গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৪

সাঈদা মিমি

 ঘূণ

হরিরামপুর চরে যে লাশটা পড়ে ছিলো, গেলো সন্ধ্যায়ও তাকে দেখা গেছে পিয়ারের দোকানের পিছনে ফেন্সিডিলের বাক্সের হাতবদল করতে, পাড়া জ্বালানো কেতু মিয়া যে ছয়জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো তারা কেউই এই খুনের সাথে জড়িত ছিলো না, তবুও হ্যাঁ, এদের সবার সাথেই কেতু মিয়ার শত্রুতা ছিলো, পুরো গ্রামের কার সাথেই বা সখ্যতা ছিলো তার! হেনস্তায় পড়লো ছয় আবাগীর বেটা হেতু কি? কয়েকদিন আগেই নালুই গঞ্জের হাটে ওদের সঙ্গে মারপিট হয়েছে কেতু মিয়ার, মারপিটের কারণ নারীঘটিত, হাশর মিয়া, যে এই মামলার প্রধান আসামি, তার বৌকে লুকিয়ে দেখেছে সে ঘাটে স্নানের সময় সেটা গোপন থাকতো যদি গোপনেই কেতু সরে আসতো, তা না করে ফেরার পথে বৌটার ভেজা আঁচল ধরে টান মেরেছে

সন্ধ্যাগাঙ  গ্রামের মানুষগুলো সত্যিকারেই সন্ধ্যা শুরু হতেই ঘরমুখো, ব্যতিক্রম রয়েছে, সবকালেই ছিলো এখানকার মানুষ বড্ড হুক্কা খায়, খাবেই তো, হুক্কা কিংবা পাতার বিড়ি, পরিশ্রমের গতরে আলাদা শক্তি তৈরি হয় লুকিয়ে কেউ গাঁজা খায়, সংখ্যাটা বেশি নয়, এসব দুরকালের কথা এখন এইগ্রামের মানুষ ডিস টিভিতে বিশ্ব দেখে, নগ্ন ছবি, অনেকেই গজ্ঞ্জের,গোপন পথ চিনে গেছে, কিশোরীরা আগের মত নিশ্চিন্তে পথ চলতে ভয় পায়, অনেকেই বিবিধ আক্রমণের শিকার হয়ে বসে

প্রকৃতি বদলায়নি, মানুষগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে, বিশেষ করে তরুণেরা, এদের গুরু কেতু মিয়া, নেশার  ওষুধগুলোর লোকাল ডিলার সে কেতু মিয়া লোকটা কখনই সজ্জন ছিলো নাচেয়ারম্যান, মেম্বার, জোতদার, মাতবর, সবারই নেক নজর তার ওপর আছে আর তার বদনজর গ্রামের উঠতি বয়সী মেয়েগুলোর ওপর, স্বপ্নবাজ যুবকদের ওপর

কিন্তু কেতু মিয়া কে খুন করলো কে? ছয়জন নয়, কোন প্রমাণ মেলেনি বালির চরে যেসব চিহ্ন ছিলো কিংবা কেতুর দেহে নখের দাগ, তার কেটে নেয়া অণ্ডকোষ একটা প্রশ্নেরও জন্ম দেয় এইরকম যখন ফিসফাঁস সারা সন্ধ্যাগাঙ তোলপাড় করছে, তখন হারিছা বেওয়ার ঘরে পাওয়া গেলো রামদা টাসেটা কোন বড় প্রমাণ নয় কিন্তু মাত্র বাইশে বিধবা হওয়া হারিছা ছিলো কেতুর নিজস্ব মেয়েমানুষ সুতরাং পুলিশ তাকে জেলে পুরে দিলো
, আমিই খুন করছি কেতুরে, হারিছা চিৎকার করে বলেছিলো এই স্বীকারোক্তিতে কেউ অবাক হয়নি, এটা সম্ভব হারিছার কন্ঠ ক্রমশ সপ্তম মাত্রায় প্রবেশ করছিলো, আমি খুন করছি, কেন করুম না ? আমারে নষ্ট কইরা ওর সুখ মিটে নাই ? আমার মাইয়াডার দিকে হাত কেন বাড়াইলো ?
সন্ধ্যাগাঙের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত হাওয়ার বেগ সু নাকি কু তা বোঝার জন্য একটা খাঁচা পালানো টিয়া গেরস্থের লাল মরিচটা চুরি করে উড়ে গেলো



একটি রাতছবি

গভীর রাতে যখন বেওয়ারিশ কুকুরগুলো কাঁদে অথবা রাতপাখিরা ছটফট করে ওঠে, ঠিক সোয়া একটায় একজন মানুষ সামনের বাড়িটার চাঁতালে পোটলাপুটলি খুলে খায়, তারপর চিটচিটে চাদরটা বিছিয়ে জিকির করতে করতে ওখানে ঘুমিয়ে পড়ে, দুটো ভিন্নরঙের বাচ্চা নিয়ে মা বেড়ালটা গোল হয়ে শুয়ে থাকে, কাছের সাততালায় ছাদে কবুতরের ঘর, কেমন যেন গলার ভেতর আটকে রেখে ওরা ভুতভুতুম ডাক তোলে! ঠিক উত্তর ঘেঁষে দাঁড়ালে কোন আড়াল নেই, উদোম লেক, রাতবাতির চিমসে আলো মিহিন ঢেউয়ের ওপর কাটিকুটি খেলে, নিশাচর কতেক দুপেয়ে প্রায় সারারাত বসে থাকেনেশা করে, কখনো উচু স্বরের দরবাজি, ভিন্ন মাত্রার গান, পলিথিন আর পরিত্যাক্ত টিনঘেরা কতেক ঘরে অচেনা মানুষজনের আনাগোনা শুরু হয়, আর সারাদিনের বর্জ্যগুলো থেকে একটা উদ্ভট গন্ধ বোঁটকা বাতাসের সঙ্গে নাইট্রোজেন বিলিয়ে চলে, নাইটগার্ড মানুষটা বৃদ্ধ, কিইবা করার আছে লোকটার? কেউ তাকে শোনে? সে বাঁশিটা গলায় ঝুলিয়ে ঝিমায়, হঠাৎ কোন নেশাতুর কন্ঠের হুংকার, ‘ওই গণি, ফুঁ দে,’ অমনি সে ধড়মড় করে জেগে হুইশেল বাজায়, সবুজ রঙের জলপোকাগুলির কামড়ে চামড়া জ্বলে ওঠে, সব ঘরগুলির বাতি নিভে গেছে, কেবল সিঁড়িঘর বাদে , পাশের বাড়ির চিলেকোঠায় একজন মানুষকে গাঢ় অন্ধকার বুকে নিয়ে রোজ বসে থাকতে দেখা যায়, দিনের আলোতে কোনদিন তাকে দেখা হয়নি

প্রহর ঢলছে, রাতপাখিরা বিশ্রামে যাবে, গণি বুড়ো বসার ভঙ্গিতেই ঘুম, কুকুরের দল গুটিশুটি; উৎকর্ণ কান, কবুতরদের সাঁড়া নেই, বস্তিপাড়া সুনসান, ঘোরলোকের মানুষেরা কখন যেন ফিরে গেছে, নিঃসঙ্গ শিরিষের বুকে তখনো কালচে আভা, হঠাৎ বাতাস পলকা হয়ে ওঠে, নিমফুলের মসৃণ ঘ্রাণে ঘর ভরে যায়।