মাংস পোড়া গন্ধে আকাশ বাতাস ঘিন ঘিন করছে, । নাকে কাপড় দিয়েছে সব্বাই, তবু দেখার আশ ছাড়তে পারে না কেউ l সজল বাগদীর বউ টা ন’মাস
পোয়াতি, সেই পেট নিয়ে কোলের বাচ্চাটিকে কাঁখে করে এসে দাঁড়িয়েছে
গায়ের শেষ সীমানায়, যেখানে রুমেলা গোমেজ কে জ্যান্ত
পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, ডাকিনি হবার অপরাধে l কে নেই, কে
নেই সেখেনে ... গেরামের ছেলে বুড়ো বউ ঝি সব্বাই সে তামাসা দেখতে এসেছে ... গ্রামের
মাথা যাঁরা,
তাঁরা সদ্য রায় দিয়েছেন আজই l রুমেলার মা বাপ কে ও খেয়েছে জন্মের সাথে সাথে, বুড়ি দিদিমা মানুষ করেছিল ওকে… মানুষ না তো, তাকে
নাকি ডাকিনি করে তুলেছিল নিজের মতই ... দুরে জঙ্গল টার পাশে ওদের বেড়ার ঘর l অনেকে দেখেছে দুপুরবেলা মোরগ, তিতির, বগেরী
বটের ধরে আনছে রুমেলার দিমা l গ্রামের
সবাই জানে ওরা সে সব কাঁচা চিবিয়ে খায় l রান্না
বান্না! উঁহু সে বালাই নেই ওদের l রাত
দুপুরে নাকি গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে বেড়ায় রুমেলার দিমা, ওরফে বেঙ্গার মা l একমাত্র
ছেলে বেঙ্গা মারা যাবার পর, এই রকম হয়ে গেছে সে, একটা বাক্যি নেই মুখে l রুমেলার সাথে কথা চলে ইশারায় ইঙ্গিতে l রুমেলার মা বাপ মরলো l সুধু রইলো ওই নাতনিটুক l গ্রামের
মায়েরা হায়না,
শেয়ালের থেকেও বেঙ্গার মা কে ভয়
পায় বেশি l
কখন কচি ছেলে তুলে নিয়ে যায়!
ছেলেদের দুষ্টুমি সহ্য না করতে পারলেই ভয় দেখায় - ‘ওই রে বেঙ্গার মা এসে ধরে নিয়ে যাবে’ ... বেঙ্গার মা লোকালয়ে বেরোয় না l শুধু এক একটা পুন্নিমের রাতে, যখন খুব যোচ্ছ্নাতে ভেসে যায় বনভূমি, তখন অনেক দূর থেকে বেঙ্গার মার কান্না ভেসে আসে ... ‘ওরে বেঙ্গা রে এ এ এ এ এ এ এ এ এ এ এ এ এ এ এ কোথা গেলি
বাপ আমার ......’ সেই কান্না ছড়িয়ে যায় বনে
বনে, গাছের কন্দরে, নদীর
জলে, গ্রামে গ্রামে ... এমন নিশিথে কেউ ঘরের বার হয় না ....
এমন রাতে কেউ স্বপ্ন দেখে না ... বন্য জন্তুরা নিথর হয়ে থাকে এমন রাতে ... আর দুধ
সাদা জোছনা গায়ে মেখে সনের নুড়ি চুল, বেঙ্গার
মা বুড়ি বিলাপে,
প্রলাপে আকাশ ফাটিয়ে দেয় .... তবু
বেঙ্গা আসে না ... রাত শেষ হতে যায়, ভয়ে
তরাসে নাতনি ঘুম ভেঙ্গে উঠে ডাকে – ‘অ
দিমা .... ঘরকে চল, শুবি নি?’ ওইটুক মায়া তাকে টেনে রাখে পৃথিবীতে ... লাঠি-ভর বুড়ি
ঠুক ঠুক ঘরের পানে যায় l রুমেলা বেশ ডাগরটি হয়ে
উঠতেই বুড়ির প্রাণ কাঁপে l শ্যামলা শরীরে চিকন লম্বা
চুলের বেনি ... সাপের মত দুলিয়ে যখন রুমেলা ঘরের কাজ সারে ... দিমার চিন্তা হয় ...
কার হাতে দিয়ে যাবে নাতনি কে! যেটুক জানে শিখিয়ে দেয়, সাপ কাটার মন্ত্র, জরিবুটি
অসুধ বানানো - তবে যেটা শেখানো যায় না, সেটা
হলো মানুষকে কি করে বশ করে ... নিজেও জানে না সে ... মানুষ বড় অদ্ভূত প্রাণী ...
এক জোট হলে সব পশুর থেকে হিংস্র l তাই
আজ সে একঘরে ... গ্রামের মানুষ ডাইনি বলে, ভয়
পায় l অথচ ওই যে রামশরণ এর ছেলেকে সাপে কাটল, ও তো পারত বাঁচাতে, জরিবুটি, যা খেলে সাপের বিষক্রিয়া নষ্ট হয়, নিয়ে গেছিল সে l যদি
দিতে পারে,
কিন্তু সক্কলে মেরে তাড়ালো... ‘ওই রে এর উপর আবার ডাইনিটা এসেছে ... যা যা দূর হ’ ..... চোখের সামনে ছেলেটা ধর ফর করে মরেই গেল শেষে l রুমেলা পুড়ছে ..... অজ্ঞান, অচৈতন্য .... মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একখান কালো পাখি l আর সাড়া নেই তার নিথর দেহতে ... গলে গলে পড়ছে মাংস খন্ড
.... দুরে শকুনের দল অপেক্ষায় ... 'এবার
গেরাম ডাইনি মুক্ত হলো বটে' আর ভয় নেই !!
যে রাতে খুব যোচ্ছনা ফুটেছিল, বেঙ্গার মা আবার গিয়ে বসেছিল সেই টিলার উপরে l আজ তার গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরয় না কেন! কিছু পরে, গড়িয়ে পড়ে সেই টিলা থেকে .... আর জ্ঞান আসেনি ....
রুমেলা গোর দিয়েছিল দিমা কে বহু পরিশ্রম করে ... একা একাই l তারপর থেকে একা একাই ঘুরত ফিরত বনে বনে l হরিন দের সাথে, খরগোশ
দের সাথে কথা কইত l আর কারণে, অকারণে গাছদের জড়িয়ে ধরে দু:খ জানাত, গাছেরা তার বড় আপনজন l
শুধু, ফনী
সর্দার এর আড়াই মাসের ছেলেটা যেদিন নিখোঁজ হল সবার সন্দেহ গিয়ে পড়ল রুমেলার উপর!
সবাই বলতে লাগলো ডাকিনি ওই ছেলেকে চিবিয়ে খেয়েছে! সবার সামনে পায়ে রশি বেঁধে টেনে
তাকে নিয়ে গেল l
রুমেলা গোমেজ যেন ঘোরে রয়েছে ...
মুখে কথা নেই,
শুন্য দৃষ্টি ... বিবস্ত্র করে
গ্রামের মাথারা তাকে চাবকাতে লাগলো, চলল
প্রশ্নবান ... কিন্তু রুমেলার হ্যান হু নেই ... এর পরই বিচার হলো পুড়িয়ে মারার l
রুমেলার চুল গুলো যখন পুড়ে যাচ্ছে আর সব দেহটা প্রায় জ্বলেই গেছে .... তখন বুধুয়া পাগল দৌড়তে দৌড়তে
এসে খবর দিলে.... ‘ও ফনী সর্দার গো, ওই যে তোমার ছেলে ... শোন চিতিয়া নিয়ে গেছিল ... ওই তো
মা চিতা বুকে করে নিয়ে খেলা করছে দেখে এলুম’! বাস্তবিকই
তাই, বাচ্চাটিকে সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায় শেষে l ততক্ষণে বিকেল পড়ে এসেছে, নর মাংসর স্বাদ পেতে ক্রমাগত
গৃধ্নুরা ছুটে আসছে খোলা প্রান্তরে l