গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৪

নন্দিতা ভট্টাচার্য


পরীক্ষার খাতা

মার্চ-এপ্রিল মাস শুধু ব্যাংক বাবুদের নয় কেয়াদেরও ভারী হুজ্জতির মাস । ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই শুরু হয়ে যায় পরীক্ষার পালা । মাধ্যমিক , উচ্চমাধ্যমিক , স্কুলের পরীক্ষা সব মিলিয়ে একেবারে নাকানি চোবানি । এখন আবার কড়াকড়ির শেষ নেই । সুতরাং সব সময় তটস্থ । এই বুঝি কেস হল । এক্সামিনারদের ঠিকানা বাড়ির কাছে নয় । দূরে দূরে । মাঝে মাঝে পাল্টাতে হয় কাছে আনার জন্যে । এক একজনের ধারা আবার এক এক রকম । বেশ মজাই লাগে কেয়ার । সংসার সামলে এই খাতা যেন বোঝা হয়ে ওঠে। তবুও বাপু সরকারী কাজ । এতগুলো ছাত্রের ভবিষ্যৎ সেটাই মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে । বড়টি এবার ক্লাস নাইন , ছোটটি মটির সঙ্গে কথা বলছে । তিনি তো ডাক্তার তাই বাড়ির জন্যে সময় কোথায় , তাই সবটাই কেয়ার মাথায় । এবারও যথারীতি ডিসেম্বরের শেষে ডাকে পৌঁছে গেছে কবে কবে খাতা আনা নেয়া জমা দেবার খতিয়ান । এক্সামিনারের ফোন ও এল দু একদিনের মধ্যেই । এবারও বদলেছে । যাক গে বাড়ির কাছেই । অসুবিধে নেই । চৈত্রের কাঠফাটা রোদে যেতে হবে খাতা আনতে ভাবলেই গায়ে জ্বর আসছে কেয়ার । সামনেই একটা বিশাল ফ্লাইওভারের কাজ হচ্ছে । এই রোদের মধ্যে মাথায় গামছা জড়িয়ে কাজ চলছে । এক্সামিনার ছেলেটি খুব ভদ্র । খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে নিয়ে গেল । ১০ দিনের মধ্যে ১০০ খাতা দেখে দিতে হবে । বেশীরভাগই প্রত্যন্ত গ্রামের খাতা । প্রত্যেকবারই খাতার প্যাকেট খুলে এক অদ্ভুত অনুভুতি হয় কেয়ার । মনে হয়ে সবাই একে একে এসে ওর সামনে দাঁড়ায় ।


ভারতের সমাজ কাঠামোকে ও চোখের সামনে দেখতে পায় কেয়া। বুঝতে পারে সবাই প্রায় ফার্স্ট জেনারেশন পড়ুয়া । তেমন খাতাই আসে । সব পদবীর মধ্যেই ঢুকে আছে সমাজ । মণ্ডল সেখ খাতুন নাহার হেমব্রম মুর্মু মারান্ডি । এক সেট ছেলেদের , এক সেট মেয়েদের । ছেলেগুলো দেখ দিব্যি এধার ওধার থেকে যোগাড় জন্তর করে তিরিশ কেউ কেউ প্রায় যোগাড় করে নিচ্ছে । বেশিরভাগই নয় । মেয়েগুলোর তাও ক্ষমতা নেই ...শেফালি মুর্মু --কি রে প্রশ্নের নম্বর গুলোও ঠিকঠাক মতো দিতে পারিস না । তাতে কি খুব খাটুনি হয় ? দেখ হাতে নখ কাটছে । উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল কেয়া । আস্তে আস্তে দাওয়ায় উঠল । বারান্দার মধ্যে রান্না । দুখানা ঘর । এক দিকে হেলে আছে । বাবা কোথায় কাছেই কাজে গেছে । মা ধান ভানে । মদ খেয়ে পড়ে থাকে বাপ । আধাদিন কাজে যায় না । তারমধ্যে তিন চারটে ভাইবোন । ওই বড় । --- আমিনা ... বাইরে থেকে ডাক দিল কেয়া । যা শিখেছ মা । তাই লিখছ । প্রশ্নটা তে কি চাইছে একবার পড়েও দেখিস না । তা তুই যা মুখস্ত করেছিস , তাই লিখলে নম্বর পাবি মা ? কাকে বলবে !! কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে । উঠোনে আরও বাচ্চারা খুটে খাচ্ছে ... মুরগি চরে বেরাচ্ছে এধার ওধার ...... শেখর হেমব্রম ... কি রে একেবারে তিরিশ টায়ে টায়ে । তা বন্ধুর থেকে টুকে যে লিখলি , ভুলটাও টুকে নিলি । ট্রু ও ফলস্‌ এক্কেবারে জলের মত মিলিয়ে লিখলি ? ভুল ও টুকলি , শুদ্ধও টুকলি ? বিছানার ওপরে ছড়ান খাতা নিয়ে কেয়া ... আজ ওর একটিও খাতা দেখা হয়ে ওঠেনি ...