গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০১৪

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


জেনানা ওয়ার্ডের গল্প - ২


(পূর্ব প্রকাশের পর)


         আমার সঙ্গে নুসরত বানুর যখন পরিচয় তখন প্রায় নয়/দশ মাস তার বন্দিজীবন চলছে। সাধারণতঃ জেলখানায় আসার কয়েকদিন পর উকিল ইত্যাদির ব্যবস্থা হলে কোর্টে কেস ওঠে। দু/চার বারের পর দোষী প্রমাণিত হলে সাজা হয়, নয়তো বেল নিয়ে চলে যায় আসামীরা। একেক জনের এক এক রকম। কারও ছয়মাস, কারো দু বছর আবার কারো বা আরো বেশি সাজা হয়। সেটা নির্ভর করে দোষের ওপর। কঠিনতম অপরাধ হলে হয় যাবজ্জীবন, তখন শাস্তি হয় অনেক বেশি। একটা সেল আছে এখানেও, ফাঁসির আসামীর জন্য,কিন্তু কাউকে দেখিনি সেখানে। ভাল ব্যবহার, জেলের নিয়মকানুন ঠিকমত মেনে চলার জন্য অনেকসময় আসামীর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ছাড় মেলে। নুসরতের কাছে কিন্তু মামলা-মোকদ্দমার পরামর্শের জন্য কোন আত্মীয়, উকিল কেউ আসেনি । সপ্তাহে একদিন করে বাড়ির লোকদের সঙ্গে দেখা করার নিয়ম আছে। জেলখানার নির্দিষ্ট ঘরে পুলিশ পাহারায় তারা কথা বলেন, দেখা করেন বন্দীদের সঙ্গে। খাবার জিনিস কিংবা প্রয়োজনীয় কোন জিনিসপত্র দিয়ে গেলে পুলিশি পরীক্ষার পর ভিতরে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু নুসরতের কোন ভিজিটর আসেনা। অন্য বন্দীদের মত গালগল্প করা, পড়শোনা করা, সেলাই শেখা, গান শেখা যেন কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। বিরাট বড় হলঘরের মত ঘরটার এক কোনে চুপ করে বসে থাকে সে। ফরসা রঙ, বছর ২২/২৩ বয়স, গায়ে অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে আসা চুড়িদার-কামিজ, মাথায় ওড়না টা সব সময় বাঁধা। সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকা বন্দিনী নুসরত যেন পৃথিবীর অন্য জগতের বাসিন্দা।

সংশোধনাগারের অডিটোরিয়ামে হয় নানান উৎসব। সব বন্দী, বন্দিনীরাই সেখানে জড়ো হন। তারা যাতে ভাল থাকেন, সুস্থ মানসিকতা তৈরি হয়, সেকারণেই আমাদের ওখানে আসা-যাওয়া। ২৬শে জানুয়ারী, ১৫ই অগাষ্টের দিনগুলিতে গান, ছোটোখাটো নাটক ওদের দিয়েই করানোর চেষ্টা চলে। কেউ কেউ সুন্দর গান করেন, আবৃত্তি করেন। ভাল লাগে। মেয়ে কয়েদীদের মেয়ে পুলিশরা গুনতি করে সেদিন জেনানা-ওয়ার্ডের পাঁচিলের বাইরে(কিন্তু জেলখানার বাইরে নয়) জেলের অডিটোরিয়ামে নিয়ে আসেন। যার যা ভালো জামাকাপড় আছে, তাই পরেন সকলে। একটু আধটু সাজগোজও করেন। একবার ২৬শে জানুয়ারীর সময় এক মহিলা বন্দী আসতে দেরী করছেন, লাইনে দাঁড়িয়ে বাকিরা অধৈর্য হচ্ছেন...রক্ষী বকুনি দিলে মুখ কাঁচুমাচু করে জানালেন, আলতা পরছিলেন, তাই দেরী হল। মায়া হল। আহা রে! একটি দিনের জন্যই তো একটু সময়ের মুক্তি! তখন আর তাদের অপরাধী মনে হয়না। কি করুণ অভিব্যক্তি! নুসরতকে অনেক বলে, বকুনি দিয়েও কোন কিছুতে অংশগ্রহণ করাতে পারিনি আমরা।

সংশোধনাগারে খেলার প্রতিযোগিতা হবে। সেখানে ছেলে মেয়ে আলাদা করে সকলেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। মেয়েদের পুলিশ পাহারায় বাইরে মাঠে নিয়ে আসা হবে, আবার খেলা শেষে ভিতরে গুনতি করে রেখে আসা হবে। গুনতি ছেলেদেরও হয়। কিন্তু আমরা মেয়েদের ওয়ার্ডের খবরটাই জানি, দেখি। স্পোর্টসের পরে যেদিন আবার ওদের কাছে গেছি, অনেকেই ছুটে এসেছে। তারা কে কি প্রাইজ পেল দেখাবার জন্য সে কি উৎসাহ ! নুসরত সেখানেও চুপ। কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কেন সে খেলায় নাম দেয়নি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হাতছানি দিয়ে আমাকে ঘরের এককোনে ডেকে নিয়ে গিয়ে যা বলল, আমার চক্ষু স্থির। শরীর বেচে যে মেয়েকে বাড়ির লোকের অন্নসংস্থান করতে হয়েছে, যার পরিণতি এই জেলখানা, তার এমন সংবেদনশীল মনের কথা জেনে আমার গভীর দুঃখ হল। কথা বলতে পারিনি সেদিন। নুসরত মুসলিম সমাজের মেয়ে। স্বভাব গুণে রক্ষণশীল। খেলার মাঠে অনেক মুসলিম বন্দীরাও আছে, আছেন আরো অনেকেই। সে একজন বড় মেয়ে হয়ে কি করে এই বড় ভাইদের (দাদা দের ) সামনে ছোটাছুটি করবে? তার গায়ের কাপড় সরে যাবে, পা দেখা যাবে না! ছিঃ, সে তা পারবে না! তারা ভাববে না, একটা বেহায়া মেয়ে! হাঁ করে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। বেদনা বোধ করি। মেয়েটির বাবা কি একবারও ভেবেছিল এই কথা? বললাম, খেলার সময় ওসব কথা কেউ ভাবে নাকি! খেলা তো খেলাই, ওসব ভাবতে নেই। চোখে জল নিয়ে জানাল, আর কোনদিন কোন খারাপ কাজ সে করবে না, প্রতিজ্ঞা করেছে। একটু সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে বললাম, এবার যেন বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথা বলে কোর্টে কেস তোলাবার ব্যবস্থা করে। জানাল, কে আসবে? আরো তিনটে বোন আছে, বাবার জন্য তারাও একদিন এখানেই আসবে। পয়সা কোথায়, এইপথ ছাড়া? জিজ্ঞেস করেছি, মা কিছু বলেন না? প্রথমে ফুঁপিয়ে তারপরে ডুকরে কেঁদে ওঠে নুসরত। বাবা তার মাকেও যে এই পথে নামিয়েছে, কার কাছে সে ফিরবে? অপরাধী নুসরত, বন্দিনী নুসরত, সংশোধনাগারের মেয়ে কয়েদী নুসরতের কথার কোন উত্তর দিতে সেদিন পারিনি।

            জেনানা ওয়ার্ডের সবই যে করুণ কাহিনি, তা কিন্তু নয়। সেখানেও মারামারি, চুলোচুলি, কামড়া-কামড়ি, খিস্তি-খামারি এসব আছে। আজ তেমনি একজনের কথা বলি। সে মেয়ে কাউকে ভয় পায় না। অন্য মেয়ে বন্দিনীদের তো নয়ই, আমাদেরও নয়, এমনকি জেলার সাহেবকেও নয়। খারাপ ব্যবহার, গালিগালাজের জন্য একটু বকা-ঝকা করলে তার সোজা উত্তর---দোপাট্টা কিংবা সালোয়ারের দড়ি গলায় বেঁধে ঝুলে পড়বে, দায়ী হবে জেলার সাহেব। এককথায় সোজা ব্ল্যাকমেল । জেলার সাহেব ভদ্রলোক তিক্ত-বিরক্ত তো বটেই, ভয়ে তটস্থ মেয়েটির জন্য। শেষ পর্য্যন্ত তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। আমরাও। সত্যি কথা বলতে কি রোজ রোজ ওখানে গিয়ে এই ঝগড়া-মারামারির কথা শুনতে আর তার মীমাংসা করতে আমাদের ভাল লাগত না। সারাটা সময় এই মেয়েটিকে নিয়েই কাটছিল। আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘটনাটি বলি। এক বিকেলে আমরা সংখ্যায় কম। পারিবারিক প্রয়োজনে কিংবা অন্য কোনো কারণে সকলে না এলে আমরা সেদিন ওখানে যাই না। অন্ততঃ তিনজন একসঙ্গে যাই, নাহলে নয়। সেদিন আমরা তিনজনই আছি। আমাদের তিনজনের উপরই দায়িত্ব পড়েছে ওদের নিয়ে রিহার্সাল করানোর। গিয়ে দেখি বেশ একটা চাঞ্চল্য। ঠিক কি ব্যাপার তখনও জানি না। একে, ওকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে যে মেয়েটি ধরা পড়ে এখানে চালান হয়েছে সে নাকি গতকাল রাত্রে সকলের সঙ্গে খুব মারপিট করেছে, অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করছে, আর কয়েকজনের গালের, হাতের চামড়া তুলে নিয়ছে খাবলে। আমরা বিস্মিত! কি করে? কি করে আবার, হাতের নখ দিয়ে ! ঝগড়ুটে মেয়ে, অসভ্য! দুটি অল্পবয়সী মেয়ে ও একজন বয়স্কা মহিলা তাদের ব্যথা ও চামড়া তুলে নেবার জায়গাটুকু দেখালেন। পুলিশ দিদিকে বলা হয়েছিল? একসঙ্গে উত্তর...হ্যাঁ। এ কি কান্ড! বিরক্ত হলাম আমরা। দিন দশেক আগেই বাংলাদেশের একটি মেয়ে ধরা পড়েছে পতিতাবৃত্তির কারণে। ঠিকানা বলেছে বাংলাদেশের। সত্যি কিনা তাও কেউ জানে না। মেয়েটির নাম এদেশের হিন্দু মেয়ের মত, কিন্তু রোজ বিকেলে নমাজের আওয়াজ শুনে মেয়েটি নাকি মাথায় ওড়না ঢাকা দেয়। হতে পারে সে ওপারের মেয়ে, ধর্মে মুসলিম। কিন্তু মুশকিল হল, যেহেতু অন্য রাষ্ট্রের মেয়ে, তার ব্যাপারে খোঁজখবরও নিতে হবে অনেক বেশি। জানা গেল, যে ঠিকানা মেয়েটি দিয়েছে, সেটা মিলিয়ে দেখে, তারপরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাজেই অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। ইতিমধ্যেই এই মারামারি। স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, গায়ের রঙ শ্যামলা। মাথায় বেশ লম্বা। রোগা-পটকা গ্রামের বয়স্কা মেয়েরা ভয়েই তার কাছে যায় না। কিন্তু সবাই তো আর তা নয়! এইরকম মেয়ে আরও আছে, তাদের সঙ্গেই যত ঝামেলা। মেয়েটির কিন্তু গান গাওয়ার খুব শখ। গলায় একবিন্দু সুর নেই, কিন্তু হারমোনিয়ামের সামনে থেকে সে নড়বে না। ভুলে ভরা সুর শুনে অন্যদেরও ভুল...তাকে সামনে থেকে সরিয়ে একটু পাশে বসানো হল। যে মেয়েটির পাশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হল, সে ভয়ে অস্থির, যদি পরে কিছু করে! সেদিন গানের পরে উলবোনা শেখানোর কথা। আমরা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি থেকে যার কাছে যা উল ছিল সঙ্গে নিয়েছি, আর কয়েকজোড়া কাঁটা কেনা হয়েছে। সেগুলি বার করা মাত্র একজোড়া উল বোনা কাঁটা টেনে তার নিজের দখলে নিয়ে নিল। কি ব্যাপার? সে উলবোনা শিখবে। অমনি একসঙ্গে সকলে চীৎকার করল, ওকে যেন উলবোনার কাঁটা না দেওয়া হয়, বলা তো যায় না, তাই দিয়েই হয়ত কাউকে আঘাত করে বসবে। পুলিশ দিদিও ইশারায় মানা করলেন। সরাসরি আমরা কিছু বলতেও পারিনা। কিন্তু বুঝিয়ে বললাম যে, কোন জিনিসই ওদের কাছে রাখার নিয়ম নেই, আমাদের সামনে সেলাই হয়ে গেলে, পুলিশ দিদির কাছে জমা করে রাখার নিয়ম। পুলিশ দিদিকে একটি তীব্র গালি দিয়ে বললে, ওসব তার জানা আছে, রাখবে না নিজে বাড়ি নিয়ে যাবে, তার কি কোন ঠিক আছে? পুলিশ দিদি তেড়ে এলে, উঠে দাঁড়িয়ে দোপাট্টা কোমরে বেঁধে সে তৈরী কোণ রকম অপ্রীতিকর ঘটনা যেন আমাদের সামনে নাহয়, তাই আমরাই দুজনকে শান্ত করলাম। সত্যি বলতে কি, এত হিংস্র, আর চোখ পাকানো চেহারা, আমরাও ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি। কলকাতা গিয়ে শুধু ওখানকার মেয়েদের নয়, গোটা জেলখানাকেই স্বস্তি দিয়ে গেছে।