতো ঠিকঠাক মানুষ হয়ে উঠতে পারে না তারা।প্রথমে কয়েকদিন জোর জার করে চাকরির চেষ্টা বাদ দেয় দরথী।সংসার মেইনটেইন,কম্পিউটার ক্লাস,শপিং,আমার কাকাতো বোনদের পড়ানো,সুইমিং,গানের ক্লাস করেই দিন কাটে ওর।তবে এখন মনে হয় তখন দরথীর চাকরি করাই ঠিক ছিল।এই কর্মহীন জীবনের ভার ওর বোধহয় দুরূহ হয়ে পড়ছে

কাকা কাকীর মৃত্যুর পর আমার কাকাতো বোন দুটো আমাদের সাথেই থাকে ওদের স্কুল ঠিক করা,ড্রেস কেনা,টিচার ঠিক করা সব কিছুই দরথী একলা হাতে সামলায় এমন কি বাজারটাও আমিও বিয়ের এই কয় বছরে যেন ঠুঁটো জগন্নাথ . দরথী গ্লাসে জল ভরে না দিলে খেতে পারি না দরথী মা হতে পারছেনা,নাকি আমি বাবা হতে পারছি না এ ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত না আমাদের সমস্যা নিয়ে দরথীই ডাক্তারদের সাথে কথা বলে,কনসালট্যান্টদের সঙ্গে দেখা করে।ডাক্তার নিজে দেখায়,আমাকে দেখায়।রক্ত পরীক্ষা করে এমন কি স্পার্ম পর্যন্ত।আমি শুধু ওর কথা মত ডাক্তারের কাছে যাই আর ডাক্তারের কথা মত যা দরকার দিয়ে আসি

অফিস থেকে ফিরে একটা বই নিয়ে বসেছি দরথী কাকাতো বোনদের খাওয়া শোয়ার পাট চুকিয়ে ঘরে ঢোকে,আমার পাশে বসে বলে,'আমি মা হতে পারবো না তুমি চাইলে আরেকটা বিয়ে করতে পার আমার কোন আপত্তি থাকবে না 'এই প্রথম আমার মনে হলো দরথী মিথ্যা বলছে ওর মত মেয়ে মা হতে পারবে না ওর অসুবিধা আছে এ হতেই পারে না আমি অবিশ্বাসের কথা বলি না, বই থেকে মুখ তুলে শুধু বলি, না হলে নাই,আমি বাচ্চা ছাড়াই তোমাকে দীর্ঘ বছর ভালবেসেছি,বিয়ে করেছি,যদি ভাগ্যে থাকে হবে, না হলে নাই দরথী একটু উঁচু গলায় বলে ওঠে,'শুধু আবেগ দিয়ে জীবন চলে না,কিছু দিন পরে তোমার কিন্তু অনুতাপ হবে ' এইসময় কথার পিঠে কথা জুড়লে কথা বাড়বে তাই চুপচাপ বইয়ের পাতায় মন দিলাম দরথী একগাদা ফাইল এনে রাখলো আমার সামনে 'আমার কথা বিশ্বাস না হয় রিপোর্টফাইল পড়ে দেখো 'দরথী ভাল করে জানে আমি এগুলো কখনোই দেখবো না।এটা আমার ডিপার্মেন্ট নয়।অফিসিয়াল কাগজ, স্যালারী,বোনাস,ইনক্রিমেন্ট ছাড়া আমি কিছু দেখিনা এমন কি খবরের কাগজ ও নয় ব্যাংকের হিসাব নিকাষ ও দরথীই দেখে আমাকে বিকারহীন দেখে ও নীরব হয়ে যায় ফাইলপত্র নিয়ে উঠে গিয়ে ওর ব্যক্তিগত আলমারীতে রেখে তালা দিয়ে দেয় ওর চাবি দেয়া দেখে মনে হলো এ বাড়ীর কোন চাবির খবরই আমি রাখিনা

একদিন খেয়াল হলো রজত আমাদের বাসায় কাকাতো বোন দুটো কে পড়াতে আসছে না রজত দরথীর পাশের বাড়ীর ছেলে এখানে থেকে ভার্সিটিতে পড়ে আর পড়ার খরচ চালাতে কষ্ট হচ্ছিলো বলে দরথী আমাদের বাসা সহ আরো কয়েকটা টিউশন জোগাড় করে দিয়েছিলো রাতে অফিস থেকে ফিরে চা খেতে খেতে দরথীকে রজতের কথা বলতেই দরথীর মুখ যেন একটু লাল হয়ে ওঠে,'রজত অনেক দূরে একটা ভাল টিউশনি পেয়েছে বেতন ও অনেক তাই ওর বদলে রাজশ্রীদের ওদের স্কুলের এক টিচারকে ঠিক করেছি উনি সন্ধ্যায় আসেন খুব ব্রিলিয়ান্ট টিচার 'কথা শেষ করেই দরথী কিচেন এ ঢুকে যায় আমার মাথায় কি একটা নড়ে ওঠে রাজশ্রীদের টিচার নিয়ে আমি খুব একটা আগ্রহী নই,উদ্বিগ্ন ও না তবে রজতের এই হঠাত্‍ টিউশন ছেড়ে যাওয়াটা আমাকে কেন যেন বিদ্ধ করছে এতবছরের প্রেম ও সংসারজীবনে এই প্রথম আমি বেডরুমে ঢুকে দরথীর সেল ফোন থেকে রজতের নাম্বারটা চুরি করি অন্য একটা সিম থেকে কল করে যখন এ কথা সে কথার পর জানতে পারি রজত দূরে কোথাও টিউশন করে না। বরং দুটো মেয়েকে পড়াতো সেই টিউশনিটা ছাড়িয়ে দেবার পর সে একটা টিউশন খুঁজচ্ছে কথা আর বাড়াতে পারিনি।লাইনটা কেটে দিয়ে সিমটা খুলে ফেলি অনুবাদ অযোগ্য একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ভেঙে আসে।

আমার মন থেকে স্বস্তি পালিয়ে যায়।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি গোলমালটা কোথায়?আট বছরের প্রেমিকা আর ছয় বছরের প্রেমময়ী স্ত্রী মিথ্যার আশ্রয় নিলো কেন? নিজের অস্বস্তির মধেই একদিন বাড়ী ফিরে দেখি দরথীর সব ভাইবোন স্বামী স্ত্রী সন্তান সহ বাসা মাথায় তুলে রেখেছে খুব হৈ হল্লা হলো রাত ১টা পর্যন্ত।সবাই চলে গেলে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না দরথী কে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,'আজকের এই গেটটুগেদারের কারণটা কি আমি জানতে পারি ?' দরথী তেমনই সরল গলায় বললো ভাইবোনের গেট-টুগেদার করতে আবার কারণ লাগে নাকি স্মার্ট উত্তর দিয়ে দরথী কিচেন এ চলে গেলো ব্যালকনি তে এসে দাঁড়িয়েছি ব্যালকনিটা দরথী বেশ সযত্নে সাজিয়েছে বনসাই আর একুরিয়ামে সজ্জিত ব্যালকনিতে বসার ব্যবস্থাও আছে।ব্যালকনি থেকে দক্ষিণের আকাশ এত ভাল দেখা যায় জানতাম ই না।একুরিয়ামের উপর ঘনিষ্ট এক যুগলের এন্টিক শোপিস।আমি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখি একজায়গায় লেখা 'রজত' ! দ্রুত নিজের বেডরুমে ফিরি রাত সোয়া তিনটা নীল আলো জ্বলছে।দরথী ঘুমাচ্ছে মুখে যেন বিষাদ মাথা।আমার বুকের ভেতর অপরাধবোধ বেজে ওঠে।ড্রয়ার হাতরে চাবির গোছা বের করে দরথীর আলমারীর তালা খুলতে চাই যেখানে আমার চোখে চকচকে করে চার পাঁচটা ডাক্তারি ফাইল।আঠারোটা চাবি ঘুরিয়েও আমি আলমারী খুলতে ব্যর্থ হই।আর আমার মন আজ বলছে ওই আলমারীর ভেতরে একটা অন্য সত্য লুকানো আছে যা আমার হাতের নাগালের বাইরেই থেকে যায়।

দুটো সপ্তাহ আমার খুব ব্যস্ততার মাঝে কাটে।অফিসিয়াল একটি কাজে ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে মিটিং করে বেরচ্ছি ব্যাংকের দরজায় আমাদের ডাক্তারের সাথে দেখা 'কংগ্রেট দরথীর তিনমাস চলছে এইসময় মা ও বাচ্চার বিশেষ যত্নের দরকার হয় খেয়াল রাখবেন কিন্তু'ডাক্তার হাসতে হাসতে ব্যাংকের ভেতর ঢুকে যায় আমার চোখের সামনে একটা আলোছায়ার পর্দা দুলে যায়।সহস্র খুশির কণা যেন আমার হাত পা সারা শরীর দিয়ে ফেটে পড়তে চাইছে কিন্তু আমি যেন এখন ও সেই বোধগম্যতা থেকে দূরে অফিসে ফিরে দেখি রজত বসে আছে।কি বলবো বুঝে ওঠার আগেই রজত বেশ কিছু কথা বলে চলে গেলো

ব্যালকনির মত দরথী কে আমি নতুন রূপে আবিষ্কার করি আমি অতিমানব নই তবে কর্মব্যস্ততা অতিমাত্রায় দরথী নির্ভরতায় বিয়ের আগে ও পরে আমি যেভাবে ওকে নতুন নতুন চোখে আবিষ্কার করতাম কিংবা ওর হাসি কান্নার কারণ বুঝে ভাগ করে দিতাম তা ফিকে হয়ে গেছে আমি ওর খুশি,ওর আনন্দ ভাগ করে দেবার প্রাণপণে চেষ্টা করি আর শপথ করি ওর ভালবাসার জন্য ওর অপরাধ যত মর্মান্তিকই হোক আমি মেনে নেবো,শুধরে নেবো

রাতের খাবার পরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছি বনসাই টবের হাসনুহেনা গাছটায় একগোছা ফুল তীব্র সুবাস ছড়াচ্ছে।মা বলতো হাসনুহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে এই ছয়তলার উপরেও সাপ কি উঠে আসতে পারবে ? দরথী পাশে এসে দাঁড়ায় হাতে হাত রাখে নিচু স্বরে বলে'রাজশ্রীদের স্কুল টিচার আজ দেশের বাইরে চলে গেল,খুব ভালো একটা চাকরী পেয়েছে রজতের ঐ টিউশনটা নাকি ছেড়ে দিয়েছে ওকেই আবার রেখে দেবো ভাবছি ' আমি বিস্মিত স্বরে বলি,তাই!দরথী চুপ করে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি একটা এয়ারবাস উড়ে যাচ্ছে।এজন্য অনেক টাকা খরচ করেছি আমি সেদিন অফিসে রজতকে ডেকে না পাঠালে একটা বড় ভুলবোঝাবুঝি থেকে যেতো রজতের প্রতি রাতের খাবার পরে ব্যালকনিতে আমার পাশে ঢুকতে গিয়েই চোখে পড়ে শোপিসটা আর একুরিয়াম ভেঙে পড়ে আছে ও পাগলের মতো চিত্‍কার করে আমার দিকে ফিরে তীব্র কন্ঠে বলে কে ভাঙলো রজতের শোপিস আর রাজশ্রীর টিচারের দেয়া একুরিয়াম ? নিরাসক্ত মুখে মিথ্যা বলি,বাচ্চারা কেউ হয়ত কিংবা বিড়াল ও হতে পারে। দরথী আমার দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে।ও আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করেছে কিনা বুঝতে পারি না