গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

জয়তি ভট্টাচার্য্য

সেই নদীটি......নীলনদীটি


ওরা দুজন মুক্ত বিহঙ্গ । জীবনের পথটুকু একসঙ্গে চলার বাসনায় আজ ডানা মেলা লাভ-বার্ড । ওরা সদ্য মধু-চন্দ্রিমা যাপন শেষে ঘরমুখো । সারাজীবনের মধুর সঞ্চয় বুকের ভিতর ,দুজনের চোখের পলকে মেখে নিয়ে ওরা ঘরে ফিরছে । মধুসংগ্রহে গিয়েছিল একটি শৈলশহরে । সেখানে বছরভোর আকাশ ছাওয়া বর্যা মেঘের ইতিউতি ঝরে পড়া । ঝিকমিক রোদ্দুর সেখানে প্রকৃতির মনের আয়না । ওরা ঘরমুখো । গাড়িতে ওরা দুজন ।সমস্ত যাত্রাপথ আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে আকাশঝাড়ু পাহাড়গুলো । গোল গোল ঘুরে যাওয়া পাহাড়ী পথগুলো সদ্যখোলা ছবির বইয়ের পাতার মত ওদের স্বপ্নভরা চোখের পাতায় নতুন নতুন ছবি মেলে ধরছে । পাহাড়ের পাথুরে বন্ধুর পথে ছলছলিয়ে বাঁক ঘুরে ঘুরে বয়ে চলেছে একটি নদী । তরতরিয়ে, ঝিরঝিরিয়ে,কলকলিয়ে,অকারন আনন্দে উচ্ছ্বল, ঠিক ওদেরই মত । নদীটির রঙ নীল,যেন সবুজ বনের গায়ে নীলাম্বরি শাড়িটি । গাড়ি ছুটছে ,বাঁক ঘুরে ঘুরে, সঙ্গে সেই নদীটি,যে নদীটি বনানী বালিকার শরীরের খাঁজে খাঁজে নীলাম্বরি । একটু চায়ের তেষ্টায় ওরা থামল। ওদের ইচ্ছে করছিল উঁচুনীচু পাহাড়ী পথ বেয়ে নীলনদীটিকে একটু ছুঁয়ে নেওয়া । ঘড়িতে এখন বেলা তিনটেওদের ইচ্ছের কথা শুনে ড্রাইভার কেমন যেন এক চমকে ওঠা সুরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল,''এখন না যাওয়াই ভাল,চাটুকু খেয়ে নিয়ে ফের রওনা দেওয়া যাক ।'' ওরা শুনল না,'এখনি ফিরে আসব' বলে ওরা পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল ।

নীচে থেকে সেই নীল নিবিড়ের হাতছানি । ছেলেটি হঠাৎ বলল,''কেমন এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল,চলো ফিরে যাই ।'' মেয়েটি বলল , ''কোথায় হাওয়া ? পাগল হলে ?'' কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, ছেলেটি পিঠের ওপর পেল এক হিমেল হাতের স্পর্শ । জোর ধাক্কা । আচমকা ধাক্কা সামলাতে না পেরে ছেলেটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গড়াতে গড়াতে থামল গিয়ে সেই নিবিড় নীলের পাথুরে বুকের খাঁজে ।সম্পূর্ণ জ্ঞান খোয়াবার আগে সে শুনতে পেল কেমন এক রক্ত ঠান্ডা করা অশ্লীল ফিসফিস হাসি আর সারা শরীরে কে বুলিয়ে দিল ঠান্ডা হাতের পরশ । বেশ কিছুক্ষণ পর, মেয়েটি এখন সেই আগেরই মতন নির্বিকার বয়ে চলা নীলনদীটার ধারে ছেলেটির প্রাণহীন নিথর দেহটিকে ছুঁয়ে বসে, আশেপশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরগুলোরই মত স্হানুবৎ । ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা স্হানীয় মানুষদের আর অন্য যাত্রীদের কথাবার্তার টুকরোটাকরা আভাস মেয়েটির কানে আসছিল, প্রতিবছর পৌষ পূর্ণিমার এই দিনে মধুচন্দ্রিমায় আসা দম্পতির পুরুষটি এমনই অশরীরির ধাক্কায় প্রাণ হারায় ।


        নীলনদীটি বয়ে চলেছে, আগের মতই তিরতিরিয়ে. ছলছলিয়ে... একটু বেশিই কলকলিয়েউচ্ছ্বলতা যেন ফেনিয়ে উঠছে পাথরের পায়ে মাথা ঠুকে । মেয়েটির কানে আসছে....এমন ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিবছর, গত পাঁচবছর ধরে...সেই বছরের পর থেকে, যে বছর পৌষপূর্ণিমায় ঠিক এমন সময়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা গাড়িটার ধাক্কায় সেই এক পাহাড়ী মেয়ে...শুনতে পেল মেয়েটি.. সেই পাঁচবছর আগের থেকে নীল নদীটি নাকি আরো .....আরো .....আরো বেশি নীল ! নীলনদীটি ওই চলেছে, বয়ে চলেছে, আগের মতই ছলছলিয়ে,তিরতিরিয়ে, একটু বেশিই কলকলিয়ে !!