গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৪

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


জেনানা ওয়ার্ডের গল্প

এমনই এক ২৬শে জানুয়ারীর আগে তখন মেয়েদের বিকেলে গান, কবিতা এসব শেখানোর পালা চলছে। গীতি-আলেখ্য হবে। আমরা দিদিমণিরা পাঠ করছি, সঙ্গে গানও। ওরাও কেউ কেউ পাঠ, কেউ গান, কেউ বা আবৃত্তিতে আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করছেন। মূলতঃ ওদের দিয়েই অনুষ্ঠান করানো। সেদিন প্র্যাকটিসের আগে গিয়ে দেখি,একেবারে ঝলমলে জরিওয়ালা সিনথেটিক সালোয়ার-কামিজ পরা দুটি মেয়ে সেখানে বসে আছে। আজই নতুন এসেছে। মনে হল, আমরা পৌঁছবার কিছুক্ষণ আগেই সংশোধনাগারে ঢুকেছে। তখনও উস্কো-খুস্কো চেহারা, চোখমুখ। আমাদের খাতায় সব বিবরণ লিখে রাখতে হয়। ঘরের মধ্যে সকলের কাছে গিয়ে গিয়ে কে, কি, কেন, কোথা থেকে এসব জিজ্ঞেস করি। যারা পুরোন হয়ে গেছেন, নিজেরাই এগিয়ে এসে বলেন, আমাদের পক্ষে অত মনে রাখা সম্ভব নয়। রোজই বাড়া-কমা চলে। যারা নাম সই করতে পারেন বা শিখেছেন, খাতায় নিজেরাই সই করেন। বাকিদের নাম আমরা লিখে রাখি। ওদের কাছাকাছি যেতেই একটা হল্লা-- ওরা বাংলা বোঝে না, হিন্দি কথা বলে। বেশির ভাগই গ্রাম বাংলা থেকে আসা মেয়ে কয়েদী, হিন্দি জানা নেই। জন্মসূত্রে হিন্দি-ভাষী রাজ্যের মানুষ হবার সুবাদে আমার ওপরই ভার পড়ল ওদের সঙ্গে কথা বলার।

নাম কি? বার দুয়েক জিজ্ঞাসার পর উত্তর মিলল। এখানে কি করে এল? কি করে আবার, পুলিশই তো নিয়ে এল। ঠিক কথা ! কোথায় ধরা পড়েছে? ইস্টিশান বাজারের কাছে। ওখানে কি করছিল, কেন ধরা হল? এতক্ষণ মেয়ে দুটির হয়ে উত্তর দিচ্ছিল অন্যরা, যাদের ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে কিছু কিছু কথা। সেই মেয়ে দুটি চুপ। কাছে গিয়ে জানানো হল, বলতে তো হবেই, আমাদের যে লিখে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একটি মেয়ে অতি অকথ্য একটি গালি কারো উদ্দেশে দিয়ে জানাল তাদের ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন? অন্য মেয়েটি চুপ। একটু যেন ভয়ে ভয়ে আছে। যে মেয়েটি উত্তর দিল, তার চোখমুখ রাগে এবং উত্তেজনায় প্রখর হয়ে আছে। ধরা হল কেন? তারা বিহারে মেলায় যাচ্ছিল নাচা-গানা করতে। টিশন (স্টেশন) থেকে নেমে বাইরে আসার সময় ধরা পড়েছে। ইউপি, বিহার এসব জায়গায় মেলায় কি ধরণের নাচাগানা চলে কাগজের মাধ্যমে সকলেরই জানা আছে। সুতরাং, পুলিশের কাছে তেমন খবর থাকলে পুলিশ তো তার কাজ করবেই। ওখানে কি করে যোগাযোগ হল? আবারো একটি অশ্লীল গালি দিয়ে জানাল মেয়েটি, যে নিয়ে গিয়েছিল, সেই নাকি ধরিয়ে দিয়েছে। মনে মনে সেই মেয়েটির তারিফ করলাম। জানি না, মেয়ে দুটি আগেও নাচাগানা করতে গিয়েছিল কিনা, যদি এই প্রথম হয়, ধরিয়ে দিয়ে ভালই হয়েছে। আবার বলি, তার সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ হল? এবার মেয়েটি জানাল, সে তার পিসি হয়। একটা সময় নিজেও নাচাগানা করেছে, বহুত পয়সা করেছে। সুযোগ দিয়েও পুলিশকে ধরিয়ে দিয়েছে...। কথার শেষে তীক্ষ্ণ গালি। বোঝাবার মত করেই তাকে বোঝানো হল, জেলখানায় এসে এভাবে কিন্তু গালিগালাজ করে কথা বলা চলবে না। এমন করলে যদিও বা কম শাস্তি হত, এরপর ছাড়া পাওয়াই মুস্কিল হবে। ভাল হয়ে থাকতে হবে এখানে। এবারে কথা বলছিল যে মেয়েটি, হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল---তার মরদের ওপ্রেশন(অপারেশন) হবে, বাষট হাজার (বাষট্টি হাজার) রুপিয়া লাগবে, কাঁহা মিলবে? মর যায়েগা ওহ...। কি আকুল কান্না মেয়েটির। অবাক হয়ে শুনছি মেয়েটির কাহিনি। এই বেদনা, এই দুঃখ, এই নাটকের মত জীবন...কোনদিনই কি জানতে পারতাম এখানে না এলে, জীবন বড় অদ্ভুত! বিকেলবেলায় সাড়ে তিনটের সময় জেল কর্তৃপক্ষ থেকে একটা বড় কেটলি করে চা আর বিস্কুট দিয়ে যায়, মেয়েরা নিজের গেলাসে করে নিয়ে আসে। সেইদিনও মেয়েরা চা নিয়ে এল। একজন এক গেলাস চা বাড়িয়ে দিল ওদের দিকে। শ্রান্ত, ক্লান্ত সেই মেয়েটি চুমুক দিল চায়ে। চোখ দিয়ে তখনো গড়িয়ে পড়ছে জল। আমরা সেদিন সারাটা সময় চুপ করেই রইলাম। পড়া, রিহার্সাল কিছুই হল না সেদিন, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম।

সংশোধনাগারে মেয়েদের ওয়ার্ডে একদিন বোর্ডে বাংলা বর্ণমালা শেখানোর চেষ্টা চলছে। একটি যুবতী মেয়ে তাই দেখে মুখ টিপে হাসতে শুরু করল। মেয়েটিকে দেখে মনে হল সে লেখাপড়া জানে। বছর ২২/২৪ এর যুবতী। বেশ লম্বা দোহারা চেহারা। পাশে একটি ৩/৪ বছরের মেয়ে বসে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল সে কতদুর লেখাপড়া করেছে। জানাল, এগারো ক্লাস অবধি পড়ার পর তার বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েটি বিবাহিতা! অবাক হলাম। শুধু তাই নয়, পাশে বসা ন্যাড়ামাথা, হলদে রঙ এর ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়েটি তারই মেয়ে। বাড়িতে রাখার কেউ নেই বাচ্চাটিকে, তাই এখানে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। জেলখানা কর্তৃপক্ষের এইরকম নিয়ম আছে। আরো ৩/৪ টি বাচ্চা এখানে থাকে মায়ের সঙ্গে। প্রতিদিন জেলখানায় মেয়েদের ওয়ার্ডে যখন যাই, ওখানে পৌঁছে আমাদের খাতায় মেয়ে কয়েদীদের নাম-ধাম-বৃত্তান্ত সব লিখে রাখতে হয়। কারা কোথা থেকে এসেছেন, কি কারণে, সে সবও লিখতে হয়। কে কতদুর কি শিখল। এমন কি কতজন বাচ্চা আছে, মেল বেবি কতজন, ফিমেল বেবি কতজন, তাও! প্রতি মাসে মাসে আমাদের সেই রিপোর্ট জমা দিতে হয় জেলের ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষেই বাচ্চা মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সে এসেছে। এই বাচ্চা মেয়েটিও তার মায়ের কাছে অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি-ডি, ১-২০ পর্য্যন্ত এরই মধ্যে সব শিখেছে। ভারি ভাল লাগল। অনেক বাচ্চাই এখানে আসে, কিন্তু কেউ কেউ পড়তে চাইলেও মায়েরা সকলে আগ্রহী থাকেন না। আগে একটি বাচ্চাকে তার কাকিমা নিয়ে এসেছিলেন। সেই বাচ্চাটির মাকে ওই ভদ্রমহিলাই পুড়িয়ে মারার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। এখন বাড়িতে আর কেউ না থাকায় মৃত মহিলার সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব তার উপরেই। পড়াশোনা শেখানোর আগ্রহ না থাকলেও বাচ্চাটিকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, তাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব কিছুই করতেন ঠিক ঠিক ভাবেই। অথচ, বাচ্চার মাকে পুড়িয়ে মেরেছেন তিনিই। কত রকমের যে মানুষ, কত রকমের যে চরিত্র, ভাবলে অবাক লাগে !
জেল কর্তৃপক্ষ মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য কিছু বইপত্র, শ্লেট, পেনসিল এসব দিয়েছেন। আমরা ওই যুবতী মেয়েটির উপরই দায়িত্ব দিলাম, যাতে সেই মেয়েদের নিয়ে বাকি সময়ে বসে লেখাপড়া শেখায়। আমরা তো যাই মাত্র দুদিন সপ্তাহে। বাকি দিনগুলো যাতে এই মেয়েটির কাছে পড়তে বসে, তারজন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে এলাম। সেদিন সংশোধনাগার থেকে বাড়ি ফিরবার পথে আমার বান্ধবীদের কাছে শুনলাম যুবতী মেয়েটির কাহিনি। কয়েকদিন ছিলাম না, তাই যেতে পারিনি, সেই সময়েই মেয়েটি এসেছে সংশোধনাগারে স্বামীর খুনের আসামী হয়ে। সঙ্গে মা, মেয়েটিকে খুনের প্ররোচনা ও সাহায্যের জন্য তারও জেল হয়েছে। শেষ পর্য্যন্ত যাবজ্জীবন নাকি ৭ বছরের জেল তা তখনো জানা যায়নি।

পরের দিন যখন ওদের কাছে গেলাম,মেয়েটির মাকে দেখে সত্যি কথা বলতে কি আর যাই হোক একজন অপরাধী বলে মনে হল না। এত মৃদুভাষী একজন মহিলা , যিনি গ্রামের মহিলা হয়েও নবম শ্রেণী পর্য্যন্ত পড়াশোনা করেছেন, ভদ্র ব্যবহার, যতক্ষণ ওখানে ছিলাম, একবারের জন্য কোন রকম চাঞ্চল্য দেখিনি তার ব্যবহারে। তিনি এই ধরণের জঘন্য অপরাধ করলেন কি করে বুঝতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে কি, একই মানুষের কাজে ও ব্যবহারের মধ্যে এত ফারাক যে ভাবতেই খারাপ লাগছিল। মানুষের মনের মধ্যে কখন যে কোন চিন্তা বাসা বাঁধে, কে জানে !