বাইকটা আজও ফলো করছে । রোজ এই সময় স্কুলের উল্টো দিকের মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে । ওকে গেট দিয়ে বেরোতে দেখেই চোখের সানগ্লাস মাথায় তুলে সিগারেট ফোঁকে প্রকাশ । ছেলেটার সিভি তিতুর হাতে এসে গেছে , বন্ধুবান্ধবের নেট ওয়ার্কে । ছেলেটার নাম প্রকাশ দাস । মা নেই । দুই ভাই , এক দিদি । ও ছোট । বড় দাদা দিদির বিয়ে হয়ে গেছে । ও এখনো চাকরি পায়নি । তবে স্টুডেন্ট ভালো । পেয়ে যাবে, মানে, পাওয়া উচিৎ ! দেখতে ঠিকঠাক । টল, নট ডার্ক বাট হ্যান্ডসাম। সেই কবে থেকে লেগে আছে, মনোযোগী ছাত্র যাহোক ! তিতু নিজের সম্পর্কে বেশ সচেতন । ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে ও বেশ সুন্দরী । বড় হয়ে দেখল, আয়নাও তাই বলে । পড়াশুনোতে ওদের দুই ভাইবোনেরই মাথা পরিস্কার । ও এমএসসি করেই এই স্কুলের প্যারাটিচারের ইন্টারভ্যুটা দিয়েছিলো, লেগে গেছে । ও অবশ্য পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে কম্পিটিটিভ একজামের জন্য । বেটার কিছু না পাওয়া অবধি এটা চলুক । বাবার কাছে পকেটমানির জন্য হাত পাততে হয় না অন্তত ।
স্কুল থেকে বেরোবার সময় তিতু কাউকে জুটিয়ে নেয় পাশাপাশি হাঁটার জন্য,
যাতে
ছেলেটাকে কাটানো যায় । তাও দুএকদিন একাই বেরোতে হয়, মোনালি সিএল,
মেডিক্যাল নিলে
ওই রাস্তায় তিতু একা । ওদের বাড়িটা হাইরোড ঘেঁষা প্রায় । দুপুরের দিকে রাস্তা
মোটামুটি ফাঁকাই থাকে । তখন প্রকাশ দাস বাইক নিয়ে পেছন পেছন আসে । প্রথম প্রথম
তিতু ভয় পেত । কিছুদিন দেখে বুঝেছে, এমনিতে ছেলেটা হার্মলেস । একটু
কি দুর্বলতাও তৈরি হচ্ছে নাকি ? ধুস,
তিতু নিজের
মনেই লজ্জা পায় । এমনিতে ব্যাপারটা নিয়ে স্কুল কমনরুমে সমবয়সীরা ক্ষ্যাপায় ।
সিনিয়ররা মুচকি হাসে, মুখে কিছু বলে না অবশ্য । মাস ছয়েক ধরে এই
লুকোচুরি খেলা চলছে । লোকে কি ভাবছে, কে জানে ! তিতুর অস্বস্তি হয়,
মাঝে মাঝে
ইচ্ছে করে, সটান ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে বলে দ্যায়,
মানে মানে কেটে পড়ো তো বাপ,
নইলে পাড়ার
দাদাদের দিয়ে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব‘ !
কিন্তু হয়ে
ওঠে নি । ছেলেটার হ্যাংলামি ও যে একটুও উপভোগ করে না,
তা কি বুকে
হাত দিয়ে বলতে পারবে ? তিতু ধন্ধে পড়ে যায় ।
এবারের এস এস সি টা লেগেই গেল ।
কিন্তু পোস্টিং বাড়ি থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে এক গণ্ডগ্রামে । তিতু দোনামনা করতে
লাগলো । স্কুলে সবাই বলল, লিয়েন নিয়ে যেতে । করে দেখুক কিছুদিন ।
ভালো না লাগলে,কি আর করা। পুনর্মূষিক ভব । স্কুল থেকে ওকে ফেয়ারওয়েল
দেওয়া হোল, বই, পেন,
ফুল,
মিষ্টি ।
কদিন পর সাথিদি বড়দির কাছে শোনে, তিতু ফোন করেছিলো । ভালো লাগছে
না । কোএড স্কুল । হেডমাস্টারমশাই মেয়ের মত স্নেহ করেন । কিন্তু কি যেন মিসিং ।
হঠাৎ একদিন শোনাগেল তিতু ফিরে এসেছে । মন খারাপ
লাগছিলো,কোন কিছু কাউকে না জানিয়েই বাড়ির গাড়ি ধরেছে,স্কুলে আসতে লজ্জা পাচ্ছে । যেখান
থেকে একবার ফেয়ারওয়েল নিয়ে গিয়েছে আবার সেখানেই ফেরা,
সবাই হয়তো
হাসাহাসি করবে । আবার সবাই বুঝিয়ে বাঝিয়ে জয়েন করাল । ঐ স্কুলে বাইপোষ্ট রেসিগনেশান
লেটার পাঠিয়ে দেওয়া হোল । হেডমাস্টারমশাই খুব দুঃখ করলেন,
একজন ভালো
শিক্ষিকা এসেও থাকলো না তাঁর স্কুলে । এর কদিনের মধ্যেই ওরা তিতুর বিয়ের নেমন্তন্ন
খেয়ে এল । তিতু প্রকাশকে বিয়ে করেছে , সবাই মুচকি হাসল । এই তাহলে
তিতুর ওখানে মন না টেকার কারণ ! তলে তলে এই , আর মুখে বলতো কিনা ... ! অবশ্য
প্রকাশ পাত্র খারাপ না । তিতুর সাথেই এসেসসি পেয়ে জয়েন করেছিল এখানকার একটা স্কুলে
। প্রাইভেট টিউটর হিসেবেও নাম করছে বেশ ।
স্কুলের ওরা গিয়ে দ্যাখে বডি
ততক্ষণে ম্যাটাডোরে তোলা হয়ে গ্যাছে । পান পাতার মত মুখ টলটলে অবিকৃত,
মাথাময়
সিঁদুর লেপা । লোকজন ভিড় করে আছে । পাশেই একটা বাজার ।
ছোটো একটা দু কামরার বাড়িতে ভাড়া গিয়েছিল তিতু আর প্রকাশ কিছুদিন আগে । রাস্তার
পাশেই বাড়ি হওয়ায় পথচলতি মানুষজনও কৌতূহলে ভিড় জমিয়েছে । ওর বাপের বাড়ির তরফে
কাউকে অবশ্য চোখে পড়লো না , এমনকি প্রকাশকেও না । অবশ্য তখন অবাক হবার
মতো অবস্থা ছিল না ওদের । জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছিলো না খবরটা । খালি মনে হচ্ছিলো
হয়তো বা একই নামে অন্যকেউ হবে । ওর মুখটা দেখার পর খানিকক্ষণের জন্য যেন স্থাণু
হয়ে গেছিলো সকলে । হঠাৎ নীরবতা ভেঙে ডুকরে উঠলো সাথীদি । প্রথমে কান্না,
তারপর অভিশাপ
ঝরে পড়ছিল ওর ক্রুদ্ধ বিলাপে ।‘মেরেই ফেলল মেয়েটাকে ওই শয়তানটা,কতদিন বলেছি,
চলে আয়,
থাকতে হবে
না আর ওর সাথে, তখন শুনল না, এইভাবে মেরে ফেলল মেয়েটাকে’। ভিড়টা সচকিত হয়ে এবার মুখ
ফেরাল এদিকে । আস্তে আস্তে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে জনা পনেরোর দলটা উগড়ে দিতে
লাগলো এতদিনের জমা রাগ । একেকজনের কথায় বেরিয়ে আসতে লাগলো অন্যের অজানা তথ্যও ।
ভিড়ের থেকেই এক সুবেশা মহিলা মৃদু প্রতিবাদ করে বোঝাতে চাইলেন,
‘ খুন
নয়, এটা আত্মহত্যা । প্রকাশ খুব ভালো ছেলে । তিতুরই বরং অনেক
অসুবিধে ছিল । মাথা খারাপ ছিল, বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিলো না ,
ডিপ্রেশনে
সুইসাইড করেছে’ । খাঁ খাঁ করে উঠলো সাথিদি । ‘
আপনি কি
জানেন ? তিতু আমাদের কলিগ, এতবছর চাকরি করছি এক ইস্কুলে,
আমরা
জানলাম না, আপনি কোথাকার কে, জেনে গেলেন তিতু
পাগল’ ? মহিলা আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন,
উনি
প্রকাশের কেমন একটা তুতো দিদি । সেই শুনে আরও ক্ষেপে উঠলো এই দলটা । মহিলা মানে
মানে সরে গেলেন সেখান থেকে । এতক্ষণে ওদের নজরে পড়লো ,
বাড়ি থেকে বিশপঁচিশ
গজ তফাতে একটা বাড়ির রোয়াকে একটা ছোটোখাটো জটলা । প্রকাশ ওখানে বসে আছে । শোকে
নাকি ফিট হয়ে গেছিল । সবাই মুখেচোখে জলটল দিয়েছে । চরম ঘৃণায় ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে
নিলো দলটা । প্রিয়া মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠলো, ন্যাকামি হচ্ছে ! বউকে মেরে ঝুলিয়ে রেখে উনি ফিটের নাটক
করছেন’ ! সায়ন্তনি সেখানে উপস্থিত সাংবাদিককে অনেক কষ্টে ওয়ার্ড
কাউন্সিলর আর তার দলবলের খপ্পর ছাড়িয়ে এদিকে টেনে আনল । তার কাছেই জানা গেল
আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে গলায় দড়ি দিয়ে । বলা হয়েছে তিতুর মাথার গণ্ডগোল ছিল ।
ট্রিটমেন্ট চলছিলো ডিপ্রেসনের । ওরা সমস্বরে প্রতিবাদ করে উঠলো ,আত্মহত্যা নয় ,
এটা হত্যা
।
তিতু দুদিন আগেও ফোন করেছিলো
সন্ধ্যাদিকে । জানিয়ে ছিল কিছু কথা । ওরা সেসব বলতে চায় । এরমধ্যেই ওসি বেরিয়ে
এলেন ঘর থেকে । তাকে ব্যারিকেড করে রেখেছে পার্টির ছেলেপেলে । না এই পার্টি তিতু
বা প্রকাশের সমর্থিত নয়, বরং বিরুদ্ধ বলেই জানে ওরা । একটা আশঙ্কা
দানা বাঁধল । ওরা কিছু বলবে বলে এগোতে গেল অফিসারের দিকে । পারলো না ভিড়ের চাপে ।
তার আগেই পুলিশের গাড়িটা স্টার্ট দিয়েদিল । ওদের মধ্যেই নাছোড় দু একজন পেছন পেছন
ছুটতে শুরু করলো । সে এক দৃশ্য । আগে আগে পুলিশের গাড়ি । পেছনে দু তিনজন মহিলা হাততুলে
‘ থামুন থামুন’
বলতে বলতে
দৌড়চ্ছে । লোকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে । খানিকদূর গিয়ে গাড়িটা দাঁড়ালো,
ওরা
জানালার কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সমস্বরে জানাতে লাগলো
‘আমাদের
কথা শুনুন, তিতুর মৃত্যুর ব্যাপারে আমরাও কিছু বলতে চাই’ । মহিলা
পুলিশটি বললো, ঠিক আছে ,
আপনারা
থানায় আসুন।
মুনাই এর বিয়ে ছিল সেদিন । তিতু
আর পূবালী প্রথম ব্যাচেই খেয়ে নিলো । ওর স্কুলের আর সবাই তখনো পৌঁছয়নি এসে । বড়দির
কাছে গিফট । সেটা দেওয়া হলে ওরাও বসে যেতে পারতো । ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর ছুঁতেই
প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলো তিতুরা । বাকি কলিগরা পরদিন ব্যাপক পেছনে লেগেছিল,
‘ কি
রে, তোর বাচ্চা বরটা কি একলা একলা ভয় পায় নাকি
সুন্দরী বউ ছেড়ে একমুহূর্তও থাকতে পারে না ?’ তিতুর চোখমুখ বসা,
চোখের তলায়
কালি । ম্লান হেসেছিল । পরে পূবালী ওদের বলেছিল, বিয়েবাড়ি যাবার জন্য প্রকাশ
সেদিন ওকে ব্যাপক মারধোর করেছে । এমনকি ওর বেনারসিও ছিঁড়ে দিয়েছিল,
ভেঙ্গে দিয়েছিল
মোবাইল ! রমিতার সাথে সবচেয়ে ফ্রি তিতু । রমিতাকে পিঠের ব্লাউস সরিয়ে তিতু
দেখিয়েছিল প্রকাশের বেল্টের দাগ , চামড়া কেটে বসে গ্যাছে ।
গুমোট গরমেও রান্নাঘরের জানালা
খুলতে পারে না তিতু , পাশেই রাস্তা ,
লোকে নাকি
তিতুকে দেখতে দেখতে যাবে , তাই । খুব গরম নেই অথচ চাকা চাকা ঘামাচিতে ভরে গ্যাছে তিতুর ফর্সা
সুন্দর ঘাড় আর পিঠ । সরস্বতীপুজোর আগের দিন মিলিদির সাথে ব্লাউজের দোকানে দেখা । বলল,
‘রাতে পরার জন্য নতুন সোয়েটার কিনেছি,
দিনের বেলা
পরবার জন্য নতুন শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ কিনতে এসেছি। প্রকাশের স্কুলের পুজো
দেখতে যাব’ । সাজতে ভালবাসে তিতু । আগে নিজের স্কুলে
এল । প্রসাদ খেল, ছবি তুলল সবার সাথে । বলে গেল,
‘আমাকে
কিন্তু কপি দিও ছবির’। এর কদিন পরই তিতুর প্রাইমারি স্কুলের
চাকরিটা হয়ে গেল । তিতু খুব খুশি । বন্দনাদিকে ফোনে খবরটা দিল প্রথম । সেদিন মাধ্যমিকের
ভূগোল পরীক্ষা । গার্ড দিচ্ছে বলে সবার মোবাইল অফ । বন্দনাদি রিসার্ভ ছিল ।
ওইই স্কুলের সবাইকে খবরটা দিল । যাক, মেয়েটার একটা হিল্লে হল শেষপর্যন্ত
। সেটাই শেষ কথা তিতুর সাথে, আর আজ তিতুর মৃতদেহ চলে গেল ওদের
চোখের সামনে দিয়ে । পরদিন স্কুলে তিতুর বাবা এলেন । বড়দি ওনাকে কমনরুমে নিয়ে এলেন
। ভদ্রলোকের নুয়ে পড়া চেহারা দেখতে দেখতে ওদের বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করতে লাগলো ।
ওরা জানালো, ‘কাল আমরা থানায় একটা মাস পিটিশন দিয়ে এসেছি ,
এই
হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে’ । ওনার চোখে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল । বড়দির
হাতধরে বললেন, ‘আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম সবকিছু,
দোষী শাস্তি
পাক, আমার মেয়েটার আত্মা শান্তি পাবে তাহলে ...’
। ওদের
মুঠো প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হল ।
দিনকুড়ি পালিয়ে থাকার পর প্রকাশ আত্মসমর্পণ করলো । কিন্তু তৎক্ষণাৎ জামিন পেলো
না । আড়াইমাস মতো জেলে থাকতে হল । এদিকে পার্টির চাপ আসতে লাগলো টিচারদের ওপর
ওয়ার্ড কমিশনারদের মারফৎ মামলা তুলে নেবার জন্য । ওরা বুঝতে
পারলো , প্রকাশ বাঁচার জন্য অপনেনট পার্টির শরণাপন্ন হয়েছে ।
লোকাল এক পত্রিকা সম্পাদক জানালেন,তিতুর বডি সেদিন প্রভাব খাটিয়ে
পোস্টমর্টেম না করেই তড়িঘড়ি দাহ করে দেওয়া হয়েছে । এমন কি যে ঘরে ওরা ভাড়া থাকতো, সেই ঘর পুলিস সিল করার বদলে
রাতারাতি চুনকাম করে ফেলেছে । এসবের মধ্যে একমাত্র আশার আলো,
ওদের
পনেরজনের স্বাক্ষর করা অভিযোগপত্রটা । কেবলমাত্র ওই প্রাইমাফেসির ভিত্তিতে মামলা
চলতে পারে । থানা থেকে ডেকে পাঠাল ওদের মধ্যে যেকোনো দুজনকে । সাথিদি আর
বন্দনাদিকে বাছল ওরা । এর মধ্যে স্কুলগুলোর থেকে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করার কথা উঠেও
থমকে গেল অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে । ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দী দিয়ে এলো
দুজন । তার ওপর মামলা রুজু হল । এর মধ্যেই একদিন তিতুর বাবা জানালেন,
‘কি করি
বলুনতো, সরকারী উকিল বলছে, এই মামলা চালিয়ে কোন লাভ নেই,
কোন প্রমাণ
নেই স্বপক্ষে’ । ওরা পরামর্শ দিলো ব্যক্তিগত উকিল নিয়োগের । দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে
গেল । রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টে প্রকাশের উকিল তিতুর এই স্কুলের সার্ভিসবুক চেয়ে
পাঠাল । বড়দি সব রেডি করে সেক্রেটারিকে খবর দিলেন । সেক্রেটারি এসে চিঠিটা খুঁটিয়ে
দেখে বললেন , ‘আরে এটা তো ভুয়ো চিঠি, উকিল সেজে যে কেউ এমন পাঠাতে
পারে,আপনি ভালো করেছেন আমাকে দেখিয়ে’। এর পর শুরু হোল সাথিদির
বাড়িতে হুমকি ফোন ।
এর মধ্যেই একদিন প্রকাশের দাদা সাথিদির সাথে দেখা করতে চাইলেন,
ফোনে ইনিয়ে
বিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘যা গেছে তা গেছে, আর এসব করে কি লাভ ?
মামলা তুলে
নিন, ছেলেটার গোটা জীবন পড়ে আছে’ । সাথিদি স্কুলে এসে কথাটা জানাতেই
কমনরুমে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো, ‘কক্ষনো না, আমরা শেষ দেখে ছাড়বো,
একটা খুনের
কোন প্রতিকার হবে না তা কি করে হয় ? আমরাও তো কন্যাসন্তানের জন্ম
দিয়েছি, এই ঘটনা যদি আমার মেয়েটার সাথে ঘটত তাহলে কি আমরা এত সহজে
হাত ধুয়ে ফেলতে পারতাম’ ? সময়ের সাথে সব ঝিমিয়ে পড়ে । রুটিন জীবনের
ঘানি টেনেটেনে ফিকে হতে থাকে আবেগ । তিতু রয়ে যায় কমনরুমের গ্রুপছবিতে,স্কুলের কোন অনুষ্ঠানের
স্মৃতিতে । কোনকোন বধূহত্যার খবরে মনে পড়ে ওর কথা । প্রকাশ ইদানিং বাইকের পেছনে
মেয়ে নিয়ে ঘোরে । বড়সর নেতাও নাকি হয়ে উঠেছে । সাথিদির বাড়িতে হুমকিফোনের ফ্রিকোয়েন্সি
কমে আসে । ম্যানেজ হয়ে গেল সবকিছু ?
ভাবতে ভাবতেই একদিন মামলার ডেট আসে । তিতুর বাবার সাথে যোগাযোগ করা হোল স্কুলের
তরফ থেকে । শিক্ষিকাদের সাক্ষ্য দিতে হবে । উনি ফোনে ইতস্তত করতে লাগলেন । স্কুলের
এক ক্লার্ক কে অবশেষে তাঁর বাড়িতে পাঠানো হোল । সে এসে খবর দিল,
তিতুর মা
পুরো আলাভোলা । তাঁর কোন মতামত বোঝার উপায় নেই । ভাই কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত । সে
এখানে আসতে পারবে না এখন । আর বাবা বলেছেন, ‘ভেবে দেখলাম,
আমার
মেয়েটাতো আর ফিরবে না, কি হবে আরেকটা জীবন নষ্ট করে ? তাছাড়া আমার আরেকটা ছেলে আছে,
সে বাইরে থাকে,
তার
নিরাপত্তার কথাও তো আমাকেই ভাবতে হবে, আমার বয়েস হয়ে যাচ্ছে,
কথায় বলে
উকিল ছুঁলে আর রক্ষা নেই ! আমি আর চালাতে পারবো না এই মামলা,
কেস তুলে
নেব’ । কমনরুম নিস্তব্ধ একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে যেন ! ফ্যানের হাওয়ায় ক্যালেন্ডারটা খালি লটপট করছে । দেয়ালে
তিতুর গ্রুপছবি । তিতু হাসছে । খুব সেজেছিল সেদিন । শেষ দ্যাখা ওদের সাথে । তিতু
বিদায় জানাতে এসেছিল, তিতু নিজেও বোধহয় ভাবেনি সেকথা !
প্রকাশের বাড়ির পাশ দিয়ে রোজ
যাতায়াত করতে হয় কুন্তলাকে । কদিন পর খবরদিল, বাড়ির গেটে শোলার বধূবরণ ঝুলছে
। এই স্কুলের কেউ আর এবার নেমন্তন্ন পায় নি ।