প্রতিচ্ছবি
ভাদ্র মাসটি যেন তার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে।জলন্ত অগ্নিদেবের
তেজ এতটাই প্রবল যে শরীরের ‘melanin’ কোষগুলিকে
বাড়িয়ে দিতে বিন্দু মাত্র সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা নয়।বৃষ্টি নামক মেয়েটি আমার
ভালবাসার প্রতিদান স্বরূপ মনের ভিতর জমতে থাকা নোনতা ঘর্মাক্ত জলকণাগুলিকে ধুয়ে
দেওয়ার পরিবর্তে তার মিষ্টতা কে পানসের রূপ দিয়েছিল।অথচ আমি তারই শরীর মায়ায় ভিজতে
দিনের পর দিন চাতক পাখির নাটক করি।তার তো পাত্তাই পাওয়া যায় না।ধনুক ভাঙা পণ ভাঙা
আমার বোধয় সাধ্য নেই।তো এই পরিস্থিতিতে হারানো শক্তি সঞ্চয় করতে যে কেউ উদ্ধত তো
বটেই আগ্রহীর সংখ্যাও কম পাওয়া যায় না।
সাধারণত দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস আমার নেই।কিন্তু সেই দিন কেন জানি না,বৃষ্টি
ভেবে কোলবালিশটি আঁকড়ে ধরতেই তার
কোলে যেন ঢলে পরেছিলাম।আমার বিদ্যা,আমার
বুদ্ধি,আমার বিচার ক্ষমতা সব যেন দলা পাকিয়ে ভস্মে
ঘি ঢালতে প্রস্তুত হয়েছিল।আমার কল্পনার রূপ যে সংকীর্ণ সুতোর মাঝে তাল কাটছিল তা
হয়ত অত বোধগম্য হয়নি।হঠাৎ কল্পনাগুলো দূরে পালিয়ে গিয়ে,ঘুম ভাঙলো এক আওয়াজে।বলা বাহুল্য,চিৎকারে। যেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে ক্লাইভ ছুটে আসছেন
ইংরেজদের অধিকার স্থাপন করতে।ঢুলু ঢুলু আবছা চোখে বাইরে তাকাতেই বুঝলাম,না,এটি একটি
মিছিল।রাজনৈতিক দ্বন্ধে ক্ষোভ প্রকাশের পর্ব ছলছে।পাশে চোখ যেতেই দেখি একজন রুগ্ন
ছেলে,শ্যামলা গায়ের রঙ,কালো চুলের
মাঝে এক-দুটো তে পাক ধরেছে।সন্দীপ,আমার
সহপাঠী,আমার ঘরসঙ্গী।করুণ দৃষ্টি তে জানালার
বাইরের দৃশ্যগুলি কে আপন করে তুলছিল।
এখানে একটু বলে রাখা দরকার যে সন্দীপ
কোন কানেই শুনতে পায় না।তাই
যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া তার সাথে যোগাযোগ করা বৃথা।তাই পাশে বসে থাকলেও একটু
উচ্ছস্বরেই বললাম,” কি রে এত উদাস কেন?”
মৃদু হেসে
সন্দীপ বলল,”উদাস,উদাসীনতার পাল্লা বড় ভারী রে ভাই,তাই একার পরে আসল মানুষটি খেলা করে।“
কথা উড়িয়ে দিয়ে বলি,“দিন দুপুরে নেশা টেশা করেছিস নাকি?এমন পাগলের মত বকছিস!”
-----“তুই বুঝবি না।আমার জীবন,আমার শরীর,আমার মন সম্পূর্ণ আমারই।এর ভাগীদার বা অংশীদার পাওয়া যায় না । এ জগতে অন্যের দুঃখে অপরে আনন্দ পায়,সদুপাদেশ দিলে ঘুরে বসে,উপকার করলে
অস্বীকার করে।আমায় দেখ,কেউ পোঁছে
না,সাথী নেই,আমার
অক্ষমতার দরুন আমায় হাসির খোরাক হতে হয় । মান,সম্মান বোধ
তো আমারও আছে নাকি। তাই মানুষ হয়ে জন্মালেও,মান আর
হুঁশ সম্পর্কে অবগত হয়েও আমি কেবল এক ধুলোয় মোড়া পাপোশ রয়ে গেলাম যাকে দিন রাত
মিনিটের অন্তরে পিষে চলে।”
আমি বললাম,“বাবা, ভারি সেন্টি দিচ্ছিস যে।তা সঙ্গিনী ছেড়ে পালিয়েছে নাকি?”
সে বলে ওঠে,“তারা তো
তুচ্ছ মাত্র,আজ আছে কাল নেই । চাহিদার নাম নিয়ে তারাও ঘুরে চলেছে পৃথিবীর সাথে। আমি কে ? আমরা কে ? শুধু কলের পুতুল হয়ে ফরমাস পালন করি।
আসলে জীবনটাই এমনই।ধোঁকা,পরীক্ষা,আস্থা ভঙ্গ।তাই বাঁচার আর্তি চাপা পরে ধ্বংসের স্তূপে।”
তবু তাকে আশ্বস্ত করতে বললাম, “আমায় দেখ,ক্লাসে কত
ইয়ার্কি.........”
আমায় থামিয়ে
দিয়ে উত্তর এলো, “তুই সত্যি কি তাই?”
আর ভাষা
কুলালো না।চোয়াল শক্ত করে চেপে
নিজেকে ইস্পাত কঠিন পুরুষমানুষ প্রমান করতে গিয়েও ব্যর্থ
হলাম।হৃদয়ের গভীর থেকে
উৎপন্ন জলের রেখাগুলি চোখের পাতা ভারী
করে গাল ভেজাতে
সক্ষম।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে।সন্দীপ কে আজ যেন বেশিই শুকনো লাগছিল।দু’জন পাশাপাশি বসেও নিজেদের ভাষা হারিয়েছি।যেন কোন এক মায়া
আমায় বিভোর করে তুলেছে।এমন সময় শুনতে পাই আমার ঘরের বাইরে কারুর হাঁটার
আওয়াজ।হ্যাঁ,স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।ধীরে ধীরে আরো জোরালো
আরো স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।হঠাৎ আওয়াজটি থেমে গিয়ে দরজায় কড়াঘাত!সন্দীপের যেন
ভ্রুক্ষেপই নেই।সে কাঠের মত বাইরে চেয়ে আছে।এরই মধ্যে দরজায় স্ব-জোড়ে আবার
কড়াঘাত।অজ্ঞতা,নিজে উঠে বাতি জ্বালিয়ে হাঁক দিলাম, “কে?”
স্পষ্ট শুনতে পেলাম, “আমি রে সন্দীপ।”
সন্দীপ! কি বলছে কি? ও তো......
বিছানার দিকে ঘুরতেই আমার শরীর হিম হয়ে গেল।কোথায় কে! চাদর যেমন টান-টান ছিল তেমনই আছে। একটু
আগেও যে ওখানে কেউ আসন গ্রহণ করেছিল দেখে তা বুঝবার জো নেই।আমার মানুষ রূপটি যেন
মূর্তির আকার ধারন করেছে।পা দুটো শক্ত হয়ে যেন নড়তেই চাইছে না।এমন সময় শুনি বাইরে
থেকে ঝাঁঝালো শব্দ, “আরে কি হল
কি? আর কতক্ষণ এই ভাবে বাইরে দাড়িয়ে থাকবো?”
কোনরকমে কাঁপতে কাঁপতে হুড়কো খুলে দেখি স্বয়ং সন্দীপ
দারিয়ে।ভয়ে শুকনো গলায় প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বললাম, “তু-তু-তুই!”
সন্দীপ বলে ওঠে, “এমন করছিস যেন ভূত দেখেছিস।বাড়ি
গেছিলাম,তুই জানিস তো,আজই তো আমার ফেরার কথা।”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না মানে......”
আমায় থামিয়ে
দিয়ে বললো, “কোন মানে টানে
নয়।আনেক জার্নি
হয়েছে,ভীষণ ক্লান্ত,এখন সর তো দেখি দরজার সামনে থেকে,” বলে গট গট করে ভিতরে চলে গেল।
না, সন্দীপ কে
কিছু বলিনি। তবে আজও ভাবি কে ছিল সে যে আমায়
ভাবশূন্য করে নিজের মায়া জালে আবদ্ধ রেখেছিল ??