গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

আফরোজা অদিতি

রোদসীর চোখে জল


         অমর  একুশে গ্রন্থমেলায় চার বেশি স্টল থাকে প্রতিবছর একাডেমী  প্রাঙ্গণে বাইরে আণবিক শক্তি কমিশন থেকে পুষ্টিভবন পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেও স্টল বরাদ্ধ দিয়েছে বাংলা একাডেমী স্টলগুলোর কোনটা এক ইউনিট, কোনটা দুই ইউনিট, কোনটা তিন ইউনিট হিসেবে প্রকাশকদের বরাদ্ধ দেয় বাংলা একাডেমী এই স্টলগুলোর সাজ, বইয়ের বিকি-কিনি, বইয়ের প্রচার এবং পুরাতন বইয়ের সঙ্গে নতুন বইয়ের আবেদন সবসময়ই ভালো লাগে রোদসীর নতুন বইএর গন্ধ না পেলে, সারাবছর বিশাল এক শূন্যতা ঘিরে রাখে ওকে প্রতিদিন বইমেলায় না এলে ভালো লাগে না কিছুই মেলায় নতুন বইয়ের গন্ধ তো আছেই, আছে লেখক পাঠকের মেল-বন্ধন মেলায় এলে অনেক মানুষের মনের ভাব, তাদের বই সম্পর্কে চিন্তা চেতনা, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা সব জানা যায় রোদসীর -সবই প্রিয় থেকে প্রিয়তর     

        আজ এসবের কিছুতেই মন নেই রোদসীর মন ভাঙা এক ভালোলাগা নিয়ে একাডেমীর বটতলা নজরুল মঞ্চের পাশের এক ইউনিটের এক স্টলে আনমনা বসে আছে রোদসী রোদসীর  রক্তের মধ্যে লেখা লেখা তার প্রাণ লিখে আনন্দ পায় সে লেখা আর বই ওর নেশাপ্রতিবছর একুশে গ্রন'মেলায় বই বের না হলে ভালো লাগে না ওর যে বছর বইমেলাতে বই বের না হয়, সে বছর মনে হয়, জীবন তো একটাই আর ছোট্ট এই জীবনের অনেক কাজের মধ্যে একটা কাজ বাকি রয়ে গেলো এবার

         ছাত্র জীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো রোদসী পরবর্তীতে রাজনীতিবিদদের  দলাদলি, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির জন্য রাজনীতি  ভালো লাগেনি ওর ছেড়ে দিয়েছে  রাজনীতি, সেই সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছে রাজনৈতিক লেখালেখিও এখন গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখছে, লিখছে শিশুদের জন্যও এবারে নতুন বই এসেছে ৪টা ২টা শিশুতোষ ছড়া গল্প, ১টা প্রেমের কবিতা, ১টা উপন্যাস 

         ওর বই বের করেছে প্রথা প্রকাশন সেই স্টলেই বসে আছে রোদসী স্টল সুন্দর করে সাজিয়েছে প্রকাশক নারী প্রকাশক প্রকাশক, নারী হলেও বেশ চটপটে কর্মতৎপর খাটতে পারে, খাটাতেও পারে প্রকাশনীর বয়স মাত্র ছয় বছর এরই মধ্যে তার প্রকাশনীর বই এর সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে গেছে রোদসীর  বই ভালো যাচ্ছে তবুও বিষন্নতা কাটছে না  

         আজ সজীবের ব্যবহার ওর বুকের ভেতরে জল ঝরিয়ে যাচ্ছে অনবরত ভুলতে চাইছে পারছে না সজীবের ব্যবহারে আন্তরিকতার অভাব আছে বলা যাবে না কিংবা সজীবকেই বুঝতে পারেনি ওর ব্যবহারে আন্তরিকতা  দেখেছে, দেখেছে ভালোবাসাও ওরা দুজনে, যে যে-কাজে আনন্দ পায় তাতে  বাধা দেয় নি কেউ কিন্তু আজকে সজীবের আচরণ বিবর্ণ, বিদীর্ণ, ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে ওকে এতদিনের সজীব সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেছে এমন বর্বর, রাজাকারটাইপ ব্যবহার সজীব করেতে পারে, এখনও বিশ্বাস করতে মন চাইছে না ওর  ওদের সম্পর্কের ভাঙন যে এতটাই গভীর ওর চিন্তাতেই আসেনি কখনও কবে, কখন যে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে আজকের আগে টেরই পায়নি রোদসী বিশ্বাস করে মানুষ যখন প্রয়োজনে একে অন্যের কাছাকাছি থাকে তখন সেই থাকাটা হয়ে যায় অভ্যাস সেই সঙ্গে অভ্যাস হয় ভালোবাসা, পুরানো হয় সম্পর্ক তবে দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের ভিত মজবুতও হয়, তখন ভালোবাসাকে আর অভ্যাস মনে হয় না  কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে ওদের সম্পর্কের ভিত ভঙ্গুর শুধু নয়, সম্পর্কের ভিতই নেই! ভালোবাসাও নেই! কবে থেকে নেইনিজেকেই প্রশ্ন করে রোদসী উত্তর পায় না   

          সব শূন্য আজ সজীব যে ওর লেখালেখি সম্পর্কে এমন রাবিশ মন্তব্য করবে ওর ধারণার বাইরে সজীব জানে, লেখালেখি ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচতে পারবে না রোদসী মাছ যেমন ডাঙায় তুললে নিশ্চুপ হয়ে যায়, লেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ওর অবস্থাও তাই লেখা ভালো কী মন্দ বিচার পাঠকের, বিচার ভবিষ্যতের বিচার লেখকের নয় তা ছাড়া এক লেখকের সব লেখা ভালো হবে কিংবা সব লেখা যে  পাঠকের ভালো লাগবে তাও নয় কারণ ভালো লাগাটা আপেক্ষিক ব্যাপার কথাও সজীবকে আগেই বলেছে, অনুরোধ করে  বলেছে লেখা নিয়ে সমালোচনা করতে পারো, কিন্তু কোন বাজে মন্তব্য যেন কখনও না করে তবুও সজীব মেলায় আসার মুহূর্তেই অশ্লীল মন্তব্যের সঙ্গে বলেছে, রোজ রোজ মেলায় গিয়ে কী লাভ তোমার তোমার লেখা কী কেউ পড়ে! আজেবাজে ছাইপাশ লেখ, আর মানুষের কাছে ফেরি করো আসলে, তুমি মেলায় যাও লোক দেখতে, নিজেকে দেখাতে আজ থেকে বই লেখা বন্ধ, তুমি মেলাতেও  যাবে না

         রোদসী এতোটাই অবাক হয়েছিলো সজীবের কথায়, ওর মুখে জবাব দেওয়ার মতো কোন কথা জোগায়নি কোন কথা না বলে দরোজা খুলতেই গায়ে হাত তুললো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মেঝেতে কপাল কেটে রক্ত বের হলো ওর গায়ে হাত তোলার ব্যাপারে প্রতিবাদ করতেই বললো, আর সম্পর্ক নেই তোমার সঙ্গে এতদিনের  সম্পর্ক  এক কথায় ছিন্ন হবে? কেমন কথা!

চুপচাপ বসে তাই ভাবছিলো ওর সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এর অর্থ কী! লেখালেখি ছাড়া অন্য কোন কারণ! যা, জানে না  সজীব কী তাহলে অন্য কোন নারীতে আসক্ত, যা ভাবে নি কখনও এমন তো মনে হয়নি কখনও! কি এতটাই নির্বোধ, বুঝতে পারেনি স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্বামীর চরিত্র তাছাড়া এই ষাট ছুঁই ছুঁই জীবনে এসে সম্পর্কের ভাঙন সে তো কোন মানুষই কল্পনা করতে পারে না, পারবেও না লেখালেখি করে ঠিকই তাই বলে কখনও অবহেলা করে নি সজীবকে করার প্রশ্নও আসে নি কখনও সজীব সম্পর্ক ভেঙে দিবে কথা বিশ্বাস করতে এখনও সায় দিচ্ছে না ওর মন মনটাকে নানাভাবে বশে রাখার চেষ্টা করছে রোদসী 

         হঠাৎ চোখ পড়ে নজরুল চত্বরের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সজীব, সঙ্গে এক মহিলা আর বছর চারের এক ছেলে ছেলেটা দেখতে সজীবের মতো আর  মহিলাকে তো চেনে রোদসী সজীবের এক কলিগের বোন, নীলা ওদের বাড়ি এসেছেও কয়েকবার  রোদসী ডাকলো সজীবকে, ডাকলো নীলাকেও সজীব তাকালো ওর দিকে কিন' এলো না এমন কি সাড়াও দিলো না ছেলেটার হাত ধরে এগিয়ে গেলো গেইটের দিকে রোদসী স্টল থেকে বের হতে হতেই ওরা গেইটের কাছে চলে গেলো দূর থেকেই দেখতে পেলো একসঙ্গেই গাড়িতে উঠছে ওরা

         ওদের কী সম্পর্ক  ? নীলার স্বামী বিদেশে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেছে, তা জানে রোদসী বছর পাঁচেক সজীব এখানে-ওখানে যাওয়ার নাম করে মাঝে মাঝেই রাতে বাড়ি ফিরে না
তার কারণ কী তবে নীলা? কথা ভাবতেও মন সায় দিচ্ছে না নিজের চোখকেও অবিশ্বাস হচ্ছে ওর সম্পর্কের এই ভাঙন কল্পনাও করেনি রোদসী বুকের ভেতর মরুভূমির ধু ধু তপ্ত বালুর হল্কা চোখে-মুখেও ছড়িয়ে যায় শুকনো চোখে তাকিয়ে থাকে ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে সজীব জানে মেলায়, তাহলে ওকে কি জানিয়ে গেলো সজীব, ওর অন্য আর এক জীবনের কথা, যা ওকে জানায় নি এতদিন  সজীব, তুমি কাজটা কী ভালো করলেকাজটা ভালো করলে না সজীব !

         এই মুহূর্তে রাতুলকে মনে পড়ছে রাতুল থাকলে রাতুলের ছেলে মেয়ে নিয়েই দিন কেটে যেতো! রাতুল থাকলে এমন লাগতো না আজ রাতুল যখন চলে যায় তখন ওর বয়স পনেরো পুরো হয় নি কতো বিজ্ঞপ্তি কতো খুঁজাখুঁজি পাওয়া যায় নি রাতুল ফিরে আয়, ফিরে আয় হাহাকার ওঠে বুকের গভীরে রাতুলের মায়াবি চেহারা ভেসে ওঠে বুকের মাঝে বুকের ভেতর টলটল জলের ওপর ভাসতে থাকে  রক্তজবার মতো রাতুলের মুখ চোখে জল এসে যায়  

প্রকাশক মেরিনা তৌহিদ স্টলে ঢুকে বললো, আপা, আপনার বই তো ভালো যাচ্ছে, তাহলে আপনি কেন এমন চুপচাপ বসে আছেন
ওকে  কিছুই বলতে পারে না রোদসী সবাইকে কী সব কথা বলা যায়! যায় না আস্তে বললো, আজ আমার কিছুই ভাল লাগছে না মেরিনা

         মেরিনা, ওর মুখের দিকে চেয়ে বলে না কিছু অন্য ক্রেতাদের দিকে নজর দেয় আজ মেলায় ভীড় খুব বেশী  না হলেও কম বলা যাবে না স্টলের সামনেও দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন রোদসী  হঠাৎ খেয়াল করে  সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোর দেখছে ওকেই ছেলেটার দিকে চাইতেই  সমুদ্রের বিশাল ঢেউ ভেঙে পড়লো  ওর মন-প্রাণ-হদয়ে শ্যামল রঙের, টানা টানা চোখের লম্বা ছেলে কোকড়া চুল হাতের পর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ওকে দেখেই রোদসীর মনে হয় রাতুলই এসে দাঁড়িয়েছে স্টলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রোদসী গায়ের রং ছাড়া রাতুলের সঙ্গে বদল করা যায় ছেলেটাকে

         রাতুল,এই ছেলেটার বয়সেই সমুদ্রের শহর কক্সবাজারে গিয়ে আর ফিরে আসেনি খুব দুষ্ট ছিলো, কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো স্কুলের সব টিচারের পছন্দের ছাত্র ছিলো সহপাঠিরা ভালোবাসতো রাতুলকে এস.এস.সি. দেওয়ার পর ছাত্র শিক্ষক সকলে মিলে গিয়েছিল কক্সবাজার সহপাঠিরা ফিরে এসেছিল, ফিরে এসেছিল শিক্ষক, শুধু ফেরেনি রাতুল ছেলেটার ভঙ্গি একেবারে রাতুলের মতো রাতুল যেমন কোন প্রশ্ন করার ইচ্ছা হলে চোখের পলক ফেলত বারবার আর ঠোঁট দুটো কথা বলার জন্য ফাঁক করে রাখত ওকে দেখেই  রোদসী বুঝতো কিছু বলবে কিছু বলবে রাতুল ? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিতো রাতুল সারাদিনের জমানো কথা এক নিঃশ্বাসে বলেই তবে শেষ  ছেলেটিও  সেইরকম ওকে দেখেই বুকের ভেতরের জলের প্রবাহ দ্বিগুন হয় রোদসীর, ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে কিছু বলবে ? একটু দ্বিধা করেই ভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করে রোদসী
প্রশ্ন করেই নিজেই অবাক অনেক দিনের পুরানো স্মৃতি আর স্মৃতি থাকে না, বর্তমান হয়ে ওঠে  প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা কথা বলতে শুরু করেলো
আপনি কোথায় থাকেন , খুব চেনা লাগছে আপনার কয়টা বই বের হয়েছে আমাকে দেন, পড়বো 
জল-চোখে হেসে ফেলে রোদসী তাই ! তোমাকেও চেনা  লাগছে আমার বই কি আগে পড়েছো
হ্যাঁ, পড়েছি আপনি কোথায় থাকেন?
আমি মালিবাগ তুমি কোথায়?
আমি, এখানে বেড়াতে এসেছি মালিবাগে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি   ছেলেটা  জবাব দেয়
তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায় ?
আমার গ্রামের বাড়ি কোথায় তা তো জানি না     
আমি, আর আমার বাবা,নানীর সঙ্গে পাবনাতে থাকি
বাবার  বাড়ি যাও না  ?
বাবার বাড়ি তো চিনি না আমার জন্মের আগেই এক অ্যাকসিডেন্টে আমার বাবার স্মৃতি হারিয়ে যায়  
আগের কোন কথাই মনে করতে পারেন না কোথায় বাবার বাড়ি, কে বাবার মা, কে বাবা কিছুই জানি না কোনো আত্নীয়স্বজন আছে কিনা তাও জানি না আমার মা, নানা, মামা কেউ বেঁচে নেই
দুঃখ পায় রোদসী আহা ! এমন সুন্দর ছেলে  রোদসীর চোখে জল এসে যায় আবারও

আচ্ছা চলি  আপনাকে অনেক আপন মনে হচ্ছে ভালও  লেগেছে আমাদের  বাসায় আপনার মতো দেখতে কিন' বয়স কম একজনের ছবি আছে জানি না কার ছবিবাবার মানিব্যাগ থেকে ওটা পেয়েছিলেন আমার নানা বাবা ভালো থাকলে হয়তো বলতে পারতেন কার ছবি আচ্ছা চলি

 রোদসীর আরও কিছুক্ষণ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু নতুন পরিচয়ের একটা ছেলের সঙ্গে ব্যক্তিগত এত কথা বলাটা ঠিক মানায় না ছেলেটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে রোদসী ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ডাকতে  ইচ্ছা করলো ছেলেটাকে  কিন্ত ওর নাম ? নামতো জানা হয়নি! কি ওকে  রাতুল নামে ডাকবে ! না কি ডাকবে এই ছেলে শোন কিন্ত' ছেলেটাকে ডাকতে গিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, এই রাতুলের ছেলে ! রোদসী, রাতুল না ডেকে ডাকলো রাতুলের ছেলে বলে ছেলেটাকে ডেকে নিজেই আশ্চর্য হলো রোদসী আরও আশ্চর্য হলো যখন দেখল, ছেলেটাও পেছন ফিরল, কাছেও এলো !
আপনি বাবার নাম জানলেন কী করে
এবার আশ্চর্য হওয়ার পালা রোদসীর তোমার বাবার নাম রাতুল
হ্যাঁ বাবার পকেটে ক্লাসের আইডি কার্ড ছিল, সেটা থেকেই জানা গিয়েছিলো বাবার নাম, রাতুল বাবার অবশ্য মনে নেই
তোমার বাবা কি করে  ?
    তেমন কিছু না নানুর জমি আছে, তিনটা  বাড়ি আছে এসব দেখাশুনা করে বাবার তো কিছু মনে নেই ক্লাসের যে আই.ডি কার্ড ছিল তা থেকে জানা যায় দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন বাবা বাবাকে কক্সবাজার      গিয়ে পেয়েছিলেন আমার নানু নানু, নানী  মা আর মামাকে সঙ্গে নিয়ে সাগরে গিয়েছিল বেড়াতে, তখন এক বিকেলে বাবাকে পেয়েছিলেন ঝাউবনের ভেতর মাথায় আঘাত ছিল বাবার শরীরেও জখম ছিল অনেক বাবা, প্রায় এক বছর কোমাতে ছিলেন বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে, আইডি কার্ড নিয়ে কলেজে গিয়েছিলেন নানা, ওখানে যে ঠিকানা ছিল, সেই ঠিকানায় খোঁজ করে পাওয়া যায়নি কাউকেই ওখানে, তখন নতুন বিল্ডিং হচ্ছিল হারানো বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিলে নানু

         রোদসীর মনে পড়ে, ওরা ওই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিল রাতুলের স্মৃতি তাড়া করে ফিরছিলো কিছুতেই থাকতে পারছিল না রাতুল হারিয়ে যাওয়ার পরদিনই অসুস্থ হয়ে পরেছিল , হাসপাতালে ছিল ছয়মাস তারপর ডাক্তারের নির্দেশে হাসপাতাল থেকেই  নতুন বাড়ি খবরের কাগজ দেখা হয়নি তখন    

রোদসী হঠাৎ কী মনে করে ছেলেটাকে বলে, তোমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে আমাকে
আপনি যাবেন ! অবাক হয় ছেলেটা
হ্যাঁ, আজই এখনই  
ছেলেটা আরও অবাক বলে, আমি তো কয়েকদিন পর যাবো
কয়েকদিন পর ! সে তো অনেক দেরী !
রোদসীর চোখের কোলে জল চকচক করে ছেলেটা, রোদসীর দিকে চেয়ে কী ভাবলো কে জানে বললো, ঠিক আছে, কাল সকালে নিয়ে যাবো আপনি রেডি থাকবেন

পরদিন ভোর পাঁচটা কলিংএর আওয়াজ দরোজা খুলে দেয় রোদসী আনন্দের নিঃশ্বাস ফেলে বলে, এসেছ তুমি আমি ভাবলাম আসবে না
কেন আসবো না ! আমারও বাবার সবকিছু জানা প্রয়োজন

         সজীব বাড়ি আসেনি আসবেও না কখনও মেলার থেকে ফিরে একটা খাম পেয়েছে টেবিলে খামে একটা দলিল আর একটা চিরকুট   সজীব, নীলার সঙ্গেই থাকবে, মাঝে মধ্যে আসবে ওর কাছে এই বাড়িটা ওর নামে লিখে দিয়েছে বাড়ি! যার সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকবে না, তার বাড়ি, তার টাকা নিয়ে কী করবে রোদসী ! সম্পর্কহীন মানুষের কাছ থেকে টাকা কিংবা সম্পদ নেওয়া ওর কাছে ভিক্ষাবৃত্তির মতো, যে দেওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার স্পর্শ নেই সে দেওয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে করুণা, দয়া তাছাড়া, প্রেমহীন সম্পর্কের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বসবাস ওর কাছে রক্ষিতার সামিল এই ভাষার মাসে, একজন ভাষা সৈনিকের মেয়ে হয়ে  নিজেকে এতো নিচে নামাতে পারবে না রোদসী

          সজীবের শরীরে রাজাকারের রক্ত আছে মনে হচ্ছে ওর ওর বাড়ি নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে কোন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না রোদসীর যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাও বলতে ইচ্ছা করছে না, কোন মেসেজও দিতেও ইচ্ছা হচ্ছে না ফ্ল্যাটের আর একটা চাবি আছে সজীবের কাছে না বলে গেলেও কোন অসুবিধা হবে না সজীবের তাছাড়া ফ্ল্যাটে আর কোনদিন ফিরবে না রোদসী এটা নিজে যেমন জানে, তেমনি জানে সজীব মোবাইল করা বা না করা, মেসেজ দেওয়া বা না দেওয়ায় কিছুই আসবে যাবে না সজীবের কিংবা ওর নিজের

         এখন অবশ্য সজীবের কথা ভাবছে না রোদসী, ভাবছে রাতুলের কথা রাতুলকে ফিরে পাওয়ার বিশ্বাস নিয়েই ছেলেটার সঙ্গে পথে বের  হয় রোদসী যদিও ওর মনের ভেতর রাতুলকে ফিরে পাওয়ার আশা আশংকা একসঙ্গে কুয়াসা ভাঙা রোদের মতো একটা রঙিন জগত তৈরি করেছে তবুও মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে রোদসীর, ওই ছেলেটার বাবাই ওর হারানো ছেলে রাতুল