গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৪

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী


ধর্মের কল

            চরা গোরুকে বাঁধতে গিয়েই সর্বনাশটা হয়ে গেল! সনাতনবাবুর মাথায় ভূত চেপেছিল -  নাতিকে দেশি কালো গোরুর দুধ খাওয়াবেন। বুড়ো মানুষগুলো নিয়ে এটাই বিপদ নিজের সময়ের খোলস ছেড়ে আর বেরোতে পারে না। আজকাল কতরকম প্যাকেটের দুধ বাজারে। তাদের কতরকম গুণাগুণ। ডাক্তাররা তো লিখেই দিচ্ছে অমুক ব্র্যান্ড তমুক ব্র্যান্ডের দুধ খাওয়ান। তা না, গোরুর দুধই খাওয়াতে হবে! নইলে নাকি ব্রেনের পুষ্টি হবে না। ডাক্তারদের আর কী কোম্পানির থেকে টাকা খাচ্ছে আর লিখে দিচ্ছে! তোমার নাতি হাবা হোল কি গোবা হোল, তাদের বয়েই গেল। তা গোরুর দুধই যদি খাওয়াবে খাটালে গেলেই হয়। তা- চলবে না। খাটালে নাকি সব বিদেশি গোরু হলস্টেইন, জার্সির ইনজেকশন দেওয়া দুধ। সেসবে পুষ্টি হোক বা না হোক, অসুখ হওয়াটা অবধারিত কাজেই সনাতনবাবু বেরিয়ে পড়লেন গাঁয়েগঞ্জে। কদিন যাওয়া আসা করে জোগাড়ও করে ফেললেন দেশি গোরু, সঙ্গে তার দুমাসের বাচ্চা। দিব্যি চকচকে কালো রঙ। গায়েগতরেও মন্দ না। বয়স সবে আড়াই। এই প্রথম বার বিইয়েছে। সনাতনবাবু যে ফড়েটিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সে গোরুর চোয়াল ফাঁক করে দাঁত-টাত দেখে বলল, বয়েসটা ঠিকই আছে। মালিক চাষি মানুষ। বলল, - গরীব লোক আমরা, ঠিকঠাক খাবার দিতে লারি। জঙ্গল-লাগা গাঁ। সকালের দুধটা দুয়্যে লিয়ে ছাড়্যে দি। বিকাল তক জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুর্যে ঘাস-পাতা খায়্যে বেড়ায়। সইন্ধ্যার সময় গুয়ালে বাঁধ্যে  ওই যা হোক একটু খড়-বিচুলি দিয়ে জাবনা মত কর্যে দি। সঙ্গে দুবেলা একটু নুন মাখানো ফ্যান। ওই  খাবারেই এক সের কর্যে দুবেলা দুসের দুধ দ্যায়। তবে দুধ লয় তো বটের আঠা! এই খায়্যে দেইখবেন   আজ্ঞ্যা আপনের লাতি বড় হয়ে রবি ঠাকুর কিংবা অমত্তো স্যান হবে। হতেই হবে

পৌঁছতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। তাই দুধ দুইয়ে আর পরখ করা গেল না। তা না হোক, বেশ পছন্দই হয়ে গেল সনাতনবাবুর। কেবল শিং-দুটি নিয়ে একটু খুঁতখুঁতুনি রয়ে গেল। আকারে ছোট হলে কী হয়, বড্ডো সূচালো! মারকুটে হলে মুশকিল। তা মালিক বলল, -  না না, মোট্টে মারকুটে লয়। উয়ার নাম লক্ষ্মী, গুণেও লক্ষ্মী। একটা বাচ্চা ছেল্যাও উয়ার দুধ দুইতে পারব্যেক, ল্যাজটুকুও লাইড়ব্যেক নাই। 

অগত্যা এক গুচ্ছের টাকা দিয়ে সেই গোরু কিনে ফেললেন সনাতনবাবু। ফড়েবাবু বাচ্চা সমেত গোরুকে তিরিশ মাইল পথ ঠেঙিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল সনাতনবাবুর বাড়িতে। বাড়ির পেছনের বাগানে আগে থেকেই গোরু রাখার জন্যে কঞ্চির দেওয়াল আর টিনের চালা দিয়ে গোয়াল তৈরি করিয়েই রেখেছিলেন সনাতনবাবু। দুধ দোয়ার জন্যে খাটালে কাজ করা একটা ভাড়াটে লোকও ঠিক করা আছে। প্রথম রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। গোরুর খাবারও মজুত ছিল; ছানি-খইল-ভুসি,  সঙ্গে তাজা ঘাসও। কদিন ধরে খাটালে গিয়ে গিয়েই সব জেনে বুঝে ব্যবস্থা করেছিলেন সনাতনবাবু নিজেই। সব নিয়ে গত এক মাস ধরে তাঁর ব্যস্ততার শেষ ছিল না। পল্লব অসহায়ের মতো সব দেখে গেছে আর মায়ের কাছে গিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষতে বাবার পাগলামির হিসেব দিয়েছে। মা বলেছে, - আমাকে বলতে এসেছিস কেন, মুরোদ থাকলে যাকে বলার তাকে বল।

তা সেই মুরোদ পল্লবের নেই। পশুর জোর গায়ে, আর মানুষের জোর ট্যাঁকে। বাবা রিটায়ার করলেও সরকারের ঘর থেকে যে পরিমাণটা প্রতি মাসে তাঁর ট্যাঁকে ঢোকে, পল্লবের রোজগার তার আদ্ধেকও নয়। অপারে সপারে তাকে বাবার কাছেই হাত পাততে হয়। বাবার বদখেয়াল বেমালুম হজম করাটাই অগত্যা তার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পরের দিন সকালে যখন রামলখন খাটালিয়া সনাতনবাবুর ব্যবস্থা মতো দুধ দুইতে এল আর সনাতনবাবু হৃষ্ট চিত্তে ঝকঝকে পেতলের বালতিটি তার হাতে ধরিয়ে দিলেন, পল্লব উদাসীন চোখে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল। সনাতনবাবু নিজে গিয়ে বাছুরের গলার দড়িটি খুলে দিয়ে উন্মুখ হয়ে গোরুটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাছুরটি লাফাতে লাফাতে গিয়ে তার মায়ের পালানে মাথা দিয়ে গোত্তা মারতেই কৃষ্ণধেনু আচমকা লেজটি তুলে ছরছর শব্দে মূত্রত্যাগ শুরু করল। সনাতনবাবু সরে যাওয়ার সময় পেলেন না। গরম গরম স্রোত তাঁর পাজামা ভেদ করে পেট থেকে দু-পা বেয়ে নামতে লাগল। তাঁর মুখে আর্ত স্বরে আরে ছ্যা ছ্যা শুনে পলবের উদাসীন দৃষ্টি উৎসুক হয়ে সেদিকে ফিরেই বাবার দুর্দশা দেখে বিলক্ষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এই হেনস্থাতেও বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে সনাতনবাবু রামলখনকে বললেন, - তুই দোয়া শুরু কর বাবা, আমি কাপড়টা ছেড়ে এখুনি আসছি।
পল্লবের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, - কী দরকার বাবা, গো-চোনা তো পবিত্র বস্তু।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সনাতনবাবু পালটা তির ছুঁড়লেন, - সেটা জানো বলেই বুঝি নিজের মাথাটি পবিত্রতর বস্তু দিয়ে ভরে রেখেছো!
পাজামা ছেড়ে কাছাহীন ধুতি পরে সনাতনবাবু যখন বেরিয়ে এলেন, ততক্ষণে বাছুরটিকে খুঁটিতে বেঁধে রামলখন দুধ দোয়া শুরু করেছে। বেশিক্ষণ লাগল না দুইতে; সনাতনবাবু উঁকি মেরে দেখলেন, দুধ বালতির তলাটুকু ছেড়ে আর ওপরে ওঠেনি। বললেন, - কী হোল বল তো বাবা, লোকটা যে বলেছিল এক বেলায় এক সের দেবেই; তো দেখছি পোয়াটাকের বেশি হবে না।
রামলখন বলল, - লোতুন জাগা তো সড়গড় হোতে থোড়া টাইম লিবে। দো দিন যাতে দিন, আচ্ছা আচ্ছা খানা খেয়ে লিলে মালুম হোতা দো-তিন পুয়া দিয়ে দিবে।
সনাতনবাবু চিন্তিত স্বরে বললেন, - কাল অতখানি রাস্তা জার্নি করে এসেছে তো টায়ার্ড তাই দুধটা খানিক শুকিয়ে গেছে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিক আজ, কাল দেখবি দু-তিন পোয়া নয়, পুরোপুরি এক সেরই দেবে।

বয়সটা তার যতই হোক, গো-চরিত্র নিয়ে সনাতনবাবুর এই মাতব্বরিটা পছন্দ হোল না খাটালিয়ার গোরু তাঁর হতে পারে কিন্তু তার দুধ দেওয়া, না-দেওয়া টা যে দোহালির এক্তিয়ারে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। সে বলল, - এক সের কুনোদিনো নাহি দিবে। ইয়ে সোব দিশি গায় খাবে যিতনা, লাদবে তার দো-গুনা। দেখা না, পহলেই এক বালতি মুতে দিল আপনের গায়ে। আউর পিসাব করতে করতে পালান কা আধা দুধ টেনে লিল আপনা পেটে। আভি দেখিয়ে, বাচ্চা ফির যেই ছেড়েছি, দুধ ছাড়তে লেগেছে বাচ্চা কে লিয়ে। আখন যদি ফির দুইতে যাই, ফের টেনে লিবে পেটে। ইসব গায় অ্যায়সাই আছে, কুনোদিন পুরা দুধ লামাবে নাই বাচ্চা কে লিয়ে আধা রাখবেই।

সনাতনবাবু আড় চোখে পল্লবের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তার চোখে মিটিমিটি হাসি। তর্ক বাড়িয়ে নিজের প্রেস্টিজ খোয়ানোর ঝুঁকিটা আর নিলেন না তিনি। জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, - সে রাখে রাখুক গে পোয়াটাক হলে কী হবে, দুধ দেখেছিস? একবার তাকিয়ে দ্যাখ, কী ঘন যেন বটের আঠা!
পল্লবের মুখ আবার ফসকাবার উপক্রম করছিল, কোনমতে সামলাল। এখন বেশ খুশির হাওয়া বইছে তার বুকে বেশ হয়েছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে!

উচিত শিক্ষার যে তখনো কতখানি বাকি সেটা সে ভাবতেও পারেনি তৃতীয় দিনের সেই সর্বনেশে  ঘটনাটায় শুধু তার বাবার নয়, তারও বুকটা শুকিয়ে গেল। দ্বিতীয় দিনটা ভালোই কেটেছিল। রামলখন সেদিন কৃষ্ণধেনুর বাঁট থেকে দু-পোয়া দুধ বের করে ফেলেছিল। উৎফুল্ল সনাতনবাবু পল্লবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, - এক থেকে দুই তোর কি মনে হয়, প্রগতিটা সমান্তর? না কি গুণোত্তর?
বেজার মুখে পল্লব বলেছিল, - সেটা আজ বুঝবে কী করে? অপেক্ষা করো, কাল প্রমাণ হয়ে যাবে।

তৃতীয় দিনে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল কৃষ্ণধেনুর প্রগতি চরিত্র। সকালবেলায় রামলখনের আসতে দেরি দেখে সনাতনবাবু নিজেই চালার খুঁটি থেকে দড়ি খুলে কৃষ্ণধেনুকে বের করে আনছিলেন বাগানে, দুধ দোয়ার জায়গায় বাঁধবেন বলে। টানা ছত্রিশ ঘণ্টা ঠায় এক জায়গায় আটকে থেকে জঙ্গলমহলের চরা গোরুর খুর যে সুড়সুড় করছে, তা তিনি বুঝবেন কী করে! চালা থেকে বেরোনো মাত্র সে তার একমাত্র লেজ দু-জোড়া পা একসঙ্গে শূন্যে তুলে একখানা হাই জাম্প মেরেই গেটের দিকে ছুটল। সেই হ্যাচকা টানে সনাতনবাবুর হাতের দড়ি ছিটকে বেরিয়ে গেল, তিনি সামনে মুখ থুবড়ে পড়লেন। পল্লব কাছেই ছিল। সে বাবাকে তুলবে, না তাঁর সাধের গোরুর প্রগতি আটকাবে স্থির করতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সনাতনবাবু নিজেই উঠেধর ধরবলে চিৎকার করতে করতে গেটের দিকে দৌড়লেন। গেট খোলাই ছিল। কৃষ্ণধেনু ততক্ষণে রাস্তায় নেমে মহাবেগে ছুটতে ছুটতে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সকালবেলায় রাস্তায় লোকজন কম। যারা আছে তারা সসম্মানে কৃষ্ণধেনুকে রাস্তা ছেড়ে দিতে দরকারে নর্দমাতেও নেমে পড়ছে। আর ঠিক এই সময়েই উলটো দিক থেকে রামলখন শশব্যস্ত হয়ে দুধ দুইতে আসছিল। তার দোহন-ভাণ্ডারটিকে এমন ঘোড়ার মত আচরণ করতে দেখে আর তার পেছনে অনেকটা দূরে পল্লবসহ সনাতনবাবুকে পড়িমরি করে ছুটে আসতে দেখে সে অসমসাহসে কৃষ্ণধেনুর পথ আগলে দাঁড়াল। সে বেচারা তো হলস্টেইন-জার্সির গোয়ালের লোক, দেশির জঙ্গিপনা আন্দাজ করবে কী করে! কৃষ্ণধেনু এতখানি পথ এসেও জঙ্গলের লম্বা গাছের বদলে সামনে একটা দু-পেয়ে বাটকুলকে দেখেই ক্ষেপে গিয়ে মাথা নিচু করে বাটকুলটাকে শিং দিয়ে তুলেই নিজের পিঠের দিকে ছুঁড়ে দিল। শূন্যে একখানা পারফেক্ট ভল্ট খেয়ে রামলখন চিৎপাত হয়ে পড়ল রাস্তার ধারে। ততক্ষণে কৃষ্ণধেনু  সামনে এগিয়ে গেছে অনেকখানি। সুতরাং হৈ হৈ করে সবাই ছুটে এল অকুস্থলে। সনাতনবাবু দৃশ্যটি দেখে আর এগোতে পারলেন না। নাতিকে দেশি কালো গোরুর ঘন আঠার মতো দুধ খাওয়ানোর আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে রাস্তার ওপরেই কেতরে বসে পড়লেন। পল্লব তাড়াতাড়ি লোকজন জুটিয়ে একটা ভুতভুটি ভ্যানে রামলখনকে তুলে হাসপাতালে রওনা হল। সনাতনবাবু কোনক্রমে উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, - বেঁচে আছে তো রে?

পল্লব দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিল, - তোমার সাধের গোরুর প্রগতি-চরিত্রটা বুঝতে পারলে তো সমান্তর গুণোত্তর কিচ্ছু না, একেবারে মরণোত্তর। এখন হাসপাতালে যাই, থানায় যাই। হাতে দড়ি তো পড়লই, এবার সেটা গলায় পড়ে কিনা জানার জন্যে ঘরে গিয়ে অপেক্ষা কর।

            হাসপাতালের উলটো দিকে কিছুটা রাস্তার আর বেশিটাই নর্দমার ওপর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা গুমটি। সওয়া বর্গফুট তাদের আয়তন। কিছু চা-জলখাবারের দোকান, কিছু পান-বিড়ি আর অধিকাংশই সেলুন। সেলুনওলারা সবই বিহারের ভোজপুর-চম্পারন জেলা থেকে আসা  নরসুন্দর। এখানে একটা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা আছে মাত্র। বাল-বাচ্চা সব দেশে। বছরে দু-তিন মাস পালা করে দেশে কাটিয়ে আসে। এদেরই একজন বাঁটু। নামটা পৈতৃক নয়, খদ্দেরদের দেওয়া। আতঙ্কবাবু বাঁটুর বাঁধা খদ্দের। খদ্দের এলে খুশি হয় না এমন ব্যবসায়ী বিরল। বাঁটুও সেরকম ব্যবসায়ী নয়। কিন্তু আতঙ্কবাবু সেই বিরল খদ্দের যাকে দেখলে যে কোন দোকানদার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাঁর নামটা যে পিতৃদত্তসে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই তবে আতঙ্কভঞ্জনের শেষ আদ্ধেকটা ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র প্রথম অংশটা সার্থক করতে ছেলে উঠে পড়ে লাগবে সেটা নিশ্চয়ই তিনি আন্দাজ করেননি। বাঁটু অতীতে চেষ্টার কসুর করেনি আতঙ্কবাবুকে অন্য সেলুনে পাঠাতে। কিন্তু তিনি সাবিত্রী-বেহুলার মতোই একনিষ্ঠ। বাঁটুর ধারণা, তার এন্তেকালের পর সে স্বর্গ কিংবা জাহান্নাম, যেখানেই যাক না কেন, আতঙ্কবাবু সেখানেই ছুটবেন চুল ছাঁটতে। তাঁকে অন্য সেলুনে পাঠাবার উদ্দেশ্যে বাঁটু প্রথমে আতঙ্কবাবুর সাধের গোঁফটিকে টার্গেট করেছিল। গোঁফের দুটি দিক দু-রকমের করে ছেড়ে দিত। কিন্তু আতঙ্কবাবু ছাড়ার পাত্র নন। নিক্তি মেপে সাইজ বুঝে নিয়ে তবে তিনি চেয়ার ছাড়বেন। তাতে অপেক্ষমাণ খদ্দেররা অধৈর্য হয়ে পালালে পালাক, তাঁর কিচ্ছু যায় আসে না। এই করতে করতেই একদিন বাঁটু আতঙ্কবাবুর গোঁফটিকে নিয়ে বাঁদরের পিঠে ভাগ করে দিল; -দিক -দিক দুদিকের ভাগে শূন্য, সবটাই গেল বাঁটুর কাঁচির পেটে। গোঁফ হারানোর খেদে আতঙ্কবাবু আর কখনো তার সেলুনে টিকি দেখাবেন না ভেবে বাঁটু আশ্বস্ত হয়েছিল। হরি, ঠিক পনের দিনের মাথায় তিনি হাজির! নিয়ম করেই মাসে দুদিন আসেন। চুলের সঙ্গে দাড়ি-গোঁফেরও ওই দুদিনই মাত্র ক্ষুর-কাঁচির মোলাকাত হয়। গোঁফ সাফ হওয়ার দিনে আতঙ্কবাবু বাঁটুকে বকাবকি-গালাগালি করা দূরে থাকুক, চেঁচামেচিও বিন্দুমাত্র করেননি। বাবদে তিনি অতি মোলায়েম  ভদ্রলোক। কেবল সেদিন থেকে তিনি বাঁটুর মজুরিটুকু ক্ষতিপূরণ হিসেবে কেটে নিচ্ছেন। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত এবং কবে নাগাদ তা পরিশোধ হবে সে ব্যাপারেও তিনি ঝেড়ে কাশছেন না। রেগে গিয়ে বাঁটু  ঠিক করেছিল এবার তাঁর চুলটাকেই টার্গেট করে ফেলবে। পরে ভেবে দেখল, তাতে তারই বিপদ বাড়বে। চুল-দাড়ি বস্তুটা এমনই চরিত্রহীন যে সাফ করেও রেহাই নেই, দুদিনেই ফের গজিয়ে যাবে আর চুল সাফের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে আজীবন তাকে বিনা পয়সায় আতঙ্কবাবুর চুল ছাঁটতে হবে।

            আজ আতঙ্কবাবুর চুল ছাঁটার নির্ধারিত দিন। অভ্যেসমত সেলুন খোলার আগেই তিনি হাজির। বাঁটু দোকান খুলে ঝাঁট-জল, ধূপ-ধুনো দেওয়া মাত্রই তিনি চেয়ার দখল করে বসে পড়লেন। অগত্যা বউনির বদলে গচ্চা দিয়েই দিনটা শুরু হল বাঁটুর। মনে মনে বিহার মুলুকের বাছা বাছা গাল আওড়াতে আওড়াতে আতঙ্কবাবুর চুলে কাঁচি চালাচ্ছিল সে। পাশের সেলুনের লালু খইনি ডলতে ডলতে তার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, - শুনলা কা হোলে বা?  
কা হোলে বা?
লা হাত বাড়াবা। বলে খইনির আদ্ধেকটা বাঁটুর হাতে দিয়ে বাকিটা নিজের ঠোঁট উল্টে মুখে গুঁজল  লালু। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, - এক জওয়ান লেড়কা কে আভি আভি হাসপাতাল মে লে গেলে বা। লাগাতা লেড়কা ফৌত হো গেলে বা।   
হায় রাম! বিমারি রহেল কা?
নহি রে, বিমারি কুছ না রহেল। এক কালা ষাঁড় -কে শিং সে উঠাকে ফেক দেলে বা।  
ক্যায়সে হোল?  
লগতা আদমি মুসলমান রহেল, ষাঁড় কে জবাই করে যাত রহেল আরে সব কে তো জান মে ডর রহেলা। আপন জান বাঁচায় কে লিয়ে শালা লেড়কা কে মার দেলে বা।
বাঁটু বলল, - ইধার অ্যায়সে হি বহুত মুসিবত বা। মুসলমান লোক গোরু খা লা, কুছ না বোলে কোই।  হামলোককে বিহার মে মুসলমান লোক কা কম বা? লেকিন কেকরো হিম্মত না বা গোরু জবাই করে কে। লালু বলল, - জবাই তো কা, লোক গোস ভি না খালা।

            আতঙ্কবাবুর চুল ছাঁটা শেষ হয়েছিল। তিনি অনেকক্ষণ ধরে দুদিকের আয়নায় ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে  তীক্ষ্ণ চোখে ছাঁট নিরীক্ষণ করলেন, তারপর ধীরেসুস্থে চেয়ার ছেড়ে রাস্তায় নামলেন। হাঁটতে হাঁটতে নিজের পাড়ার চা-দোকানের বেঞ্চে এসে বসলেন। দোকান জমজমাট। প্রবল গুলতানি চলছে। একজন বলল, খবর কি, আতঙ্কদা?
আতঙ্কবাবু বললেন, - আর খবর! নেড়েদের কী বাড় বেড়েছে বাজারে যে ধর্মের ষাঁড়টা ঘুরে বেড়ায় গো, সেটাকে ধরে জবাই করতে গেছে। ব্যস! শিং দিয়ে দিয়েছে একটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে! হাসপাতালে নিয়ে এসেছে লাশটা, এই মাত্তর দেখে এলুম নিজের চোখে। কথায় বলে না ধর্মের কল