গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৪

তন্ময় ভট্টাচার্য


হয়তো কোনদিন

আবেগের গলায় ফাঁস দিতে শিখে গেছে রুমি। কোনোকিছুতেই আর বিশেষ হেলদোল হয় না। আগে হলে এতক্ষণে কেঁদে ভাসিয়ে দিতো। আস্তে আস্তে বুঝেছে, কান্নাটাকে লোকে এখন সিমপ্যাথি আদায়ের অস্ত্র হিসেবেই দ্যাখে। ভেতরের কষ্ট-টাকে বুঝতে চায় না কেউ। এমনকি বিকাশও না। অথচ বছর দুয়েক আগে হাতে হাত রেখে এই বিকাশই যখন বলেছিল অনেক কেঁদেছিস জীবনে,তোর ওপর আর কষ্টের ছায়া পড়তে দেবো না”,রুমি বিশ্বাস করে ফেলেছিল। বোকার মতোই। আজ বুঝেছে, ভরসাও কিছুদূর উঠে হাঁপিয়ে যায়,বাদবাকি পথের জন্য পড়ে থাকে শুধু আধবোতল জল আর দাঁতে-দাঁত সহ্যক্ষমতা। রুমি জানে,বিকাশ কখনো ওকে কষ্ট দিতে চায়নি,চাইবেও না। কিন্তু ইচ্ছেগুলো যখন ইগো-র রাস্তা ধরে জেদের পর্যায়ে চলে যায়,নেমে আসে অ্যাসিডবৃষ্টি। রুমি দেখেছে,আজকাল ওর চোখে জল এলেই বিকাশ কেমন শক্ত চোয়াল করে তাকিয়ে দ্যাখে চারদিকে,কেউ দেখছে কিনা। ওর কান্নার থেকে লোকে-কী-মনে-করলো সেটাই বেশি চিন্তার এখন বিকাশের কাছে। রুমি বলেওছিল একদিন। উত্তর পেয়েছে – “চোখের জল মনের কথাগুলোকে বড্ডো বাজারী করে দেয়,হাজারটা লোক ছুটে আসে তখন হাত বুলোতে। আমার সামনে এই ন্যাকামি-টা নাহয় না-ই করলি!মুখের ওপর আছড়ে পড়েছিল সিগারেটের ধোঁয়া। ট্রেনের আলাদা কামরায় উঠেছিল কলেজফিরতি রুমি সেদিন। আজ মনখারাপের দিন।

ঠিক দুবছর আগে এই দিনেই বিকাশ প্রথম চুমু খেয়েছিল রুমি-কে। সকালে ওকে বারবার বলেছে কলেজ আসতে। যাবে না ও। ঘুমভাঙা দিনটা তখনই ঠিক করে ফেলেছিল বাকি ঘণ্টাগুলোর মেজাজ। আজকাল আর ফুঁপিয়ে ওঠেনা ও। চুপচাপ ব্যাথায় বালিশের তুলো একটু নরম করেই রুমি সামলে নিল। নাহ্‌! এভাবে রোজ-রোজ চলতে পারেনা। বিকাশের জন্য নিজের পড়াশুনা আর সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না আর। যে ছেলে ভালোবাসার সুদের ওপর নির্ভর করেই বাকি জীবনটা কাটাতে চায়,তাকে বুঝতে দেয়া উচিৎ, অভ্যেস মানুষকে আর যাই করুক,প্রেমিক করে তুলতে পারেনা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। নেক্সট ট্রেনটা কিছুতেই মিস করা যাবে না।


তাড়াতাড়ি স্নান-খাওয়া সেরে সাইকেল নিয়ে রুমি বেরিয়ে পড়লো। আবছা শোনা যাচ্ছে অ্যানাউন্সমেন্ট। স্টেশন রোডের গ্যারেজ-টায় সাইকেল কোনোমতে জমা করে দৌড়াতে দৌড়াতে যেখানে লেডিস পড়বে,সেখানে এসে দাঁড়ালো রুমি। ট্রেন ঢুকছে। কাঁধের ব্যাগটা খুলে সামনে নেবে,এমন সময় কে যেন হ্যাঁচকা টানে ওকে নিয়ে গেল ভেন্ডারের আগের গেটের সামনে। রুমি অবাক হয়ে দেখলো,বিকাশ। তাড়া দিচ্ছে – “ওঠ্‌ ওঠ্‌ এক্ষুনি ছেড়ে দেবে। জলদি কর্‌। রুমি উঠলো বোকার মতো। উঠেই বসার জায়গা পেয়ে গেল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। উল্টোদিকের দরজায় দাঁড়ানো বিকাশের চুলগুলো রোদ আর হাওয়ায় মাখামাখি। হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। রুমি ওকে ডাকলো না আর। এইমুহূর্ত থেকে রুমি জানে,বিকাশের চোখেও একটা ঠোঁট লুকিয়ে আছে...কোনো ঝগড়াই যাকে পুড়িয়ে কালো করে দিতে পারেনি এই দুবছরে। দেখাদেখি অজস্র চুম্বনে ছেয়ে গেল হাতঘড়িটাও...