তিনটি অনুগল্প
ছোলেমানের অনেক কাজ, আবার সে মূলত কর্মহীন । দু’টো কাজ নিয়মিত প্রশান্তির সাথে করে সে, গান গাওয়া এবং পান করা । সে কখনই গান শেখেনি, তার ঈশ্বর প্রদত্ত কন্ঠ । মাঝরাতে ছোলেমান যখন টলতে টলতে ফেরে, অনেক দুর থেকে শোনা যায় তার উদাত্ত গায়কি, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই, মানুষ যদি মোরে নাই বলো, বেঈমান বলো বেঈমান…….’ তখন অনেক কুমারীর বুক হুঁ হুঁ করে ওঠে । কেউ মনপ্রাণ দিয়ে তাকে চাইলেও ছোলেমান কাউকেই চায় না, জীবনে একজনকেই সে চেয়েছিলো, পারুল সাহা কে । গাও গেরামের পিরীতি কিন্তু শহরের মত নয় গো, হিঁদু মোছলমানের প্রেম হলে আরও বিপদ। এরকম আরো একটা ঘটনা ঘটেছিলো কিছুদিন আগে ,পালিয়ে গিয়েছিলো এক যুগল ধর্মটর্ম পিছনে ফেলে । এই ঘটনা জানাজানি হতেই গ্রাম্য শালিশ বসলো, ছোলেমান নাকে খত দিলো না, প্রয়োজনে সে হিঁদু হতে প্রস্তুত! এ কি অলুক্ষণে কথা! ছোলেমানের মা বাপ আঁতকে উঠলো । পারুল কে পাঠিয়ে দেয়া হলো তার মাসির বাড়ি ।
যেইরাতে ওদের পালানোর কথা ছিলো, সেদিন দুপুরেই ছোলেমান কে ধরলো পুলিশ, ধর্ম বাঁচাতে ওর আর পারুলের বাপ মিলে ওকে চৌদ্দশিকের দুনিয়ায় আটকে রাখলো তিনটে মাস, ততদিনে পারুল শাঁখা সিঁদুর পড়ে আরেকজনের ।
ছোলেমান আগে গান গাইতো, এখন পানও করে, প্রায় প্রতিরাতেই শোনা যায় আহত পাখির ছটফট আর ছোলেমানের নিঃশ্বাস নিঙরানো সুর, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারো ঘরণী……’
নৌকা বাইচ
ও হরেন, ওই দাঁড়া, আমাগের নাও তৈয়ার হইছে? মাত্তর ষোল্ল দিন বাকি বাইচের, বেশী আলকাতরা দিয়া তলা ভারী কইরা দিস না, গলুইর মুখে রাল নঙের (লাল রঙ) শোলার পঙ্খিরাজ বসাইবি, নাও যেন্ চলে তরতর, কথাগুলি একনিঃশ্বাসে বলে থামে নেপাল । হ, নাওয়ের কাম শ্যাষ, হুগাইতে দে, আলকাতরা মারিনাই, বাইত আহিছ, দুইবাই মিল্যা করুম । নৌকাবাইচের তোড়জোর চলছে ।
আমরা নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে দেখি, আমরা নৌকাগুলির সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াই, আমরা শ্লোগান দেই, কেউ হরেনের দল, কেউ সাদেকের, কেউ কেউ জব্বারের, আরো অনেকেই কোন না কোন নৌকা দলের সাপোর্টার । এভাবে নৌকা বাইচের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা রূপসার ঘাটে যাবো, ওখানে সব নৌকা ভিড়বে, হৈ হৈ রব উঠবে, ঢাকের শব্দ নিঃশ্বাসের মত দ্রুত হতে থাকবে, চেয়ারম্যান সাহেব ট্রফি দেবেন, বিজয়ীরা কিছু টাকাও পাবে ।
আমাদের দৌড়ের গতি বাড়ে, উড়ায়া চল হরু দাদা, বারো জন বৈঠাবীর, পঙ্খিরাজার নাহান উড়াল দে রে…. ভাটির বাতাসকে পিছনে ফেলে উজানে ছুটতে থাকে নাওয়ের মিছিল ।
হরেন নেপালের নৌকা এবারই প্রথম হয়েছে, আনন্দের জল সূর্যের শেষ আভায় মুক্তোদানার মত খসে পড়ে, এবার জবা কে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে হবে, দুটো কাপড়ে বছর যায়! হ্যাঁ, জোড়াকবরের দরগায় মানতের সিন্নিও দিয়ে আসতে হবে ।
সাধ ও ইচ্ছে
নদী এখন টইটুম্বুর, সংযোগ খালগুলির জল পুকুরের যৌবনকে টলটলে করে তুলেছে, জলে একটু ছোঁয়া লাগলেই লাজতরঙ্গ । এসেছে বেদেবহর নৌকাগুলি, ভিড়ে আছে বাজারের ঘাটে, এই জীবন একটা ফানুস স্বপ্নের রঙ এঁকে দেয় । সকাল জাগার আগেই ওরা ব্যাস্ত, গলুইয়ের কাছে রাখা চুলায় ফুটছে মোটা চালের লাল ভাত, মশলা জড়ানো সালুনের ঝোল, যুবতীরা আটোসাটো প্যাঁচে পড়ে আছে হাঁটুঝুল শাড়ি, বাহারী খোঁপায় আলগা বিনুনির কাজ, হাতভর্তি চুড়ি, চোখে গাঢ় কাজল, আছে রূপলাগি ওষ্ঠরঞ্জনী, একটু পরেই ওরা বেরোবে । কেউ লেস-ফিতা, চুড়ি, প্রসাধনী নিয়ে, কেউ সাপের ঝাপি, ওস্তাদ যাদুকর, কেউ জরিবুটি নিয়ে সুর করে বলতে বলতে চলবে, ‘দাঁতের পোকা খসাই…. শিঙা লাগাই…. বাণমন্ত্র কাটাই….’ গায়ের মানুষদের কাছে ওদের বেশ কদর, বছরের এই সময়টাতে ওরা একটু ভালো রোজগার করে ।
তুলনামূলক বয়স্ক বেদেরা নৌকাতেই থেকে যায় বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে, রান্নাবান্না গুছিয়ে রাখতে, সাপের ঝাপিগুলি একটু সামলে রাখতে হয়, বিষদাঁত খসিয়ে দেয়ার কিছুদিন পরেই আবার নতুন দাঁত গজাতে শুরু করে সাপগুলোর । এই বর্ষায় সাপের উপদ্রব বেড়েছে, ওঝা বেদেরা সাপ ধরায় ব্যাস্ত, বিষ সংগ্রহে, অনেক দামে বিক্রী হবে বিষ থেকেই বিষের নিরোধক ।
তরুণ বেদেরা তরুণী বেদেনীদের ছায়াঘ্রাণে উম্মত্ত হয়ে হাঁটে, ‘ও মিয়ার ব্যাটারা, ওগের দিকে নজর দিও না, অরা বদ্যির জাত, বাণটোনা জানে,’ এরকম কথাগুলি শোনা যায়, যদিও ছেলে ছোকরারা একটু আধটু লাইন মারার চেষ্টা করে কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারে না ।
সন্ধ্যের বেদে নৌকাগুলি সরগরম, এখন যৌথ উনান জ্বলবে, ছইয়ের গায়ে ঝোলানো হারিকেনগুলি দুলছে, সেদিকে তাকিয়ে মনটা বেখেয়ালী হয়, একটা নৌকা নিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার সাধটা ইচ্ছেয় রূপ নিতে শুরু করে ।