গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৩

জয় চক্রবর্তী

শারদ সারমেয়


         দুদিন ধরে  কিছু খাওয়া জোটে নি কালুর    উপরন্তু  মোড়ের মাথার  চায়ের দোকানের লাঠির  ঘা ... পেছনের ডান পাটা মাটিতে ফেলা যাচ্ছে না   কোনরকমে  মণ্ডপের বিশ হাত দূরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে  বসে আছে  মহা সপ্তমীর  সকাল --- পূজা চলছে  কত মানুষ  মণ্ডপে পূজা দিচ্ছে , কেউ  আড্ডায় মশগুল , বাচ্ছারা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে খানিক দূরেই খাওয়ার আয়োজন , বড় বড় পাত্রে প্রচুর খাবার সাজানো পূজা শেষ হতেই মানুষগুলো হামলে পড়বে কালু বুঝতে পারে না , খাওয়াটাই যদি শেষ কথা হয় , তবে এতো পূজা , এতো অপেক্ষা , এতো আয়োজনের কি প্রয়োজন ? পাত্রের ঢাকনাগুলো সরিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলেই তো হয় এত ভাবতে পারছে না কালু , মাথাটা ঝিমঝিম করছে খিদেয় চোখদুটো বুজে বসে লেজ নাড়তে থাকে ওর কপালেও যদি কিছু জোটে ...

        চায়ের দোকানের  সেই পাগলা বুড়োর কথা  মনে পড়ছে কালুর --- বেশ কিছুদিন  হল আসেনা  একমাত্র এই মানুষটাই ওকে বিস্কুট দেয় , মাথায় হাত বুলিয়ে আদর  করে , বিড়বিড় করে কত কথা  বলে ওর সঙ্গে  পৃথিবীর  এই একটা মানুষের ভাষা যেন  বুঝতে পারে কালু  পাগলা  বুড়ো একটা ছবি দেখিয়েছিল --- গেরুয়া বসন আর মাথায় গেরুয়া পাগড়ী - একটা সত্যি সুন্দর মানুষের ছবি  এমন সুপুরুষ  কালু কোথাও দেখেনি  ছবিটা দেখিয়ে বিড়বিড় করে কত কি বলেছিল বুড়োটা --- কিছুই বোঝেনি কালু

         হঠাৎ চিন্তাজাল  ছিন্ন হল ,কানটা খাড়া হয়ে  উঠলো  একটা সোরগোল , চোখ  খুলে দেখল পূজা শেষ , মানুষের  ঢল আছড়ে পড়ছে খাবারের সাজানো বাগানে... যেভাবে জঙ্গলে কোন মৃত জন্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে  পড়ে হায়নাশিয়াল আর শকুনের দল কালু একটু নড়েচড়ে বসলো একে একে মানুষগুলো সাদা প্লেটে খাবার ভরে নিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে ওদের উচ্ছিষ্ট প্লেট ফেলার জায়গাটা নজরে পড়তেই , তার কাছে গিয়ে বসলো কালু কিন্তু একটা প্লেটে ছিটেফোঁটা কিছু নেই ওঃ ! কালুর মনে হল , ওরাও কি দুদিন ধরে কিছু খায়না ! চেহারা দেখে তো মনে হয়না যাই হোক , নজর রাখতেই হবে

         একটা ছোট্ট  ছেলে একা চেয়ারে বসে কালুর  দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে    কালু দেখল  আঙ্গুল নাড়ছে ! এভাবে আঙ্গুল নাড়ার অর্থ ওর জানা  ছেলেটা কাছে ডাকছে , ভারি সুন্দর ছেলেটা  কালু যেন খেয়ালই করেনি , এমন ভাব  দেখিয়ে প্লেট ফেলার জায়গাটার দিকে মন দিলো  ছেলেটা দুবার  হাততালি দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি  করছে -- ডানহাতটা নিজের মুখের  দিকে দেখিয়ে মাথা নাড়ছে   তবে কি ছেলেটা কথা বলতে পারে না ? তো একবারওআয়আয়তুতুবলল না ! শুধু ইশারা করেই যাচ্ছে ! কারণ ডাকের ওই মানব ভাষাগুলো কালু বিলক্ষণ জানে ওর মনটা কেমন যেন হয়ে গেল --- ভুলে গেল ফেলে দেওয়া প্লেট নিরীক্ষণের কথা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ছেলেটার দিকে ঠিক তখনই একজন সুসজ্জিতা মহিলা খাবার ভরা প্লেট নিয়ে ছেলেটার হাতে দিলেন আর গাল টিপে আদর করে যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকেই চলে গেলেন কালু ভাবল ওর মা- হবেন ! কালুর উদাস চোখ আবার ঘুরে গেল ফেলে দেওয়া প্লেটের খোঁজে হঠাৎ ছেলেটার দিকে চোখ পড়তেই দ্যাখে , দুহাতে প্লেটটা ধরে কালুর দিকে এগিয়ে আসছে ছেলেটা ওর খাবার ভরা প্লেট কালুর সামনে নামিয়ে রাখল , দুহাত দিয়ে মাথায় গলায় আদর করল , কিন্তু মুখে কথাটি নেই খাবারের গন্ধে কালু দিশেহারা হয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললো পুরো প্লেটটা চোখ তুলে তাকাতেই দ্যাখে --- একি ! চারদিকটা কেমন পালটে গেছে ! ছেলেটা চেয়ারে বসে , কিন্তু ওর পেছন আর চারদিকে যেন আলোর ঢেউ ! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা ! কালু চমকে ওঠে ! পাগলা বুড়োর দেখানো সেই ছবিটা --- গায়ে সেই গেরুয়া বসন , মাথায় গেরুয়া পাগড়ি ...

         কালু জানতেও পারেনি , পাগলা বুড়ো কদিন আগেই মারা গেছেন  কিছু বুঝতে না পেরে কালু ছুটতে  থাকে চায়ের দোকানের দিকে   ভুলে গেছে ওর পায়ের  ব্যাথা ...পাগলা বুড়োকে গিয়ে বলতে হবে সব... এক্ষুনি !