গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৩

মনীষা মিত্র

স্টেশনে দু ঘন্টা

ঢাকা থেকে ফিরছিলাম একাই। দেরি করে ফেলেছিলাম তাই, তাড়াহুড়ো করেই ডাল ভাত খেয়ে বাক্স পেটরা নিয়ে রওনা হবো- ...... মামা, আমি বেরিয়ে পড়ছি। আসবো পুজোর পরে। তুমি ভালো থেকো ঠিক ঠাক খেয়ো। ...... কাল সকালে গেলেও পারতিস। তুই তো কথা শুনিস না মোটেও। বড় হয়ে গেছিস কিনা। ...... আমি পারতাম তোমার বোন কি আর কথা শোনে। কি যা তা স্বপ্ন দেখেছে তাই তো জরুরী তলব। ...... আচ্ছা, ঠিক আছে সাবধানে যাস। দেখে শুনে থাকিস রে মা। ...... আচ্ছা তাই থাকবো। ভাই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ...... এই দিদিভাই, তোমার জলের বোতল টা। চশমাটাও ফেলে যাচ্ছিলে। তোমার কিচ্ছু মনে থাকেনা। ...... ঠিক বলেছিস। আমি তো যা তা। গোমড়া মুখে মামী। বেশ রাগান্বিত। ...... ও মামী, কি হল তোমার? ...... আমরা তো পর তাই চলে যাচ্ছিস। এবার পুজোটা এখানে কাটালে কি এমন হত? ...... আমার লক্ষ্মী মামী, আগামী বার পাক্কা থাকবো। মুখ ভার করো না। দেরি হয়ে গেছে কিন্তু আমার। ...... এই দেখ, আমিও না আসলেই... । চল রে মা বের হবি। মামী সানন্দেই এগিয়ে দিলেন আমায়। এবার ছুটলাম গন্তব্যের পথে।

ঢাকার চির পরিচিত রেল স্টেশন কমলাপুর। বাড়ী থেকে রাস্তায় নেমে মোবাইলে তাকিয়ে দেখি রাত ১১টা ৪০। মাত্র ২০ মিনিট বাকি ট্রেন ছাড়ার। এমন সময় গলির ভেতরে বেবি বা ট্যাক্সি পাওয়া বড্ড কঠিন। নিরুপায়, চালিয়ে দিলাম হাঁটা গাড়ি। রাস্তার মোড়ে এসে বহু কষ্টে জুটলো ট্যাক্সি, তাও ভাড়া দেড় গুন বেশী। অবশেষে স্টেশন। ভাড়া দিয়েই ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে রীতিমত দৌড়চ্ছি। কাউন্টারে গিয়ে শুনি ট্রেন দু ঘণ্টা দেরি। মাথাটা সম্পূর্ণ বিগড়ে গেলো। তাড়াহুড়োয় আমি বাবার জন্যে কেনা শালটা মামার বাড়ীতেই ফেলে এসেছি। রাত, ১২ টার কাঁটা পার করে ফেলেছে। এমন সময় বাড়ী একা ফেরাটা খুব একটা সংগতিপূর্ণ মনে হলনা। তাই স্টেশনের একটা নিশ্চুপ শেডের নিচে বসে রইলাম। ভীষণ পরিমানে ঘাম ঝরছিল আমার। 

ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে চোখে মুখে জল দিচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় স্টেশনের কম আলোতেই দূরে কি যেন দেখলাম। তাড়াতাড়ি চশমাটা চোখে দিয়ে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে প্ল্যাটফর্মে বসে কি যেন খাচ্ছে। পাশেই কয়েকটা কুকুর তার খাবারটা ছিনিয়ে নিতে বেশ উদ্যত। ছেলেটা অতো গুলো কুকুরের সাথে একা পেরে উঠছে না। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ডুকরে উঠলো। কাঁধের ব্যাগ আর ট্রলিটা নিয়েই ছেলেটার অভিমুখে পা বাড়ালাম। আমায় দেখেই কুকুরগুলো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলো। মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটাও কেমন যেন চলে যেতে চাইছিল। লক্ষ্য করলাম, ভালো হাঁটতে পারছে না সে। বাঁ পা টা দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আমি কাছে গিয়ে দৃঢ় ভাবেই ধরলাম তাকে যাতে না পড়ে যায়। সিকি সেকেন্ডের মাথায় বুঝালাম ছেলেটা কাঁপছে। 

তাকে আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম- ...... বাবু, তুই কাঁপছিস কেন? ভিত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে উত্তর পেলাম- ...... আফা, বুঝবার পারসি আপনে পুলিশ। এই কাউন্টারের হামনে আর বইতাম না। আইজ ইস্টিসন বস্তির পুলা গুলান মিল্লা খুব মারসে আমারে। পাউ এ সেরম ব্যাথা পাইসি।হাঁটবার পারতাসিনা। হের লাইগ্যা বইসিলাম। আইজ খাওন পাই নাই। আধা রুটি খান পাইসিলাম তাও কুত্তায় লইয়া গেসেগা। আমারে ছাইড়া দেন গো আফা। আমি আর কহনো এইহানো আমু না।
আমি মৃদু হেসে ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বললাম- ...... আমি পুলিশ নই রে বাবু। তোর মতোই আমি। তুই এগলি থেকে ওগলি ঘুরে বেড়াস আর আমি এশহর থেকে ওশহর। চল ওই শেডটার নিচে বসি। ছেলেটা যে বেশ আশ্চর্যান্বিত হয়েছে সে আমি ঠিক বুঝেছিলাম। ছেলেটাকে দেখে যতটা বুঝেছি বয়েস দশ পেরোয়নি মোটেও। পায়ে তার বেশ চোট লেগেছে। ফুলে গেছে গোড়ালিটা। ব্যাগ থেকে পেইন কিলার মলমটা লাগিয়ে দিতে দিতে বললাম- ...... এখন ভালো লাগছে? হুম? ...... হ লাগতাসে। অনেক ব্যাথা। (সাথে আর্ত শব্দ) আমার পাশে বসিয়ে বিস্কিটের প্যাকেট আর জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম তার দিয়ে- ...... এই নে খা। এটা খেয়ে জল খা তারপর আড্ডা হবে তোর সাথে। কি বলিস? ছেলেটা বিস্কিটের প্যাকেটটা নিয়েই গপাগপ বিস্কিট খেতে লাগলো। যেন অনন্ত কালের অভুক্ত সে। স্বর্গের অমৃত যেন তার গলা বেয়ে নামছে। পাঁচ মিনিটের ভেতরেই পুরো প্যাকেটটা শেষ করে দিয়েই মৃদু হাসিতে আমায় কৃতজ্ঞতা জানাল সে। তার মৃদু হাসি আমার ছোট ভাইটার কথা মনে করিয়ে দিলো। ভীষণ মিষ্টি চেহারা। সচ্ছল পরিবারে জন্মালে আমরা শিক্ষিত সমাজ বলে উঠতাম বড্ড আদুরে। এলোমেলো চুল তার। হাত দিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে দিতে দিতেই জিজ্ঞেস করলাম- ...... বাবু? তোর বাড়ী কোথায় বল তোকে দিয়ে আসি। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা। ছেলেটা নিরুত্তর। আমি তাকিয়ে আছি শোনার আশায়। কিছুক্ষন পর......... ...... আমার বাড়ী নাই। যেখানে পারি শুইয়া থাহি। ...... তোর বাবা মা? ...... বাপ রে দেহি নাই। বাপ আসিল না আসিলনা কইতে পারিনা। মা আসিল পাগলী। দুই বসর আগে মইরা গেসে গা। হেই থেইকাই এইহানে থাহি। ...... কি করে মরা গেলো রে তোর মা? ...... রেল লাইন পার হইতে গিয়া টেরেইন ডইল্লা দিসে। শরিল আর মাথা আলাদা হইয়া গেসিল। অনেক কষ্টে লাইন থেইক্কা টাইন্না নামাইসি। মা রে কবর দিবার পারি নাই। লাইনের পাশেই পুইচ্চা গেসে গিয়া। আমি পুলা মানুষ টেহা পামু কই? কত কইসি মাইনসেরে মা মইরা গেসেগা কবর দিমু আমারে দুই ডা টেহা দিয়া সাহায্য করেন। কই?...... কেউ আইল না। দুই ডা টেহাও দিলো না। মার লাশ ডার পাশে এক রাইত আসিলাম। পরে আর থাকবার পারি নাই। ডর করসে। কত্ত গুলা কুত্তা আইসা মার লাশ নিয়া টানতাসিল। কবর দেয়া লাগে নাই, কুত্তাই খাইয়া ফালাইসে মা রে।
আমি ছেলেটার দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইলাম। তার জীবনের নিদারুণ দগ্ধ সত্যি গুলো নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে অনবরত বলে গেলো সে। হৃদয় এবং কণ্ঠ দুটোই বেশ ভারি হয়ে এসেছে আমার। এত সময় পর জিজ্ঞেস করলাম- ...... তোর নাম কি রে? ...... মা ডাকতো আবুল কইয়া। এখন যার যা মুন চায় ডাহে। জেমুন আপনে বাবু কইয়া ডাকলেন। মুখে ছোট্ট হাসি। কিন্তু আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। ছেলেটা তার নোংরা হাতেই আমার দু চোখ মুছিয়ে দিলো। সে স্পর্শে কেমন যেন আপনত্ব! মনের অজান্তেই বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম আমি। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলাম। ...... বাবু, আমার সাথে যাবি? আমার বাড়ী? ...... না আফা। মা রে ফালাইয়া যাই ক্যামনে? ...... মা? (বেশ আশ্চর্যান্বিত হই) ...... হ আফা। আমার মার কয়েক ডা হাড্ডি ঢাকা-সিলেট লাইনের পাশে পুইত্তা রাখসি। ওই ডা আমার মা। মুন খারাপ হইলে ওই খানে যাইয়া বইয়া থাহি। দেখবেন? ...... হ্যাঁ দেখবো। ...... তয় চলেন আপনারে নিয়া যাই। ছেলেটা আমার হাত ধরেই ওখানে নিয়ে গেলো। শক্ত করে ধরেছিলাম যাতে বাবু পড়ে না যায়। ...... আফা, এই দেহেন আমার মা। এই খানে পুইত্তা রাখসি হাড্ডি গুলান। 

অনেক গুলো পাথর দিয়ে ঘেরাও করে রাখা জায়গাটি। কিছু বাসি ফুলও দেখলাম। বাকি রইলনা, মায়ের সমাধিতে মাঝে মাঝেই সে শ্রদ্ধা জানায়। আমাদের শহুরে উচ্চশিক্ষিত সন্তান, যারা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় সেই সব স্ত্রৈণের ওপর ঘেন্না হতে লাগলো। ছেলেটার প্রতি আমার কেমন যেন অজানা টান অনুভব করতে লাগলাম। ...... আফা, আপনে যাইবেন না? আমার লগে কথা কইতে কইতে আপনের টেরেইন চইল্লা গেসে নি কোন? ...... না রে। চল ওইখানে বসি। তবে ট্রেন এলে দেখতে পাব। চল বাবু। কোন উত্তর না করেই আমার সাথে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলতে লাগলো সেই শেডটার নিচে। ...... আফা, একডা কথা কমু? ...... হ্যাঁ, বল না। বল ভাই। ...... আপনে অনেক ভালা। ...... তাই নাকি রে? ...... , আমি পাতার বাঁশি বাজাইতে পারি। হুনবেন? ...... হ্যাঁ শুনবো। (মাথা নেড়েই বললাম) পাতার বাঁশি বাজতে লাগলো। এক ব্যাথাবিদুর সুর সাথে ভাটির টান। সুর ভরা তার হারানোর বেদনা। আমি কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম পাওয়া না পাওয়ার জোয়ারে। হটাৎ ট্রেনের হুইসেল বাজলো। ট্রেন এসেছে আমার গন্তব্ব্যের। ...... বাবু, ট্রেন এসেছে রে। আমায় এবার যেতে হবে। হাতে তার হাজার টাকার নোট আর মলমটা গুঁজে দিয়ে আবার বললাম- ...... যা ইচ্ছে কিনে খাবি। মলমটা লাগাবি। কেমন? ...... এইডা কি দিলেন আফা? এইডা দিয়া কি করুম? ...... এটা এক হাজার টাকার নোট রে। তোর যা ইচ্ছে কিনে খাবি। ...... এক হাজার টাকা!! কয়ডা একশো টাকা হইলে এক হাজার হয় আফা? এইডা দিয়া কত গুলান জিনিস কিনা যাইব আফা? একডা কুলফি খাইবার পারমু? ...... কুলফি কেন? দামি দামি আইসক্রিমও খেতে পারবি। ...... আফা আমারে এই টাহা দিয়েন না। বড় পুলা গুলান পাইলে মাইরা সব নিয়া যাইব। আমারে দিলে একশো টাহা দেন। একডা বড় দোকানের কুলফি খামু। 

ছেলেটার এত অভাবেও অর্থলোভে লালায়িত নয়। শেষমেস তার হাতে দুশো টাকা দিয়ে বললাম- ...... এবার আমি যাই রে বাবু।
ছেলেটা কোন জবাব দিলো না। চুপ করে রইলো। ...... কি রে বাবু? ছেলেটা আমার দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। হটাৎ আমায় জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। আমি তার ক্রন্দন রোলে নিজেকে কোথায় যেন হাহাকারে ডুবিয়ে ফেলি। অনবরত আঁখি নীর বয়ে যাচ্ছে অধর বেয়ে। এ যেন নিদারুণ দগ্ধ বিচ্ছেদ। তার চোখ মুছিয়েই ট্রেনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। আবার বাজছে সেই বাঁশি। অন্তর জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। আমার বুকটা কাঁচের মতো গুড়িয়ে যাচ্ছে। এই অকৃতজ্ঞতার পৃথিবীতে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন দিয়ে যাচ্ছে এই ছোট্ট ছেলেটি।

আমার তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মাতে থাকে। ট্রেনে উঠে আমার কামরা থেকেই হাত নেরে বিদায় জানালাম বাবু কে। তার চোখের জল নিয়নের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ট্রেনের হুইসেল বাজতে লাগলো। আমার হুইসেলের শব্দটা বড্ড বাজে লাগছে। পাতার বাঁশির সুর হুইসেলের কড়া শব্দ ছাপিয়ে বেদনার গাড় দাগ টেনে দিচ্ছিল মনে। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গেছে ট্রেন। বাবুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে পৌঁছে গেলাম বুঝতেও পারলাম না। এরপর যতবার গেছি অনেক খুঁজেছি বাবু কে। পাইনি। আমার সেই স্টেশনের দু ঘণ্টা অম্লান হয়ে থাকবে আমৃত্যু।