গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০১৪

প্রীতীশ বল

অনু-আখ্যান : বিজয়

ছেলেটির বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে স্কুলে যাবে। এজন্য হাতে খড়ির অনুষ্ঠান। পুরুত মশায় অনেকক্ষণ ধরে বৈদিক শ্লোক উচ্চারণ করছেন। ছেলেটি এর কোনোটারই অর্থ জানে না। জানে না এতে তার কী উপকার হবে। পেটের ভেতর চোঁ চোঁ করছে। যতক্ষণ পূজো শেষ হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু খাওয়া যাবে না। খেলেই সব পড়া লেখা ভুলে যাবে। এক সময় পূজো শেষ হয়। পুরুত মশায় একটা পিঁড়িতে চাউলের গুড়ো নিয়ে তারপর ছেলেটির হাতে একটা কঞ্চি ধরিয়ে অ, আ লিখালেন। পুরুত মশায় জানেন না, বর্ণক্রমিক পদ্ধতি, শব্দক্রমিক বা বাক্যক্রমিক পদ্ধতির মানে কী? পাঠশালায় পুরুত মশায় যেমনটি শিখেছেন, ঠিক সেভাবে ছেলেটিকে শিখালেন। ছেলেবেলায় পড়া রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা এখনও চোখ বুজে মুখস্থ বলতে পারেন। পূজো করতে ঐটুকু হলে চলে।

ছেলেটি স্কুলে যায়। কাছেই স্কুল। বাড়ির পেছনে পুকুরের উত্তর কোণে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরিয়ে ছেলেটিকে তার মা প্রতিদিন রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ছেলেটি স্কুলের বারান্দায় না উঠা পর্যন্ত মা বাঁশঝাড়ের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে। স্কুল ছুটির সময় হলে ওখানেই মা আবার এসে দাঁড়ায়। ছেলেটির একদিন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়। ভর্তি হয় হাই স্কুলে।
এদিন বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। বড়দা নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। এরপর থেকে ছেলেটি একা একা স্কুলে যাওয়া আসা করে। একদিন ছেলেটি স্কুল ফাইনাল পাশ করে। কলেজে ভর্তি হতে যায় একা। আবার অনেক অপরিচিত মুখ। সবার সঙ্গে ভাব করার খুব ইচ্ছে। হয় না। মুখচোরা স্বভাবের ছেলেটি। কেউ নিজে থেকে এগিয়ে না আসলে ফিরেও তাকায় না।
কার এত ঠেকা?

         হ্যাঁ, একজনের আছে। মেয়েটি স্কুল ফাইনাল পাশ করত না যদি ছেলেটির নোট না পেত। এই কৃতজ্ঞতাটুকু মেয়েটি প্রকাশ করতে চায়। সুযোগ পায় না বলার।
ছেলেটি ক্লাসে যায় ঠিক স্যার ঢোকার সময়। আবার ক্লাস শেষ হলে স্যারের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তারপর কলেজ গেইট কিংবা ক্যন্টিনের গুলতানিতে দেখা যায় না। বিকেলে কলেজ মাঠে ঘাসের উপর বসে না।

         সব জেনে শুনেই মেয়েটি খুঁজে পেতে চায় ছেলেটিকে। বের করে নিয়ে আসতে চায় খোলসের ভেতর থেকে। নতুন করে তৈরি করতে চায় তার মুখ। ভাঙ্গা-চোরা মুখ নয়। তরুণ, কোমল, স্মিত, সবচেয়ে উদ্দীপনাময় মুখ। মুখটি দুহাতের মধ্যে নিয়ে মেয়েটি বলবে, এতদিন পালিয়ে ছিলে কেন? কেন তুমি এরকম হয়ে আছ? মেয়েটি খোলা বইয়ের মতো নিজেকে মেলে ধরতে চায় ওর কাছে। যার এক পাতায় সমুদ্দর বইছে। আরেক পাতায় দুলছে অরণ্য। এ পাতায় রোদ্দুর। অন্য পাতায় বৃষ্টি। মেয়েটি বলবে, তোমার আর কত পড়া বাকি আছে? চলো এবার আমরা এক সঙ্গে পড়ি। ছেলেটির হাত ধরে বেরিয়ে পড়বে।

         ষ্টুডিও থিয়েটারে আজ মেয়েটি গান করবে। ওর আমন্ত্রণে ছেলেটি অনুষ্ঠানে আসে। মেয়েটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে শুরুতে শিল্পের কথা বলে, সুন্দরের বর্ণনা দিয়ে ছেলেটিকে মুগ্ধ করে। তারপর কয়েকখানা গান করে। মঞ্চে যখন মেয়েটি কথা বলছে, গান করছে, তখন মাঝে মাঝে ঘুরে যাচ্ছিল তার মাথা। ঝাঁকুনি লাগচ্ছিল চুলে। কখনো কখনো সামান্য বেঁকে যাচ্ছিল ঠোঁট।

         ছেলেটি যুগপৎ মুগ্ধ আর স্তব্ধবাক হয়ে দেখছে মেয়েটির রূপ আর প্রতিভা। মেয়েটির চোখে মুখে ছেলেটি ভিন্ন এক অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। মনে হতে থাকে মেয়েটি কোথায় বুঝি নিজেকে অসহায় ভাবছে। খুঁজে ফিরছে এতটুকু আশ্রয়। এক সময় ছেলেটি নিজেকে আবিষ্কার করে মেয়েটির পাশে। ভাবনার ঘোরের ভেতর কখন এসে মেয়েটি ছেলেটির পাশের চেয়ারে বসে তা বুঝতে পারেনি। মেয়েটির এভাবে বসাটা ছেলেটির পছন্দ হলো না। ছেলেটি ত্রাতা হতে ইচ্ছুক না।
এক সময় শেষ হয় অনুষ্ঠান। সুরের রেশ ছড়িয়ে আছে তখনও অডিটোরিয়াম জুড়ে। মেয়েটি জানতে চাইল, কেমন লাগল?
তারপর সমস্ত অডিটোরিয়ামে নেমে এসেছে নীরবতা।
ছেলেটি কোনো মতে বলল, অসাধারণ। রবীন্দ্রসংগীত তো আমার চিরকালের ভালোবাসার সাথী। আমি মুগ্ধ।

মেয়েটি আরও একবার ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বিজয়ীর হাসি হাসে। হাসিটি সত্যি তুলনাহীন।
ছেলেটি সেদিন বাড়ি ফিরে গেছে মেয়েটির পাশে বসে। যাওয়ার সময় রিকশায় সারাক্ষণ গুণ গুণ করে খানিকক্ষণ আগে মেয়েটির কন্ঠে শোনা গান-
ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবে কে আমারে। ও বন্ধু আমার।