দুদিন ধরে কিছু খাওয়া জোটে নি কালুর । উপরন্তু মোড়ের মাথার চায়ের দোকানের লাঠির ঘা ...। পেছনের ডান পাটা মাটিতে ফেলা যাচ্ছে না । কোনরকমে মণ্ডপের বিশ হাত দূরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে বসে আছে । মহা সপ্তমীর সকাল --- পূজা চলছে । কত মানুষ মণ্ডপে পূজা দিচ্ছে , কেউ আড্ডায় মশগুল , বাচ্ছারা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে । খানিক দূরেই খাওয়ার আয়োজন , বড় বড় পাত্রে প্রচুর খাবার সাজানো । পূজা শেষ হতেই মানুষগুলো হামলে পড়বে । কালু বুঝতে পারে না , খাওয়াটাই যদি শেষ কথা হয় , তবে এতো পূজা , এতো অপেক্ষা , এতো আয়োজনের কি প্রয়োজন ? পাত্রের ঢাকনাগুলো সরিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলেই তো হয় । এত ভাবতে পারছে না কালু , মাথাটা ঝিমঝিম করছে খিদেয় । চোখদুটো বুজে বসে লেজ নাড়তে থাকে । ওর কপালেও যদি কিছু জোটে ...।
চায়ের দোকানের সেই পাগলা বুড়োর কথা মনে পড়ছে কালুর --- বেশ কিছুদিন হল আসেনা । একমাত্র এই মানুষটাই ওকে বিস্কুট দেয় , মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে , বিড়বিড় করে কত কথা বলে ওর সঙ্গে । পৃথিবীর এই একটা মানুষের ভাষা যেন বুঝতে পারে কালু । পাগলা বুড়ো একটা ছবি দেখিয়েছিল --- গেরুয়া বসন আর মাথায় গেরুয়া পাগড়ী - একটা সত্যি সুন্দর মানুষের ছবি । এমন সুপুরুষ কালু কোথাও দেখেনি । ছবিটা দেখিয়ে বিড়বিড় করে কত কি বলেছিল বুড়োটা --- কিছুই বোঝেনি কালু ।
হঠাৎ চিন্তাজাল ছিন্ন হল ,কানটা খাড়া হয়ে উঠলো । একটা সোরগোল , চোখ খুলে দেখল পূজা শেষ , মানুষের ঢল আছড়ে পড়ছে খাবারের সাজানো বাগানে...। যেভাবে জঙ্গলে কোন মৃত জন্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়না – শিয়াল আর শকুনের দল । কালু একটু নড়েচড়ে বসলো । একে একে মানুষগুলো সাদা প্লেটে খাবার ভরে নিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে । ওদের উচ্ছিষ্ট প্লেট ফেলার জায়গাটা নজরে পড়তেই , তার কাছে গিয়ে বসলো কালু । কিন্তু একটা প্লেটে ছিটেফোঁটা কিছু নেই । ওঃ ! কালুর মনে হল , ওরাও কি দুদিন ধরে কিছু খায়না ! চেহারা দেখে তো মনে হয়না । যাই হোক , নজর রাখতেই হবে ।
একটা ছোট্ট ছেলে একা চেয়ারে বসে কালুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে । কালু দেখল ও আঙ্গুল নাড়ছে ! এভাবে আঙ্গুল নাড়ার অর্থ ওর জানা । ছেলেটা কাছে ডাকছে , ভারি সুন্দর ছেলেটা । কালু যেন খেয়ালই করেনি , এমন ভাব দেখিয়ে প্লেট ফেলার জায়গাটার দিকে মন দিলো । ছেলেটা দুবার হাততালি দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করছে -- ডানহাতটা নিজের মুখের দিকে দেখিয়ে মাথা নাড়ছে । তবে কি ছেলেটা কথা বলতে পারে না ? ও তো একবারও “আয় – আয় – তু – তু” বলল না ! শুধু ইশারা করেই যাচ্ছে ! কারণ ডাকের ওই মানব ভাষাগুলো কালু বিলক্ষণ জানে । ওর মনটা কেমন যেন হয়ে গেল --- ভুলে গেল ফেলে দেওয়া প্লেট নিরীক্ষণের কথা । ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ছেলেটার দিকে । ঠিক তখনই একজন সুসজ্জিতা মহিলা খাবার ভরা প্লেট নিয়ে ছেলেটার হাতে দিলেন আর গাল টিপে আদর করে যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকেই চলে গেলেন । কালু ভাবল ওর মা-ই হবেন ! কালুর উদাস চোখ আবার ঘুরে গেল ফেলে দেওয়া প্লেটের খোঁজে । হঠাৎ ছেলেটার দিকে চোখ পড়তেই দ্যাখে , ও দুহাতে প্লেটটা ধরে কালুর দিকে এগিয়ে আসছে । ছেলেটা ওর খাবার ভরা প্লেট কালুর সামনে নামিয়ে রাখল , দুহাত দিয়ে মাথায় গলায় আদর করল , কিন্তু মুখে কথাটি নেই । খাবারের গন্ধে কালু দিশেহারা হয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললো পুরো প্লেটটা । চোখ তুলে তাকাতেই দ্যাখে --- একি ! চারদিকটা কেমন পালটে গেছে ! ছেলেটা চেয়ারে বসে , কিন্তু ওর পেছন আর চারদিকে যেন আলোর ঢেউ ! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা ! কালু চমকে ওঠে ! পাগলা বুড়োর দেখানো সেই ছবিটা --- গায়ে সেই গেরুয়া বসন , মাথায় গেরুয়া পাগড়ি ...।
কালু জানতেও পারেনি , পাগলা বুড়ো কদিন আগেই মারা গেছেন । কিছু বুঝতে না পেরে কালু ছুটতে থাকে চায়ের দোকানের দিকে । ও ভুলে গেছে ওর পায়ের ব্যাথা ...পাগলা বুড়োকে গিয়ে বলতে হবে সব... এক্ষুনি !