রানির মায়ের বস্তিতে
এই ঘরটায় কোন বিলাসের নামগন্ধ নেই, ঘর বলতে চারটে দেয়াল, একটা জানালা, নাহ ওটা ঘুলঘুলি বললে মানায় । এই ঘরটায় তিনটে মানুষ কোনরকমে দিনগুলি পার করে এবং রাতগুলিও । বাবা মায়ের মাঝখানে ঘুমানো শিশুটি অত কিছু বুঝতে পারে না কিন্তু এই দমবন্ধ পরিবেশটায় সে কুঁকড়ে থাকে । ঐ পাশের বস্তির চাল তাদের ঘরটার সাথে লাগোয়া, ওখানে একটা কালো বেড়াল বসে, শিশুটির ভয় লাগে । সে মাকে প্রায়ই বলে, 'মা, বাসায় চলো,বাসায়…?' মা তাকে স্বান্তনা দেয়, যদিও তার জানা আছে এটা প্রত্যাশার বাইরের একটা স্বপ্ন । মা প্রায় রাতেই ঘুমাতে পারে না, অসহ্য গরম, বাইরের হাওয়াপথ রুদ্ধ, পুরোনো ফ্যানটা প্রায়শই ক্যাঁচক্যাঁচ করে প্রতিবাদ জানায়, প্রায় সারারাত তাকে হাতপাখা নাড়তে হয় ।
বস্তিমালিকের ঘরের ভাড়াটিয়া তারা। মালিক খুব গর্বিত তার এই দোতলা নিয়ে, যদিও এই বিল্ডিংয়ের নমুনা বুঝতে আলাদা চোখের দরকার পড়ে না । ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চারটা রুমে তিনজন ভাড়াটিয়া, তারা পরিবার নিয়ে থাকে আর দুইঘর মেস । একটাতে বাড়িওয়ালা থাকে তার তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে নিয়ে । কিভাবে থাকে তা ঈশ্বর জানেন । একটা কলঘর আর দুটো চুলা, বড্ড কারসাজি করে রান্না, নাওয়া, ধোয়ার মত কাজগুলি করতে হয় । বাড়িওয়ালা মেপে পানি ছাড়ে, সেও এক অশান্তি । ঐ খোঁয়ারের মত রুমে দুটো বড় বালতিতে পানি ভরে রাখে তারা । শিশুটির মা কে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে কাজ গোছাতে হয় । প্রায় নির্ঘুম একেকটা রাত পার করার পর, সুর্য জাগার আগে জেগে বসে থাকতে খুব কষ্ট হয় তার । কিন্ত কখন চুলা খালি পাবে, বাচ্চা আর তার বাবা অভুক্ত থাকবে ততক্ষণ, ভাবলে তার শরীর শিউরে ওঠে । বাসি কাপড় ধুয়ে ছড়াতে হবে, সকালে স্নান সেরে নেয় সে, খালি হয়ে থাকা বালতিগুলি ভরে রাখে ।
সকাল আর দুপুরের রান্নাটা একসাথেই হয় । সব গুছিয়ে নিজেদের কামরায় নিয়ে রাখে মা, এমনকি তাদের মশলা পাতি, সবজির ডালা, বটি - খুন্তি সবই নিজেদের রুমে নিয়ে রাখতে হয় । বড্ড চোর এখানে! কোন ফাঁকে কিসব সরিয়ে ফেলে ধারণা করা দুঃসাধ্য । প্রথম প্রথম মা বুঝতে পারেনি, অনেক জিনিস নিয়মিত উধাও হয়ে যেতে থাকলো । কাউকে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর মেলে না, সবাই সাধু- সজ্জন, আশ্চর্য নির্লিপ্ত! তারপর কায়দাটা শিখে গেলো সে । আসলে এসব তো তার জানার কথাও ছিলো না, এইরকম জীবন কখনো সে দেখেনি কোনদিন, দেখতে হবে তাও জানা ছিলো না । একটু পরেই ইয়াজুজ মাজুজের দল জেগে উঠবে, তার আগে কাপড়গুলো মেলতে অসমাপ্ত ও বিপদজনক তিনতলায় উঠে আসে সে ।
সকালের খাবার খেয়েই শিশুটির বাবা কাজে বেরিয়ে পড়ে, তাকে দুপুরের খাবার দিয়ে দিতে হয়, সে একটা গার্মেন্টসে চাকরী করে । এখন মা ও শিশুটি একা, তাদের ঘরের দরজা বন্ধ, বাইরে হুল্লোড়ে বেলা শুরু হয়েছে । এখন মা একটু তণ্দ্রায় পড়বে, শিশুটি টিভি দেখবে । হ্যাঁ বিনোদনের এই একমাত্র ব্যাবস্থা তাদের । তার বয়স তিন, স্কুলে যাবার সময় হয়নি । বড়লোকের ছেলেমেয়েরা অবশ্য এই বয়সে স্কুলে যায় কিন্তু ওরা তো বড়লোক নয়, খুব হতভাগ্য শ্রেণির গরীব । একজন ভিক্ষুক অভাবতাড়িত হলে কারো কাছে হাত পাততে পারে, ওরা সেটাও পারে না । এটা সম্ভব নয় কারণ ওরা উচ্চ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা মানুষ । চারটে মাস আগেও তার জানা ছিলো না একদিন এইরকম একটা বস্তি তাদের আবাস হবে, এইরকম একারণে বলছি, সে একসময় দেখেছে এইরকমের গৃহবিন্যাস থেকে বুয়া আসতো তাদের বাসায় কাজ করতে ।
শিশুটি যে পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছিলো সেখান থেকে আকস্মিক বিচ্যুতি তার শরীর ও মনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে । একঝাক অবিরাম খিস্তি প্রিয় মানুষ, তাদের অশালীন আচরণ কিংবা বস্তির ছেলেমেয়েগুলো যারা খুব দ্রুত বাড়ে এবং সময়ের আগে বাড়াবাড়ি ধরনের পরিপক্ক হয়ে ওঠে, তাদের সঙ্গ শিশুটিকে ভয়ার্ত করে তোলে । মা ও এদের সঙ্গে মেশে না, এর পেছনে কোন শুচিতা নেই, এদের মানসিক গঠনের সঙ্গে তার খাপ খায় না । বাইরের লোকেরা তাকে অহংকারী ভাবে আদপে যা সে নয় । পচা গরম, একমাত্র দরজাটা আজ তারা খুলে রেখেছে । বালি সুরকির সিঁড়িঘরের প্যাসেজ দিয়ে ভারী মিস্টি একটা বাতাস আসছে ।
ঘুরে ফিরে মনের উঠোনে
মায়ের ভাবনা বাড়ছে, শীত আসন্ন অথচ গরম কাপড় বলতে তেমন কিছু নেই । দুটো কাঁথা আছে, লেপ কম্বলের বালাই নেই । সে বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে কি সামাল দেবে? সংসারের ব্যায়, বাসা ভাড়া, বাচ্চার দুধের খরচ, নাভিশ্বাস উঠে যায় । একবার ভাবে বাবার বাড়ি চলে যাই, পরক্ষণেই আত্ম সম্মানের লড়াই । সে তো সজ্ঞানেই স্বামীর সঙ্গে এসেছে, সেই ঝোড়ো দিনগুলিতে তার ভাইয়েরা বারবার এসেছে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, বাবা দুইবার লোক পাঠিয়েছে তবু সে যায়নি । সেই রাত্রি শুরু হওয়ার আগে যে দিন ছিলো, যখন শেয়ার বাজার থেকে মোটা অংকের টাকা আসতো আর ব্যাক্তিগত কোচিং হোমে ছয়টা দিন গমগম করতো ছাত্র ছাত্রীতে! তাদের পাঁচ রুমের বাসাটার দুটো কামরা সাজানো ছিলো টেবিল, বেঞ্চি, বই, অ্যাক্রিলিক পেন, বোর্ড এইসবে । এমনকি দুটো কম্পিউটার বরাদ্দ ছিলো পড়ুয়াদের জন্য ।
সেইসবই এখন ঘোরকাল, বর্তমানটাই বাস্তব । একমাত্র সম্বল এই বিয়ের আঙটি টা নাড়াচাড়া করছিলো মা । ছোট্ট একটা মুক্তো বসানো সাদামাটা এই আঙটি টা তার শ্বাশুড়ি তাকে দিয়ে বলেছিলো, 'কখনো খুলো না, আমার শ্বাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন, আমি তোমাকে দিলাম ।' এসবই এখন ইতিহাস, মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে । এখন কেউ তাদের কোন খবর নেয় না । যে হঠাৎ পতন তাদের জীবনে নেমে এসেছিলো, সেজন্য তাকেই দায়ী করেছিলো সবাই । কেউ শুনতেও চায়নি স্বামীর অসংলগ্ন - উচ্ছৃংখল কিংবা স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা জীবনের ওপর তার কোন হাত ছিলো না, বরং সবকিছু যখন ঘটছিলো কু সৃষ্টির নিয়মে, তখন তাদের দাম্পত্য জীবনেও নেমেছিলো বিপর্যস্ত টানাপোড়েন । অনুনয় থেকে কলহ কি হয়নি! কিন্তু স্বামীর বিত্তবিলাসের ঘোর সে কাটাতে পারে নি । এমনকি সেইসব পরিজনেরা, যারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের বাসায় পড়ে থাকতো দিনের পর দিন, যাদের সম্মানে তিন বেলা রসুইঘর সরগরম থাকতো ,তারা কি সেসব দেখেও না দেখার ভাণ করেনি?
আনন্দের দিনগুলি তারা আনন্দের সাথেই উপভোগ করে গেছে । স্বার্থের কাছে বিবেকের এই ঘৃণ্য পরাজয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো তরুণী মা । সে বাবার বাড়ী যেতে পারতো অনায়াসে, সেখানকার মানুষগুলি কি ফেরেশতা? সে জানে, তারা ওকে খেতে পরতে দিতো, শিশুটিকেও, থাকার জায়গা মিলতো, বিনিময়ে ঘরের দুজন কাজের মানুষকে বিদেয় করে দেয়া হতো । সে এসব দেখেছে, যখন একটা ক্রান্তিকাল আসছিলো, তখন স্বজনদের বদলে যাওয়া চোখের রঙ তাকে এক অনিশ্চিত শুন্যতার মাঝে ফেলে দিয়েছিলো, পৃথিবী তখন এক কালো গহ্বর, একজন মা আর একটি অনাদৃত শিশু । অথচ তাদের সাংঘাতিক কদর ছিলো বটে, এই যখন দুহাত ভরে বারোয়ারী উপহার নিয়ে যেতো তারা, বাজারে নতুন আসা পোষাকটা নিয়ে গল্প করতো কিংবা ভাতিজার জন্মদিনে শংকর জহুরির দোকান থেকে কিনে দিতো সোনার চেইন!
পাশের ঘরে তুলকালাম হচ্ছে । বাড়িওয়ালা নেশা করে এসে বেধড়ক পেটাচ্ছে বৌ কে । ছেলেমেয়েগুলি বিকট চিৎকার জুড়ে দিয়েছে । বদ্ধ কামরায় বসেই মা বুঝতে পারে, সারা বস্তি জমায়েত হয়েছে এখানে । প্রথমদিকে সেও একদিন বের হয়েছিলো । প্রায় উপুড় হয়ে পড়েছিলো রানির মা আর একটা কাঠের খুন্তি দিয়ে তাকে পেটাচ্ছে তার স্বামী । ছেলেমেয়েগুলি একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চেল্লাচ্ছে, নয়তো ওদের শরীরেও দু’ঘা পড়তে পারে । ঠিক কিছু সময়ের মধ্যেই জড় হওয়া মানুষগুলি বাড়িওয়ালাকে টেনে সরিয়ে নেয়, রানির মা কেও সরিয়ে আনে আরেকদিকে । এসব দেখে শিশুটি চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয় । এরপর মা কখনো দরজা খোলে না এসব সময়ে । বিশেষ করে এই ব্যাপারটা যখন রোজই ঘটছে । এসবে ওরা অভ্যস্ত বরং এই মারপিট কোন একদিন না হলেই কেন জানি সবাই বিমর্ষ হয়ে পড়ে এবং বস্তির সামনের সরু গলিটায় বসে সবাই আলাপ আলোচনা করতে থাকে । এই সময়গুলিতে স্বামী বাসায় না থাকলে সে খুব ভয় পায়, বিশেষ করে যখন তার স্বামীর নাইট ডিউটি থাকে! তার দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ হয়, সে মোটা একটা ডাসা হাতে নিয়ে বসে থাকে ।
কিন্তু শীত আসছে! এই ভাবনাটা তাকে কুড়ে খাচ্ছে, সেই দুপুরে যখন বস্তির দুটো কলঘরে স্খলিত বসন নারী পুরুষেরা প্রতিযোগিতা করছে, কে কার আগে স্নান সারবে, কেউ লড়ছে, কেউ সখি সখি ভাব নিয়ে গল্পে মশগুল কিংবা একটু আড়ালে যে তরুণীটি কিসব বলতে বলতে মধ্যবয়সি নানার গায়ে লুটিয়ে পড়লো আহ্লাদি বেড়ালের মত, সেসব নিজের অজান্তেই দেখতে দেখতে সে রানির মায়ের খোঁজ করতে লাগলো । বাড়িউলি ব্যাস্ত মানুষ, সারাক্ষণ কারো না কারো সমস্যার সমাধান তাকে করতে হয় । আজ সে মা ও শিশুটির কামরায় এসেছে । বাবাহ রনধনুর মায় তো দেহি ঘরডারে এক্কের ছাফা কইরা রাখছেন! এল্লিগা কেউরে ঢুকবার দেন না? শিশুটির নাম রঙধনু। মা ক্লিষ্ট হাসে, তার উদ্দেশ্য আঙটিটা বিক্রী করা । একারনেই রানির মাকে ডেকে আনা ।
-এই সোনা বেচবেন কেরে?
-দুইটা লেপ কিনবো ।
-বেইচ্যেন না, আমার কাছ থে টেকা লন । মা চমকে ওঠে, সে কি আপনার কাছ থেকে টাকা নেব কেন! 'তয় কি হইছে? মাসে মাসে অল্প কইরা আমারে আবার দিয়া দিবেন ।' হ্যাঁ, এটা হতে পারে, মা ভাবে । তার চোখ জলে ডুবে যায়, সেদিকে রানির মা একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে । সম্ভবত সে এই প্রথম অনুধাবন করতে শুরু করে, একটা নির্মম অনর্থ এই ভদ্রলোকের বেটিরে এইখানে এনে ফেলেছে । কাইন্দেন না, রানির মা বলে উঠে । কাইল ধুনকর ডাইক্কা আমি আপনেরে ল্যাপ বানাইয়া দিয়াম । এসব গল্প ঈশ্বর তার কোন ভবিষ্য খাতায় লিপিবদ্ধ রেখেছিলেন জানি না, এটুকু জানি সেইদিন পুঁথিগত বিদ্যা বহির্ভূত নারীটির সাথে কোন কাজে না লাগা শিক্ষিত মায়ের সাথে এক অসম সখ্যতা গড়ে ওঠে ।
রানির বিয়ে এবং অন্যান্য
সেবার হঠাৎ পানির কষ্ট, স্থানীয় পাম্প নষ্ট হয়ে আছে । সেসব সরকারী দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপার । বস্তির মানুষগুলো এসব বোঝে , বোঝে রঙধনুর মা ও । সমাধান অন্য, নিচের চাপকল থেকে পানি টেনে আনা। তীব্র কষ্টকর এক অভিবাসন, তাই তো! সে অভিবাসি বটে, তার নিজ দেশে, পরিচিত ভূ খণ্ডে তারা প্রবাসী । মায়ের নিত্য কাজের সাথে যোগ হয়েছে পানি টানা । ভুসভুসে খোয়া বিছানো সিঁড়ি বেয়ে সে বালতিতে করে পানি বয়ে আনে । তার একটা হাত সক্ষম অন্য হাতটা আঁকড়ে থাকে শিশুটিকে । না, রঙধনু মায়ের হাত ধরে মসৃণভাবে হাঁটতে পারে না, পথগুলো যে ছালবাকল ছাড়ানো! এইতো কাঁখে কলসি নিয়ে অনভ্যস্ত মা শিশুটিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলো গেলো পরশু, কলসি বালতি নিয়ে হুঁড়োহুড়ি করা মানুষগুলোর সাথে ধাক্কা লেগে উপুড় হয়ে পড়লো বাচ্চাটা । বীভৎস ভাবে ছড়ে গেছে ওর হাঁটু, রক্তাক্ত । এগিয়ে এলো কেউ কেউ, একখাবলা ঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিলো ক্ষতস্থানে , শিশুটি তখন তড়পাচ্ছিলো । এসব এখানে নিত্যই হয়, কারো হাত পা মচকাচ্ছে নয়তো পা ভাঙলো, কবে যেনো কার মাথায় এগারটা সেলাই দিতে হয়েছিলো । একজাতীয় বায়াল তোলা কান্না চলে কিছুক্ষণ, নিমিষে লোক সব একাট্টা হয়ে যায় এবং সবাই মিলে একটা ব্যাবস্থা করে ফেলে । আজকাল রঙধনুর মা পানি তুলতে গেলেও ওরা এগিয়ে আসে, কেউ কলটা চেপে তার বালতি ভরে দেয়, কেউ কখনো নিজের কাজটুকু রেখে বালতিটা ওপরে তুলে দিয়ে আসে । জ্বরতপ্ত শিশুটা মায়ের কাঁধে এলিয়ে পড়ে থাকে , কেউ কেউ ওকে কোলেও তুলে পৌঁছে দেয় । আশ্চর্য সরব এখানে জীবন! মানুষগুলোর মাঝে অদ্ভুত এক মমতা আছে, বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, এরা রূক্ষতার আবরণ তুলে বিত্তবিলাসিদের কাছ থেকে নিজেদের আড়াল করে । বৈপরীত্য আছে, আছে অনেক নষ্ট মানুষও । আসলে নষ্ট মানুষেরা কোথায় নেই? নিজের অজান্তেই মা ওদের একজন হয়ে যেতে থাকে ।
একটু আগে রানির মা খবর দিয়ে গেছে, আজ রানিকে দেখতে আসবে । মনে মনে আতকে ওঠে সে, রানির বয়স মাত্র চৌদ্দ, সন তারিখের হিসেব বাদ দিলে কোন এক জ্যৈষ্ঠের কোন চাঁদের মাসে, কেমন খরার দিনে জন্মেছিলো মেয়েটি, তা হিসেব করে ওরা বয়স বের করে । রানি খুবই ইমোশনাল মেয়ে, সরকারি হাইস্কুলে সিক্সে পড়ে । রানির মায়ের অনুরোধে মেয়েটাকে পড়া দেখিয়ে দেয় সে কিন্তু মেয়েটির এসবে মন নেই । সম্প্রতি দেখা বাংলা ছবিতে কিভাবে একজন নায়ক কে দুই নায়িকা পাগলের মত ভালোবেসেছিলো সেই গল্প ফেঁদে বসে । কখনো তাকে গুনগুন করে গাইতে শোনা যায়, 'তুমি মোর জীবনের ভাবনা হৃদয়ে খুশির দোলা…' মানবিক অভিযোজন হেতু মা এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, শিশুটি এখন ময়লা মেঝেতে পড়ে যাওয়া খাবার অনায়াসে তুলে খেয়ে ফেলে । রঙধনুর বাবা আশ্চর্য নীরব থাকে আজকাল, যেমন সেও আদপে ভুলেই গেছে, মাথার কাছে দুতিনটি বই না থাকলে তার ঘুমই আসতো না ! দীর্ঘ পাঠাভ্যাস এখন রূপান্তরিত হয়েছে গপ্পি গুজবে । মা এখন সময় পেলেই বস্তির মহিলাদের সাথে গল্প করে । যদিও সংস্কার বশত সরু গলিমুখে বসে না সে, তার ঘরেই অনেকে আসে, আসে কিছু ছেলেমেয়েরাও । ওরা সরকারি স্কুলের পড়ুয়া, রানির মায়ের কল্যাণে তার কিছু আয় হয়, এসব বাচ্চাদের অল্প বেতনের বিনিময়ে সে পড়ায় । রানিদের ঘরে সে খুব একটা যায় না, এখানেও শুচিতার ব্যাপার নেই, রানির বাপ বেশীর ভাগ সময় ঘরে থাকে । এতগুলো ঝুপড়ির ভাড়া তুলে বেশ আয়েশি দিন পার করে সে । লোকটার লাম্পট্য এবং দৃষ্টিলেহণে তরুণী মায়ের বমির উদ্রেক হয় ।
এই রে শোরগোল কিসের? মা দৌড়ে রান্নার জায়গাটুকুতে যায় । সারাঘরের মাঝে ওখানেই একটা বড় জানালা আছে । সে মজা করে ওটার নাম দিয়েছে সেন্ট্রাল এসি, একটা গরাদ বিহীন জানালা । হঠাৎ চাঁদের আলোয় নিকোনো আকাশ ওখান থেকে দেখা যায়, দেখা যায় বস্তির ঝগড়া । আগে এইসব শব্দে সে এগুতো না, এখন জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে এই জীবন এবং আকাশ । সারাদিন গার্মেন্টস করে আসা মেয়েরা গণচুলায় রাঁধছে । দুইঘর পরেই ধুন্ধুমার লেগেছে বৌ শ্বাশুড়িতে, এসব প্রায় নিত্য, বৌটি এক দা হাতে নিজেকে কাটতে উদ্যত, কেউ কেউ তাকে সাপটে ধরে আছে, স্বামীটি কিছু না বোঝার মত করে শার্ট গলিয়ে বের হয়ে পড়লো, বুড়ি শ্বাশুড়ির মুখে অশ্রাব্য খিস্তি ,'মর তুই ছিনাল, আমারে ভাত দেস না, আমার পোলার কামাই আমি খায়া পারি না, আর নটি মাগি গতর মাজন করে…' এসব শুনতে শুনতে ভয়াবহ শিউরে ওঠে মা, তার সন্তানটি এখন অনেক কথা শিখছে, সে অনুকরণের নিয়মও জানে ।
রানির বিয়েতে গাফফার মোল্লার বস্তিতে আলোক সজ্জা লাগে, সস্তায় একটা ব্যাণ্ড পার্টি ভাড়া করা হয়, ভিডিও ক্যামেরা হাতে যে লোকটা দৌড়ঝাঁপ করছিলো, বস্তি সুন্দরীদের আব্দার রাখতে গিয়ে তাদের প্রকট সাজপোষাকি ভিডিও চিত্র সে অত্যন্ত মনোযোগ ও দক্ষতার সাথে ধারণ করতে থাকে । ছেলের বাড়িতে বাহারি লগ্গন যায়, ধুমধাম করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়, মাইক ফাটানো গানের শব্দে মা বাবা এবং ছোট রঙধনু শ্বাস বন্ধ করা এক অশান্তির মাঝে পড়ে যায় । বিয়ে পড়ানোর রাতে অভ্যাগতরা যখন পোলাও কোর্মা নিয়ে ব্যাস্ত, এমনকি বিয়ে পড়ানো কাজি সাহেব বরের সাথে একই থালায় বসে খাসির মাথার রোস্ট খাচ্ছিলো, তখন এক অনাহুত মহিলা সেখানে এসে উপস্থিত, সঙ্গে নয় দশ বছরের একটা ছেলে । গাফফার মোল্লা ধামাচাপা দেয়ার অবকাশ পায় না, তার আগেই সমস্ত বস্তি জেনে যায় ইনি গাফফারের দ্বিতীয় স্ত্রী । কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে বাড়ি তৈরী হয় রণক্ষেত্রে এবং বিয়ের আসরে একপাটি জুতা নিক্ষেপ করে বরপক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায় ।