এক সাত
নয় দুহাজার দুই- এর সকালে ঘুম ভাঙতেই হরিদয়াল তার ভাঙা ফুটো আয়নার সামনে এসে
দাঁড়াল
। নিজেকে দেখল , যেমন সে দেখে প্রতিদিন । চেনা আয়না , একই
অবয়ব । আজ খুঁজে পেল অন্য প্রতিবিম্ব ।একঝলক হাসতেই ফোকলা দাঁতের
গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল দু এক ফোঁটা থুতু । কোঠরে ঢুকে যাওয়া চোখ জোড়ার মধ্যে সে
নিজেকে আবিস্কার করল গল্পের নায়ক হিসেবে । আর ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেল ওর গল্পটা ।
কিছুদিন পর দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ঘাড়ে – নেবারন
, হামদের জীবন কি বেফালতু ? বললাম – কেন ? - ই ধুপসিপুড়া জীবন গবুরলেপা কপাল
ইসব লিয়ে কি কনহ কহনি হয়না ? - অনেক
হয়েছে । আরও অনেক হবে হরি । - তার
মইধ্যে আমি কই ?
হামদের লিয়ে জম্পেস একট কহনি
লেইখ্যে দে মাইরি । হরিদয়াল মাহাত । পড়ত আমাদের সাথেই ।বন্ধুত্ব সেরকম
ছিলনা । জানা হয়নি ওর ভেতরের যন্ত্রণা অথবা রক্তপাত। ভালোবাসা এসেছিল কি না
।শূন্যতা দিয়ে স্বপ্নচিত্র আঁকার নির্ভুল ঠিকানা তাকে তোলপাড় করেছে কখনও ? এসব প্রশ্নও উঠে আসেনি কোনোদিন । ফলে অনেক কিছুই অজানা অচেনা আমার কাছে ।ওকে নিয়ে কি আর
লিখব ? আজকালের গল্পের চেনা ছক মানে – প্রেম ট্রেম , একটু
রহস্যকাহিনি ,হত্যা, খুন
একাকীত্ব এবং ১৫% সেক্স ।হরিদয়াল কে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে তো এসব কিছুই আসবেনা ।
একেবারে নীরস কাটখোট্টা লোক । বিয়ে থা করেনি ।
আধুনিক
গল্পের ছকে ওকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা । ও একটি মোস্ট রাবিশ । হারামজাদা জীবনটাকে
গল্পের ফর্মুলায় বানাতে পর্যন্ত পারেনি । মাননীয় পাঠক ও পাঠিকা , আপনারা একটু থামুন ।হরিদয়াল সম্পর্কে যে শর্ট নোট আমি জানি তার
কিছুটা তুলে ধরার দরকার আছে – তার
বাড়ি মনতোড়িয়া গ্রামে ।(আমার বাড়ি থেকে ৪/৫ কিমি দূরে , মাঝখান দিয়ে ডাংরা নদী চলে গেছে তির তির করে )। বয়স
তিরিশের কাছাকাছি । চেহারায় পঞ্চাশের দাগ ।ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কটা চুলের আগাছায় ভর্তি
মাথা ,পাঁজরা খাঁড়া ।চিমসানো নিরামিষ শরীর , কোঠরে
ঢুকে পড়া চোখের চরাচরে পিঁচুটির শোভা । সারামুখে মেচেতার দাগ । রঙ ভুশুণ্ডি কাকের চেয়ে
ঈষৎ উন্নত । কোমরে নীলচে লুঙ্গি ময়লার স্তুপে ঘামে গন্ধময় ।( হয়ত এই সব কারনেই
বিয়ে থা হয়নি ,
গাঁয়ের মানুষের কাছে ড্যাঙ্গা হরি
নামে আদৃত )। এই হরিদয়ালের গল্প শোনার ধৈর্য আমার পাঠক পাঠিকার নেই । তবুও লিখতে
হবে , সহপাঠী বন্ধুর আবদার অবহেলায় ফেলে দেওয়া অসম্ভব আমার
পক্ষে । আমরা যখন খুব ছোট ,তখন আমাদের চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় একটি ছেলে এসে ভর্তি হয়েছিল ক্লাস ফাইভে। রোগাটে গড়ন , মুখে
সালখির চিহ্ন ,
মলিন জামা । সে- ই হরিদয়াল । ওর
এমন বেশ ভুষা দেখেও কোন রকম মায়া , মমতা বা অস্থিরতা তৈরি হয়নি আমার মধ্যে । যা জেগেছিল তা ভয় । চোর গুন্ডা বদমাশ লোকের চেহারা সম্বন্ধে আমার
চিন্তায় যে পরিমণ্ডল রচিত হয়েছিল তাতে হরিকে ঐ জাতীয় কিছু বলে মনে হয়েছিল অনেকদিন
।পরে ঘটনার প্রতিঘাতে তা মুছে যায় ।
সেইসব ঘটনার ২।৩ টি আজও মনে রয়ে গেছে এক.. ক্লাসরুমে একদিন সবাই মিলে মেরেছিলাম হরিকে । তার অপরাধ – সে একজনের বই চুরি করেছিল। বেধড়ক মার খেয়েও সে কাঁদে নি । চোখে রো পড়েনি । গলার স্বরে
মিশেছিল আর্দ্রতা – বইট আমিই লিয়েছি ...কিনবার
মতন পৈসা নাই ঘরে । তরা আমাকে মার , মার্যেছ
শেষ কইরে দ্যা কিন্তুক আমার পিরানট (জামা) ছিঁড়ে দিস না ... আর কিনতে লাইরব । স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা
ক্লাসঘর । প্রান নিঙড়ানো এই রূঢ়
বাস্তবতা আমি প্রথম লক্ষ করেছিলাম। বুঝেছিলাম
– সত্যকে অনুভব করতে হলে মানবিক হৃদয় লাগে । দুই.. বাঙলার স্যার অসিতবাবু রচনা লিখতে দিয়েছিলেন
একদিন । তোমার জীবনের লক্ষ্য । আমরা খাতা ভর্তি করে লিখে চলেছি কত কিছু । ডাক্তার
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বাসনায় ফুলে ফেঁপে উঠতে
থাকে
খাতার পাতা । চার পাতা পাঁচ পাতা লেখার পর তাকাই হরির দিকে ।ওর খাতায় কোন কালির দাগ নেই
। নির্মল । জিজ্ঞেস করি – কিছু লিখিস নি কেন ? - কি লেইখব ? - যা
হোক কিছু ,
স্কুল মাস্টার , অফিসার বা ডাক্তার
। হো হো করে হেসে ওঠে সে - কিছুই তো লাইরব হইত্যে । হামদের জীবনে কনহ দিশা নাই । ই খাতাটর পারাই সাদা সুইন্য । আজ বুঝতে পারি আমরা সবাই মিথ্যে লিখে হাততালি পেতে
চেয়েছিলাম । যার সাথে জীবনের কোন সংযোগ নেই এমন সব সাজানো মিথ্যে। হরি সত্য লিখেছিল জলন্ত সত্য ।
হরি স্যারদের কাছে
খুব মার খেত । স্কুলে না আসার জন্য । অনেক অনেক দিন শুনেছি ওর বাড়িতে রান্নার
হাঁড়ি চড়ত না । প্রায় ই ঘটত এমন । যেদিন ওর খাওয়া দাওয়া জুটত না সেদিন পকেটে দশ টা পয়সা নিয়ে বেরিয়ে
পড়ত স্কুলের রাস্তায় । সেই পয়সা দিয়ে বিড়ি কিনত । স্কুলের সামনে যে বটগাছটা দাঁড়িয়ে
আছে
তার তলে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে
ভুলে যেত খিদের যন্ত্রণা । এরপর
একদিন ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । ব্যস এই পর্যন্ত – আমি আমার বুক ছুঁয়ে বলছি এর বেশি বাড়তি কোন কিছুই আমার
জানা নেই । প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা , আপনারাই
বলুন এই দু একটা পয়েন্ট দিয়ে কি গল্প বানানো যায় ? এই অবধি হেঁটে এসেছিল হরিদয়ালের কহনি । আর লেখা হয়ে ওঠেনি । হরি
বারবার তাগাদা দিয়েছে । আমি ওকে বোঝাতে পারিনি যে এরকম চরিত্র নিয়ে গল্প লেখা যায়
না , গেলেও বাজারি কাগজগুলো তা ছাপে না ।শুধু বলেছি- নিশ্চয়ই
লিখবো , কাহিনী সাজাতে সময় তো লাগবেই । আরও কিছুদিন... । তারপর
বেমালুম ভুলে গেছি সব। কাগজে ওর সম্বন্ধে যেসব তথ্য ছিল অবিকল তেমন ই থেকে গেছে । যোগ হয়নি নতুন
কোন শব্দ । দুই ‘’আদা চাই কাঁচা
লঙ্কা পিঁয়াজ র-সু-উ-উ-ন ভাঙা
সাইকেলের বিচ্ছিরি আওয়াজের সাথে অতীব কর্কশ গলার স্বর মিশে নতুন মাত্রা যোগ করল পরিমণ্ডলে । আমি তখন বিছানায় ।
চীৎকার কানে যেতে হাত দিয়ে বন্ধ করলাম কান
দুটো । কিন্তু বেশিক্ষণ নয় । উঠতেই হল শেষ তক ।জানলার কপাটে হাত রাখলাম । হাতের
নিবেদিত স্পর্শে খুলে গেল জানালা। তাকালাম । ভুত দেখার মত দেখলাম হরিদয়াল দাঁড়িয়ে
। আর ঠিক তখন ই যন্ত্রচালিতের মত লিখে ফেললাম শব্দ দুটো – কাঁচা লংকা , ভাঙা
সাইকেল । এরপর প্রতিদিন ই ওর সাথে
দেখা হয় । রাস্তায় ঘাটে হাটে । ভাঙা সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝুড়ি ভর্তি সবজি , আদা , কাঁচা
লংকা ,পিঁয়াজ রসুন নিয়ে সে রাস্তা সন্ধান করে । ওর কণ্ঠস্বরে
ঢুকে পড়ে বিজ্ঞাপন । কেউ দু এক টাকার কেনে । “তোর
সব্জির কোয়ালিটি খারাপ বলে “ ফিরিয়ে
দেয় কেউ ।হরির তাপ উত্তাপ নেই
এতে ।ওর জীবনের বৃত্তে কর্কশ শব্দের তরঙ্গে প্রবাহিত হয় কাঁচা লংকা । ভেঙে যাওয়া
সাইকেলের ধাতব ঠুং ঠ্যাং শব্দে জীবনের উষ্ণতা বাড়ে । বিজনেস শুরু হয়েছে তিনদিন হল । হরি খুব খুশি । বীরুৎ
অবলম্বন ওর জীবন আঁকড়ে ধরে । বেঁচে থাকার গোলার্ধে সংযোজিত হয় নতুন মাত্রা ।
স্বেদজাত আর্তির ভেতর মাথা তোলে অস্তিত্বের লবন । আজ রাস্তায় পা ফেলতেই হরিদয়ালের মুখোমুখি । পুরানো
সাইকেল দেয়ালে ঠেসিয়ে হরি হিজিবিজি আঁকছিল মাটিতে । আমি দাঁড়ালাম । হরি তাকাল । ওর
চোখে বিদ্যুতের ঝিলিক । হাসতে হাসতে বলল – শ্যাষ
তক্ক বুদ্ধি ভাউর কইর্যেট বিজনিস
শুরু কইরলম নেবারন , বাইচতে গেলে কানা লকের লাঠি
টাই ভরসা ।
- ঠিক , অবলম্বন ছাড়া কেউ ই বাঁচতে পারেনা । ওকে জীবনযুদ্ধে
উত্তপ্ত করার জন্য এই কথাগুলো বলাই সহজ ও যথেষ্ট । হরি খুশি হল ।বলল- একদিন হামদের
ঘরে যাইয়ে বামুনের পায়ের ধুলা দিয়্যে
আসবি ।
আমি অনেক্ষন ধরে ওকে দেখলাম ।
দেখলাম এক বিস্তৃত মরুভূমি আর মরুভূমির মাঝে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য অকল্পনীয় কাঁচা
লঙ্কার গাছ ।যাদের পায়ের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণ স্রোতের অথচ স্বচ্ছ ধারার সব
নদীরা । স্বাভাবিক ও শব্দহীন ভাবে বয়ে চলেছে তারা । বয়ে চলেছে এক বিপন্ন পরিবারের
অন্ন রেখার খোঁজে । তিন হরিদয়ালের সামাজিক অবস্থানের জীবন্ত চিত্রনাট্যের মত
লাগছিল বাড়িটাকে । বাড়ি শব্দটি বলা কি ঠিক হল ? কুঁড়েঘর
বলাই সঙ্গত ।ঘরের চাল উড়ে গেছে । এদিক ওদিক দুচার আঁটি পুয়াল গোঁজা । মাটির দেয়ালে
মাঝে মাঝে ফাটলের চিহ্ন । গোবরের প্রলেপ স্বত্বেও উলঙ্গ । বাড়ির মধ্যে
ঢুকতে সংকোচ হচ্ছিল ।হরি
আপ্যায়ন করল - আয় আয় উঠনট তে দাড়াই কি গপ্প করা যায় , ভিতর দিগে সিম্যা , বইস । বসলাম । চা ও
এল ঠিক সময়ে । র –চা ।একটা থালায় মুড়ি ।
খেতে খেতে আমি দেখছিলাম হরিদয়াল কে । ঠিক হরিদয়ালকেও নয়
, ওর বাড়ি ঘরদোর , চারপাশ, আলো আঁধার ।গল্পের চরিত্রের মাঝে আশ্রয় কিভাবে তার
ভুমিকা নেবে সেই ছবিটাকে স্কেচ করতে হবে এখন । সম্বল বলতে বাপের আমলের ভাঙা সাইকেল ।সিট নেই পরিবর্তে
বস্তা ছেঁড়া গুঁজে দেওয়া ।তেলচিটে রঙ ময়লা ধরেছে এদিক ওদিক । সাইকেলটা বাদ দিয়ে
কিছু লজঝড়ে আসবাব ।ভাবছিলাম এইসব সাতপাঁচ । হরিদয়ালের মা কে দেখলাম তখন ই । প্রনাম
করতে গেলাম । বাধা দিয়ে বলল – থাক
বাপ থাক , বামুনের পেন্নাম লিলে পাপ হয় ।হরির বাবা তখন বিছানায়
শুয়ে । পেল্লাদ মাহাত । কী দাপট ছিল লোকটার ,তাগড়া
গতর । একেবারে পেটানো শরীর । গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরত লাঠি হাতে । রাতের আঁধারে ঘুরে
বেড়ানোর সময় হাতে থাকত ছোট সাইজের টাঙ্গি । সবাই চিনত এক কথায় । দিন মজুরের কাজ
করত । পাকা বাড়ি তৈরির মশলা বানাত ।আরও অনেক কাজ । তখন সুখ ছিল বাড়িতে । পেল্লাদ মাহাত কে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার । মানুষ
বোধহয় এখানে একেবারে অসহায় । গনগনে দুপুর তো জানেনা মনমরা বিকেলের কথা । পেল্লাদের ছিল হাঁড়িয়ার নেশা । প্রায় ই ফিরত দেরি করে টলতে টলতে ।তারপরই ধরল রোগ টা । কি রোগ ওরা জানেনা ।
শুধু স্বপ্ন দেখে মানুষ টা কে বাঁচানো যায় যদি দুবেলা দুমুঠো পেট ভরতি ভাল খাবার দেওয়া যায় ।
মানুষের শরীরে মরণের গন্ধ বাস শুরু হইল্যে সে খাবার খোঁজে, খাবার। আর খাবারের অনুসন্ধান পর্বের মধ্যে সে নিজেকে ধ্বংস করে ক্রমাগত , পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারে । ফলে তার জীবন বিস্তারের মধ্যে কোন
শব্দ থাকেনা। এ এক অর্থহীন অলৌকিক
আত্মরতির খেলা । প্রতিরোধ নেই । হরিদয়ালের ঘুন ধরা ভাঙাচোরা চিড়ে চ্যাপটা জীবন
বিস্তারের মধ্যে কোনও সবল প্রতিরোধ
নেই । হরিদয়ালের মা বিলাসী মাহাত যে জীবন বলতে বুঝেছিল ভাত আর ভাতার । সেও থমকে গিয়েছিল । তবু জীবনের বাকি অর্ধেক অংশ আঁকড়ে
ধরে
বেঁচে থাকতে চেয়েছিল । নিভে যাবে
জেনেও আলো যেভাবে দপ করে জ্বলে ওঠে, ঠিক
সেরকম ক্ষয়ে ক্ষয়েও আশাটা জিইয়ে রাখে বুকে । আর হরি বেচারা হরি ভাঙা সাইকেল নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে তার রাস্তায় । ওর মা খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলে – ঝট অ কইর্যো ফিরিস বাপ । তবু ফিরতে দেরি হয় হরির ।অনেক
দূর যেতে হয় ওকে । অ নে ক দূ র ।
আগরাবাইদ কেতনকিরি করঞ্জবেড়িয়া, কালিদহ – চারপাশের
গাঁ গঞ্জ । মঙ্গলবার যেদিন ইন্দ্রবিল স্টেশনে হাট বসে বেশ ভালই বিক্রি হয় সেদিন ।
বুক আনন্দে উথাল পাথাল । গান গায় – “ অ
মাধবী তুমি বড় লকের মেয়ে । আমি
যে সবজিওলা,
তুমি কি আমার হবে ? ” মনের আনন্দে মায়ের হাতে তুলে দেয় পঞ্চাশ টাকার নোট । মায়ের চোখে খুশির ঝিলিক । হাটবার বাদ দিয়ে অন্যান্য
দিনগুলিতে তাকে যেতে হয় দূর দূরান্তে । মাথার উপর গনগনে সূর্য ।বুকে হাজার যন্ত্রনার কিলবিলানি ডাংরার জলে ভেসে যায় । হরি চেঁচিয়ে বলতে থাকে – আদা চাই , কাঁচা ল অং কা , পি---
আ--- জ , র সু
উউউউউউন । স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর থেকে বিকৃত হয়ে যায় শব্দ । কাঁচা লংকা আদা শব্দ দুটোর মধ্যে ছবি ভেসে ওঠে আমার চোখে । এক অসহায় বাবা আর এক
অসহায় মায়ের ছবি ।
মনে হয় জীবন ও রক্তের ক্রমাগত বিনিময় চলছে শব্দের সঙ্গে। অনুবর্তিত বোধের ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসছে শব্দ । গল্পের চরিত্র গুলি
শব্দে শব্দে ঢেকে নিচ্ছে শরীর । “ আর হ
দুটি মুড় হি দিই বাপ- হরির মায়ের
যত্ন ও আন্তরিকতা আমার চিন্তায় ছেদ টানল । -না, আর খাইত্যে লাইরব্য - লাজ
শরম কিসের ?
ইটও ঘর বটে ন আমি তাকালাম হরির মায়ের দিকে । অভিমান ছায়া ফেলল তার
মুখে ।আন্তরিকতায় আরও দুমুঠো মুড়ি দিতে চাইল । আমি ফিরিয়ে দিলাম । কেন ফিরিয়ে
দিলাম এই জিজ্ঞাসা জনিত অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল আমার গল্পের এক চরিত্র । আমি
দেখলাম । চার অবশেষে একদিন বন্ধ হয়ে যায় হরিদয়ালের ব্যবসা । পুঁজির অভাব বা অন্য কি কারনে তার বিজনেস বন্ধ হয়েছিল আজ আর ঠিক মনে নেই । এরপর সে ইটভাটায় কাজ পায় । একজন প্রান্তিক ব্যাবসাদারের শ্রমিকে রূপান্তর এই বিপন্নতার মধ্যেই গল্পের পরিসমাপ্তি । ক্রমমুক্তি বা
সমাজবিপ্লবী কোনও ভাবনাও জড়িয়ে ধরেনি কাহিনির বিন্যাস । তারপর গল্পটিকে ছুঁড়ে দিই
এক বাজারী কাগজের ঠিকানায় ।কোন উত্তর আসেনি । চার পাঁচ মাস পর একদিন কি মনে হল
সম্পাদকের সাথে দেখা করলাম । বিভিন্ন শব্দের অনুষঙ্গে গল্পের প্রসঙ্গ টেনে আনলাম । - কোন গল্প ? তির্যক
চোখ
থেকে প্রশ্নটা এল । - সেই হরিদয়ালের গল্প । তিনি হাসলেন । অদ্ভুত বিস্ময়াতীত হাসি । - হরিদয়াল ফরিদয়ালের গল্প আমরা ছাপিনা বলে তড়িৎ গতিতে ড্রয়ার থেকে বের করে আনলেন খামটা ।
পারলে বেশ জম্পেস এক রসালো গল্প লিখুন । - লেখাটা
পছন্দ হয়নি তাহলে? খাম গুছিয়ে নিতে নিতে বললাম
। - পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। এ ধরণের লেখা ছাপলে
পত্রিকার বাজার কমে যাবে । - আসি । - একমিনিট । এসব গল্প দেবার জন্য আসবেন না । প্রেমের গল্প
আই মিন রসালো প্রেমের গল্প লিখতে
পারলে আসবেন । পাঠক রুচি নিয়েই তো আমাদের কারবার ।
সেরকম গল্প এখনও লিখে উঠতে পারিনি । কলম থেকে উঠে আসে
রক্ত বমি করা মানুষ । হেপো রোগী । এদের জীবনে তো রসালো প্রেমের গল্প নেই। শরীরের
ঝুলে পড়া মাংসের মধ্যে পাঠক কে আকৃষ্ট করার লাবন্য নেই ।এদের গল্প ছাপলে তো
পত্রিকার রিডারশীপ কমবেই । আমি এখন এক ভবঘুরে । এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম ঘুরে বেড়াই । গল্পের চরিত্র খুঁজি । মফঃস্বল থেকে ভাঙা টাইপে ছাপা গল্পের কাগজ বের করি । তাতেই এসব লিখি । কেউ পড়েনা ।
জানি কেউ পড়বেনা । তবু লিখি । কেন লিখি তাও জানিনা । ভাঙা সাহিত্যের গাড়িতে চাপিয়ে
কাঁচা লংকার মত ফেরি করে
বেড়াই এইসব কাগজ । ময়লার স্তুপ জমে বাড়িতে ।অসুস্থ বাবা ও মায়ের ওষুধের পয়সা থেকে গল্পের কাগজ তৈরি হয় । কেমন যেন উন্মাদের মত মনে হয় । আয়নার
সামনে এসে নিজেকে দেখতে বড় চমৎকার লাগে । বুঝতে পারি এই প্রতিবিম্বে চেনা লোকের গন্ধ মিশে আছে । কার ? আকস্মিক প্রশ্নে জেগে ওঠে স্নায়ু ।শব্দের গভীরে হেঁটে
যায় মন , দ্রুত ও অবিন্যস্ত ভাবে । ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসে আয়না । স্থিতিশীলতা থেকে আবির্ভূত হয় নিঃশ্বাস ।
রাতের অন্ধকারে একটি শব্দ আমাকে খুঁজে বেড়ায় । একটি
শব্দ – কাঁচা লংকা । প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা , হরিদয়ালের
গল্প শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই । ওটা আর ছাপা হবে না । পাণ্ডুলিপির পাতা ছিঁড়ে
গেছে । তার পরিবর্তে পাবেন নেবারন মুখুজ্জেকে । গল্পের নাম অপরিবর্তিত । কিছুই বদলয়ায় নি । ঘটনা পালটে যায়নি । বদলে গেছে কিছু শব্দ
আর অক্ষরের সজ্জা । এই গল্পে যদি কোথাও হরিদয়াল বলে কোনও শব্দ থাকে কেটে ফেলুন ।
প্লিজ মুছে দিন । তার জায়গায় নিয়ে আসুন নেবারন মুখুজ্জেকে । এ গল্প নেবারনের গল্প । আর একান্ত অনুরোধ – গল্পটি পড়ুন একদম প্রথম থেকে ।
-