গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০১৪

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


কাঁচা লংকা , ভাঙা সাইকেল

এক সাত নয় দুহাজার দুই- এর সকালে ঘুম ভাঙতেই হরিদয়াল তার ভাঙা ফুটো আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল নিজেকে দেখল , যেমন সে দেখে প্রতিদিন । চেনা আয়না , একই অবয়ব । আজ খুঁজে পেল অন্য প্রতিবিম্ব ।একঝলক হাসতেই ফোকলা দাঁতের গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল দু এক ফোঁটা থুতু । কোঠরে ঢুকে যাওয়া চোখ জোড়ার মধ্যে সে নিজেকে আবিস্কার করল গল্পের নায়ক হিসেবে । আর ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেল ওর গল্পটা । কিছুদিন পর দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ঘাড়ে নেবারন , হামদের জীবন কি বেফালতু ? বললাম কেন ? - ই ধুপসিপুড়া জীবন গবুরলেপা কপাল ইসব লিয়ে কি কনহ কহনি হয়না ? - অনেক হয়েছে । আরও অনেক হবে হরি । - তার মইধ্যে আমি কই ? হামদের লিয়ে জম্পেস একট কহনি লেইখ্যে দে মাইরি হরিদয়াল মাহাত । পড়ত আমাদের সাথেই ।বন্ধুত্ব সেরকম ছিলনা । জানা হয়নি ওর ভেতরের যন্ত্রণা অথবা রক্তপাত। ভালোবাসা এসেছিল কি না ।শূন্যতা দিয়ে স্বপ্নচিত্র আঁকার নির্ভুল ঠিকানা তাকে তোলপাড় করেছে কখনও ? এসব প্রশ্নও উঠে আসেনি কোনোদিন । ফলে অনেক কিছুই অজানা অচেনা আমার কাছে ।ওকে নিয়ে কি আর লিখব ? আজকালের গল্পের চেনা ছক মানে প্রেম ট্রেম , একটু রহস্যকাহিনি ,হত্যা, খুন একাকীত্ব এবং ১৫% সেক্স ।হরিদয়াল কে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে তো এসব কিছুই আসবেনা । একেবারে নীরস কাটখোট্টা লোক । বিয়ে থা করেনি

            আধুনিক গল্পের ছকে ওকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা । ও একটি মোস্ট রাবিশ । হারামজাদা জীবনটাকে গল্পের ফর্মুলায় বানাতে পর্যন্ত পারেনি । মাননীয় পাঠক ও পাঠিকা , আপনারা একটু থামুন ।হরিদয়াল সম্পর্কে যে শর্ট নোট আমি জানি তার কিছুটা তুলে ধরার দরকার আছে তার বাড়ি মনতোড়িয়া গ্রামে ।(আমার বাড়ি থেকে ৪/৫ কিমি দূরে , মাঝখান দিয়ে ডাংরা নদী চলে গেছে তির তির করে )। বয়স তিরিশের কাছাকাছি । চেহারায় পঞ্চাশের দাগ ।ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কটা চুলের আগাছায় ভর্তি মাথা ,পাঁজরা খাঁড়া ।চিমসানো নিরামিষ শরীর , কোঠরে ঢুকে পড়া চোখের চরাচরে পিঁচুটির শোভা । সারামুখে মেচেতার দাগ । রঙ ভুশুণ্ডি কাকের চেয়ে ঈষৎ উন্নত । কোমরে নীলচে লুঙ্গি ময়লার স্তুপে ঘামে গন্ধময় ।( হয়ত এই সব কারনেই বিয়ে থা হয়নি , গাঁয়ের মানুষের কাছে ড্যাঙ্গা হরি নামে আদৃত )। এই হরিদয়ালের গল্প শোনার ধৈর্য আমার পাঠক পাঠিকার নেই । তবুও লিখতে হবে , সহপাঠী বন্ধুর আবদার অবহেলায় ফেলে দেওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে । আমরা যখন খুব ছোট ,তখন আমাদের চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় একটি ছেলে এসে ভর্তি হয়েছিল ক্লাস ফাইভে। রোগাটে গড়ন , মুখে সালখির চিহ্ন , মলিন জামা । সে- ই হরিদয়াল । ওর এমন বেশ ভুষা দেখেও কোন রকম মায়া , মমতা বা অস্থিরতা তৈরি হয়নি আমার মধ্যে । যা জেগেছিল তা ভয় । চোর গুন্ডা বদমাশ লোকের চেহারা সম্বন্ধে আমার চিন্তায় যে পরিমণ্ডল রচিত হয়েছিল তাতে হরিকে ঐ জাতীয় কিছু বলে মনে হয়েছিল অনেকদিন ।পরে ঘটনার প্রতিঘাতে তা মুছে যায় ।

সেইসব ঘটনার ২।৩ টি আজও মনে রয়ে গেছে এক.. ক্লাসরুমে একদিন সবাই মিলে মেরেছিলাম হরিকে । তার অপরাধ সে একজনের বই চুরি করেছিল। বেধড়ক মার খেয়েও সে কাঁদে নি । চোখে রো পড়েনি । গলার স্বরে মিশেছিল আর্দ্রতা বইট আমিই লিয়েছি ...কিনবার মতন পৈসা নাই ঘরে । তরা আমাকে মার , মার্যেছ শেষ কইরে দ্যা কিন্তুক আমার পিরানট (জামা) ছিঁড়ে দিস না ... আর কিনতে লাইরব । স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা ক্লাসঘর । প্রান নিঙড়ানো এই রূঢ় বাস্তবতা আমি প্রথম লক্ষ করেছিলাম। বুঝেছিলাম সত্যকে অনুভব করতে হলে মানবিক হৃদয় লাগে । দুই.. বাঙলার স্যার অসিতবাবু রচনা লিখতে দিয়েছিলেন একদিন । তোমার জীবনের লক্ষ্য । আমরা খাতা ভর্তি করে লিখে চলেছি কত কিছু । ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বাসনায় ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে খাতার পাতা । চার পাতা পাঁচ পাতা লেখার পর তাকাই হরির দিকে ।ওর খাতায় কোন কালির দাগ নেই । নির্মল । জিজ্ঞেস করি কিছু লিখিস নি কেন ? - কি লেইখব ? - যা হোক কিছু , স্কুল মাস্টার , অফিসার বা ডাক্তার । হো হো করে হেসে ওঠে সে - কিছুই তো লাইরব হইত্যে । হামদের জীবনে কনহ দিশা নাই । ই খাতাটর পারাই সাদা সুইন্য । আজ বুঝতে পারি আমরা সবাই মিথ্যে লিখে হাততালি পেতে চেয়েছিলাম । যার সাথে জীবনের কোন সংযোগ নেই এমন সব সাজানো মিথ্যে। হরি সত্য লিখেছিল জলন্ত সত্য ।

 হরি স্যারদের কাছে খুব মার খেত । স্কুলে না আসার জন্য । অনেক অনেক দিন শুনেছি ওর বাড়িতে রান্নার হাঁড়ি চড়ত না । প্রায় ই ঘটত এমন । যেদিন ওর খাওয়া দাওয়া জুটত না সেদিন পকেটে দশ টা পয়সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ত স্কুলের রাস্তায় । সেই পয়সা দিয়ে বিড়ি কিনত । স্কুলের সামনে যে বটগাছটা দাঁড়িয়ে আছে তার তলে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ভুলে যেত খিদের যন্ত্রণা । এরপর একদিন ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । ব্যস এই পর্যন্ত আমি আমার বুক ছুঁয়ে বলছি এর বেশি বাড়তি কোন কিছুই আমার জানা নেই । প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা , আপনারাই বলুন এই দু একটা পয়েন্ট দিয়ে কি গল্প বানানো যায় ? এই অবধি হেঁটে এসেছিল হরিদয়ালের কহনি । আর লেখা হয়ে ওঠেনি । হরি বারবার তাগাদা দিয়েছে । আমি ওকে বোঝাতে পারিনি যে এরকম চরিত্র নিয়ে গল্প লেখা যায় না , গেলেও বাজারি কাগজগুলো তা ছাপে না ।শুধু বলেছি- নিশ্চয়ই লিখবো , কাহিনী সাজাতে সময় তো লাগবেই । আরও কিছুদিন... । তারপর বেমালুম ভুলে গেছি সব। কাগজে ওর সম্বন্ধে যেসব তথ্য ছিল অবিকল তেমন ই থেকে গেছে । যোগ হয়নি নতুন কোন শব্দ । দুই ‘’আদা চাই কাঁচা লঙ্কা পিঁয়াজ র-সু-উ-উ-ন ভাঙা সাইকেলের বিচ্ছিরি আওয়াজের সাথে অতীব কর্কশ গলার স্বর মিশে নতুন মাত্রা যোগ করল পরিমণ্ডলে । আমি তখন বিছানায় । চীৎকার কানে যেতে হাত দিয়ে বন্ধ করলাম কান দুটো । কিন্তু বেশিক্ষণ নয় । উঠতেই হল শেষ তক ।জানলার কপাটে হাত রাখলাম । হাতের নিবেদিত স্পর্শে খুলে গেল জানালা। তাকালাম । ভুত দেখার মত দেখলাম হরিদয়াল দাঁড়িয়ে । আর ঠিক তখন ই যন্ত্রচালিতের মত লিখে ফেললাম শব্দ দুটো কাঁচা লংকা , ভাঙা সাইকেল । এরপর প্রতিদিন ই ওর সাথে দেখা হয় । রাস্তায় ঘাটে হাটে । ভাঙা সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝুড়ি ভর্তি সবজি , আদা , কাঁচা লংকা ,পিঁয়াজ রসুন নিয়ে সে রাস্তা সন্ধান করে । ওর কণ্ঠস্বরে ঢুকে পড়ে বিজ্ঞাপন । কেউ দু এক টাকার কেনে । তোর সব্জির কোয়ালিটি খারাপ বলে ফিরিয়ে দেয় কেউ ।হরির তাপ উত্তাপ নেই এতে ।ওর জীবনের বৃত্তে কর্কশ শব্দের তরঙ্গে প্রবাহিত হয় কাঁচা লংকা । ভেঙে যাওয়া সাইকেলের ধাতব ঠুং ঠ্যাং শব্দে জীবনের উষ্ণতা বাড়ে । বিজনেস শুরু হয়েছে তিনদিন হল । হরি খুব খুশি । বীরুৎ অবলম্বন ওর জীবন আঁকড়ে ধরে । বেঁচে থাকার গোলার্ধে সংযোজিত হয় নতুন মাত্রা । স্বেদজাত আর্তির ভেতর মাথা তোলে অস্তিত্বের লবন । আজ রাস্তায় পা ফেলতেই হরিদয়ালের মুখোমুখি । পুরানো সাইকেল দেয়ালে ঠেসিয়ে হরি হিজিবিজি আঁকছিল মাটিতে । আমি দাঁড়ালাম । হরি তাকাল । ওর চোখে বিদ্যুতের ঝিলিক । হাসতে হাসতে বলল শ্যাষ তক্ক বুদ্ধি ভাউর কইর্যেট বিজনিস শুরু কইরলম নেবারন , বাইচতে গেলে কানা লকের লাঠি টাই ভরসা । - ঠিক , অবলম্বন ছাড়া কেউ ই বাঁচতে পারেনা । ওকে জীবনযুদ্ধে উত্তপ্ত করার জন্য এই কথাগুলো বলাই সহজ ও যথেষ্ট । হরি খুশি হল ।বলল- একদিন হামদের ঘরে যাইয়ে বামুনের পায়ের ধুলা দিয়্যে আসবি । আমি অনেক্ষন ধরে ওকে দেখলাম । দেখলাম এক বিস্তৃত মরুভূমি আর মরুভূমির মাঝে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য অকল্পনীয় কাঁচা লঙ্কার গাছ ।যাদের পায়ের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণ স্রোতের অথচ স্বচ্ছ ধারার সব নদীরা । স্বাভাবিক ও শব্দহীন ভাবে বয়ে চলেছে তারা । বয়ে চলেছে এক বিপন্ন পরিবারের অন্ন রেখার খোঁজে । তিন হরিদয়ালের সামাজিক অবস্থানের জীবন্ত চিত্রনাট্যের মত লাগছিল বাড়িটাকে । বাড়ি শব্দটি বলা কি ঠিক হল ? কুঁড়েঘর বলাই সঙ্গত ।ঘরের চাল উড়ে গেছে । এদিক ওদিক দুচার আঁটি পুয়াল গোঁজা । মাটির দেয়ালে মাঝে মাঝে ফাটলের চিহ্ন । গোবরের প্রলেপ স্বত্বেও উলঙ্গ । বাড়ির মধ্যে ঢুকতে সংকোচ হচ্ছিল ।হরি আপ্যায়ন করল - আয় আয় উঠনট তে দাড়াই কি গপ্প করা যায় , ভিতর দিগে সিম্যা , বইস । বসলাম । চা ও এল ঠিক সময়ে । র চা ।একটা থালায় মুড়ি ।

খেতে খেতে আমি দেখছিলাম হরিদয়াল কে । ঠিক হরিদয়ালকেও নয় , ওর বাড়ি ঘরদোর , চারপাশ, আলো আঁধার ।গল্পের চরিত্রের মাঝে আশ্রয় কিভাবে তার ভুমিকা নেবে সেই ছবিটাকে স্কেচ করতে হবে এখন । সম্বল বলতে বাপের আমলের ভাঙা সাইকেল ।সিট নেই পরিবর্তে বস্তা ছেঁড়া গুঁজে দেওয়া ।তেলচিটে রঙ ময়লা ধরেছে এদিক ওদিক । সাইকেলটা বাদ দিয়ে কিছু লজঝড়ে আসবাব ।ভাবছিলাম এইসব সাতপাঁচ । হরিদয়ালের মা কে দেখলাম তখন ই । প্রনাম করতে গেলাম । বাধা দিয়ে বলল থাক বাপ থাক , বামুনের পেন্নাম লিলে পাপ হয় ।হরির বাবা তখন বিছানায় শুয়ে । পেল্লাদ মাহাত । কী দাপট ছিল লোকটার ,তাগড়া গতর । একেবারে পেটানো শরীর । গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরত লাঠি হাতে । রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়ানোর সময় হাতে থাকত ছোট সাইজের টাঙ্গি । সবাই চিনত এক কথায় । দিন মজুরের কাজ করত । পাকা বাড়ি তৈরির মশলা বানাত ।আরও অনেক কাজ । তখন সুখ ছিল বাড়িতে । পেল্লাদ মাহাত কে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার । মানুষ বোধহয় এখানে একেবারে অসহায় । গনগনে দুপুর তো জানেনা মনমরা বিকেলের কথা । পেল্লাদের ছিল হাঁড়িয়ার নেশা । প্রায় ই ফিরত দেরি করে টলতে টলতে ।তারপরই ধরল রোগ টা । কি রোগ ওরা জানেনা ।

শুধু স্বপ্ন দেখে মানুষ টা কে বাঁচানো যায় যদি দুবেলা দুমুঠো পেট ভরতি ভাল খাবার দেওয়া যায় । মানুষের শরীরে মরণের গন্ধ বাস শুরু হইল্যে সে খাবার খোঁজে, খাবার। আর খাবারের অনুসন্ধান পর্বের মধ্যে সে নিজেকে ধ্বংস করে ক্রমাগত , পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারে । ফলে তার জীবন বিস্তারের মধ্যে কোন শব্দ থাকেনা। এ এক অর্থহীন অলৌকিক আত্মরতির খেলা । প্রতিরোধ নেই । হরিদয়ালের ঘুন ধরা ভাঙাচোরা চিড়ে চ্যাপটা জীবন বিস্তারের মধ্যে কোনও সবল প্রতিরোধ নেই । হরিদয়ালের মা বিলাসী মাহাত যে জীবন বলতে বুঝেছিল ভাত আর ভাতার । সেও থমকে গিয়েছিল । তবু জীবনের বাকি অর্ধেক অংশ আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল । নিভে যাবে জেনেও আলো যেভাবে দপ করে জ্বলে ওঠে, ঠিক সেরকম ক্ষয়ে ক্ষয়েও আশাটা জিইয়ে রাখে বুকে । আর হরি বেচারা হরি ভাঙা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তার রাস্তায় । ওর মা খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলে ঝট অ কইর্যো ফিরিস বাপ । তবু ফিরতে দেরি হয় হরির ।অনেক দূর যেতে হয় ওকে । অ নে ক দূ র । আগরাবাইদ কেতনকিরি করঞ্জবেড়িয়া, কালিদহ চারপাশের গাঁ গঞ্জ । মঙ্গলবার যেদিন ইন্দ্রবিল স্টেশনে হাট বসে বেশ ভালই বিক্রি হয় সেদিন । বুক আনন্দে উথাল পাথাল । গান গায় – “ অ মাধবী তুমি বড় লকের মেয়ে । আমি যে সবজিওলা, তুমি কি আমার হবে ? ” মনের আনন্দে মায়ের হাতে তুলে দেয় পঞ্চাশ টাকার নোট । মায়ের চোখে খুশির ঝিলিক । হাটবার বাদ দিয়ে অন্যান্য দিনগুলিতে তাকে যেতে হয় দূর দূরান্তে । মাথার উপর গনগনে সূর্য ।বুকে হাজার যন্ত্রনার কিলবিলানি ডাংরার জলে ভেসে যায় । হরি চেঁচিয়ে বলতে থাকে আদা চাই , কাঁচা ল অং কা , পি--- আ--- জ , সু উউউউউউন । স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর থেকে বিকৃত হয়ে যায় শব্দ । কাঁচা লংকা আদা শব্দ দুটোর মধ্যে ছবি ভেসে ওঠে আমার চোখে । এক অসহায় বাবা আর এক অসহায় মায়ের ছবি ।

মনে হয় জীবন ও রক্তের ক্রমাগত বিনিময় চলছে শব্দের সঙ্গে। অনুবর্তিত বোধের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দ । গল্পের চরিত্র গুলি শব্দে শব্দে ঢেকে নিচ্ছে শরীর ।আর হ দুটি মুড় হি দিই বাপ- হরির মায়ের যত্ন ও আন্তরিকতা আমার চিন্তায় ছেদ টানল । -না, আর খাইত্যে লাইরব্য - লাজ শরম কিসের ? ইটও ঘর বটে ন আমি তাকালাম হরির মায়ের দিকে । অভিমান ছায়া ফেলল তার মুখে ।আন্তরিকতায় আরও দুমুঠো মুড়ি দিতে চাইল । আমি ফিরিয়ে দিলাম । কেন ফিরিয়ে দিলাম এই জিজ্ঞাসা জনিত অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল আমার গল্পের এক চরিত্র । আমি দেখলাম । চার অবশেষে একদিন বন্ধ হয়ে যায় হরিদয়ালের ব্যবসা । পুঁজির অভাব বা অন্য কি কারনে তার বিজনেস বন্ধ হয়েছিল আজ আর ঠিক মনে নেই । এরপর সে ইটভাটায় কাজ পায় । একজন প্রান্তিক ব্যাবসাদারের শ্রমিকে রূপান্তর এই বিপন্নতার মধ্যেই গল্পের পরিসমাপ্তি । ক্রমমুক্তি বা সমাজবিপ্লবী কোনও ভাবনাও জড়িয়ে ধরেনি কাহিনির বিন্যাস । তারপর গল্পটিকে ছুঁড়ে দিই এক বাজারী কাগজের ঠিকানায় ।কোন উত্তর আসেনি । চার পাঁচ মাস পর একদিন কি মনে হল সম্পাদকের সাথে দেখা করলাম । বিভিন্ন শব্দের অনুষঙ্গে গল্পের প্রসঙ্গ টেনে আনলাম । - কোন গল্প ? তির্যক চোখ থেকে প্রশ্নটা এল । - সেই হরিদয়ালের গল্প । তিনি হাসলেন । অদ্ভুত বিস্ময়াতীত হাসি । - হরিদয়াল ফরিদয়ালের গল্প আমরা ছাপিনা বলে তড়িৎ গতিতে ড্রয়ার থেকে বের করে আনলেন খামটা । পারলে বেশ জম্পেস এক রসালো গল্প লিখুন । - লেখাটা পছন্দ হয়নি তাহলে? খাম গুছিয়ে নিতে নিতে বললাম । - পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। এ ধরণের লেখা ছাপলে পত্রিকার বাজার কমে যাবে । - আসি । - একমিনিট । এসব গল্প দেবার জন্য আসবেন না । প্রেমের গল্প আই মিন রসালো প্রেমের গল্প লিখতে পারলে আসবেন । পাঠক রুচি নিয়েই তো আমাদের কারবার ।

সেরকম গল্প এখনও লিখে উঠতে পারিনি । কলম থেকে উঠে আসে রক্ত বমি করা মানুষ । হেপো রোগী । এদের জীবনে তো রসালো প্রেমের গল্প নেই। শরীরের ঝুলে পড়া মাংসের মধ্যে পাঠক কে আকৃষ্ট করার লাবন্য নেই ।এদের গল্প ছাপলে তো পত্রিকার রিডারশীপ কমবেই । আমি এখন এক ভবঘুরে । এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম ঘুরে বেড়াই । গল্পের চরিত্র খুঁজি । মফঃস্বল থেকে ভাঙা টাইপে ছাপা গল্পের কাগজ বের করি । তাতেই এসব লিখি । কেউ পড়েনা । জানি কেউ পড়বেনা । তবু লিখি । কেন লিখি তাও জানিনা । ভাঙা সাহিত্যের গাড়িতে চাপিয়ে কাঁচা লংকার মত ফেরি করে বেড়াই এইসব কাগজ । ময়লার স্তুপ জমে বাড়িতে ।অসুস্থ বাবা ও মায়ের ওষুধের পয়সা থেকে গল্পের কাগজ তৈরি হয় । কেমন যেন উন্মাদের মত মনে হয় । আয়নার সামনে এসে নিজেকে দেখতে বড় চমৎকার লাগে । বুঝতে পারি এই প্রতিবিম্বে চেনা লোকের গন্ধ মিশে আছে । কার ? আকস্মিক প্রশ্নে জেগে ওঠে স্নায়ু ।শব্দের গভীরে হেঁটে যায় মন , দ্রুত ও অবিন্যস্ত ভাবে । ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসে আয়না । স্থিতিশীলতা থেকে আবির্ভূত হয় নিঃশ্বাস ।

রাতের অন্ধকারে একটি শব্দ আমাকে খুঁজে বেড়ায় । একটি শব্দ কাঁচা লংকা । প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা , হরিদয়ালের গল্প শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই । ওটা আর ছাপা হবে না । পাণ্ডুলিপির পাতা ছিঁড়ে গেছে । তার পরিবর্তে পাবেন নেবারন মুখুজ্জেকে । গল্পের নাম অপরিবর্তিত । কিছুই বদলয়ায় নি । ঘটনা পালটে যায়নি । বদলে গেছে কিছু শব্দ আর অক্ষরের সজ্জা । এই গল্পে যদি কোথাও হরিদয়াল বলে কোনও শব্দ থাকে কেটে ফেলুন । প্লিজ মুছে দিন । তার জায়গায় নিয়ে আসুন নেবারন মুখুজ্জেকে । এ গল্প নেবারনের গল্প । আর একান্ত অনুরোধ গল্পটি পড়ুন একদম প্রথম থেকে ।
-