আমাদের শ্যামলা
যার ভালো নাম শ্যামল চন্দ্র দাস, এই শ্যামলার শরীরের রঙের সাথে
নামের একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে । শ্যামলা দেখতে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের । লিকলিকে
লম্বা গড়ন, কিশোর সুলভ চঞ্চলতা চোখে মুখে । বয়সে আমাদের সমান কিংবা কিছুটা ছোটও
হতে পারে । তবে অমায়িক ব্যবহার আর বিশ্বস্ততার জন্য আমরা ওকে অনেক আপন করে নিয়েছি
সেই শুরুর দিন থেকেই ।
সেদিন পাখিদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরেই
শ্যামলাকে দেখতে পেলাম হোস্টেলের গেটে । একরাশ রাগ ঝারলামশ্যামলার উপর । শ্যামলা যথারীতি হাসলো দুই পাটির সব
কটা দাঁত বের করে । ব্যাটা এমনই, কোন সিরিয়াস কথায়ও হাসে আবার গালাগালি দিলেও হাসে
।
এরপরও যখন আমার পেছন পেছন রোমে ঢুকলো
তখনই বুঝতে পারলাম আজকে গালাগাল খেয়েও শ্যামলা দমবার পাত্র নয় । ঘটনা জেনে নেয়ার
এটাই মোক্ষম সুযোগ । বেশ সাবলীলভাবে শ্যামলাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি রে? ওইদিনের ঘটনা কি বল তো?
শিবুদারা আসার পর তুই কোথায় ছিলি? আমি কলেজ থেকে এসেও তোকে দেখতে পেলাম নাআশেপাশে
?
এমন একটা হাসি দিলো শ্যামলা,মনে হল বেশ মজা
পেয়েছে আমার প্রশ্ন শুনে । হাসি দেখে আমার রাগ চড়ে সপ্তমে । একটু আগে পাখিদির চোখে চরম বোকা বনে এসেছি । খুব ইগোতে
লেগেছে আমার ।যেভাবেই হোক পাখিদিকে বোঝাতে হবে যতটা বোকা ভেবেছে আমি এতটা না ।এবার সত্যি সত্যি রেগে
গিয়ে ধমকের সুরে আবারো জানতে চাইলাম । শ্যামলা যখন ভয়ে কিংবা রাগে কারো সাথে কথা
বলে তখন মাঝে মাঝেই তোতলায় ।ইতস্তত করে শ্যামলা বলতে লাগলো,
-শি-শি-শিবুদা এসেই আমাকে একটা কে-কে-ক্যামেরা
হাতে ধ-ধ-ধরিয়ে দিয়ে বললো ও-ও-ওটা নিয়ে সেন্ট্রাল পা-পা-পার্কে যেতে । ছ-ছ-ছবিঘরে
গিয়ে শি-শি-শিবুদার কথা বলে কে-কে-ক্যামেরাটা দিলেই ও-ও-ওরা নাকি রিলটা রেখে একটা রি-রি-রিসিট
দেবে । এ-এরপর কে-কে-ক্যামেরা আর রি-রি-রিসিটটা নিয়ে শিবুদার বা-বা-বাড়িতে গিয়ে
তারদি-দি-দিদির কাছে দিয়ে আসতে হবে । আমি কি-কিভাবে এখানে থা-থাকবো ?
শ্যামলাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-তুই যখন বেরিয়েছিলি তখন কি পাখিদি
ছিল এখানে ?
শ্যামলা উত্তর দিলো,
-ন-না । ত-তখনও পাখিদি আসেনি ।
-তুই কতক্ষন পর ফিরে এসেছিলি ?
-দু-দুই ঘণ্টা তো হবেই । বে-বেশিও হতে
পারে ।
শ্যামলাকে বেশি আর ঘাঁটালাম না সেদিনের মত । এই নিয়ে পরেও ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি । এরপর নতুন
হোস্টেলে চলে এলাম আমরা । শুনেছি শ্যামলাও নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে আমরা চলে আসার
পরপরই । আস্তে আস্তে সব বেমালুম ভুলে গেলাম । নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন পরিবেশ,
অন্যদিকে পড়াশুনার চাপ সব কিছু মিলিয়ে ছাত্রজীবনের ব্যস্ততায় যা হয় আর কি । চোখে শর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছি শেষ বর্ষে এসে । এদিকে অনেকদিন হয়ে গেল বুদ্ধপার্কের
দিকে যাওয়া হয় না । শিবুদা, পাখিদির কোন খোঁজ খবরও নেয়ার ফুসরত মেলে না । ওদিকটার আর যারা ছিল সবার সাথেই প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
। এর মাঝেই একদিন বুদ্ধ পার্ক যাব বলে মনস্থির করলাম ।
প্রায়ই কল্যাণী বি-ব্লকের দশ নম্বর
সেকশন থেকে এ-ব্লকের সেন্ট্রাল পার্কে যাই কখনো ঘোষপাড়া হয়ে আবার কখনো লেক পাড়ের
রাস্তা ধরে । এরি মধ্যে সেদিন দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে চলে
গেলাম বুদ্ধপার্ক । উদ্দেশ্য শিবুদার সাথে দেখা করা, সেই
সাথে পাখিদির সাথেও গল্প করে আসা যাবেবেশ করে ।টেলিফোন বুথের বাইরে কোথাও পাখিদির
গোলাপি সাইকেলটা চোখে পড়লো না। পাখিদিকেও দেখতে পেলাম না দোকানের ভেতরে । দেখলাম শিবুদার
জায়গায় বসে আছে অন্য একজন । আগেও বেশ কবার দেখেছি ভদ্রলোককে । আমাদের সাথেও কথা হয়েছে অনেক ।শিবুদা তাকে বড়দা বলে ডাকতো । আমরা ডাকতাম কৃষ্ণাদা
বলে । বুথের সামনে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডেকে নিয়ে ভেতরে বসালো । কৃষ্ণদার
কাছে শিবুদার কথা জানতে চাইলাম । এক কথায় বলে দিলো বেশ দায়সারা ভাবে,
-শিবুর কথা আমাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করিস না । ওর কোন খবর রাখি
না আমি ।
কথার ঝাঁজে বুঝতে পারলাম কিছু একটা
গোলমাল আছে বড় রকমের । এর বেশিআর জানতে
পারবো না ভেবে শিবুদার প্রসঙ্গ বাদ দিলাম ইচ্ছে করেই । ভাবছিযাবার সময় শিবুদার বাড়িটা হয়ে গেলে
কেমন হয় !মাসিমার সাথেও দেখা হবে অনেকদিন পর । এদিক ওদিক তাকিয়ে পাখিদিকে খুঁজছি আমি
। উসখুস করতে দেখে কৃষ্ণদা জিজ্ঞেস করলো,
-কি রে ? কাউকে খুঁজছিস নাকি ?
-আসলে ঠিক তা না । কিন্তু পাখিদিকে দেখছি না যে বড় ?
-দেখবি কিভাবে ? এত কিছুর পরও পাখি বেঁচে আছে যে ওটাই অনেক । ও আর এখানে কাজ করে না ।
-কেন ? অন্য কোথাও কাজ নিয়ে চলে গেছে
নাকি ?
-কিভাবে যে বলি তোদের, পাখি চলে যাবার
পেছনে ওই শিবু হারামজাদাই দায়ী । থাক তোরা শুনে আর কি করবি ?
কৃষ্ণদার গলায় এখন আগের ঝাঁজটা আর নেই,
বেশ মোলায়েম সুর । তাই সাহস করে জানতে চাইলাম ঘটনা স্ববিস্তারে । একটা ছোট ছেলেকে ডেকে চারটা চায়ের অর্ডার
দিলো । সাথে আর কিছু খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো । অন্যদিন হলে চায়ের সাথে টা’ও চেয়ে
নিতাম নিজ থেকেই কিন্তু আজ আমি চা’তেই সন্তুষ্ট । কারণ তার চেয়েও তীব্র তৃষ্ণা আমার ঘটনা
জানার । কৃষ্ণদা বলতে শুরু করল,
-শিবু যা করেছে, কোন মানুষ এসব করে না
। তোরা বোধয় জানিস না কিছুই ? শিবু রীতিমত পাখিকে ব্ল্যাক মেইল করতো শেষ দিকে ?
চমকে উঠলাম কথাটা শুনে । অথচ পাখিদি কত
আহ্লাদেই না আমাকে বলেছিল,
-জানিস শিবুআমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে
। খোঁজ খবর নেয় প্রতিনিয়ত । ইনিয়ে বিনিয়ে আরো কত কথা ?
চুপ মেরে থাকলাম আমি । চা খেতে খেতে
বাকি কথা শুনলাম । ভাবছি আমার কাছে বলা পাখিদির সেদিনের যত কথা । তাতেছিল কেবলি
একজনশিবুর মধ্যে একটি পাখিতার নীড় খুঁজে নেয়ার মত স্বপ্নীল আবহ । আর আজকে কৃষ্ণদার
মুখে শুনা কথাগুলোএক করলে সারসংক্ষেপএই দাঁড়ায়,
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শিবুদা
পাখিদিকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে । পাখিদির জন্য সেটা ছিল মুলত এক ধরনের তীব্র মানুষিক
যন্ত্রণার শুরু । আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে শিবুদার এই অত্যাচার । পাখিদি কৃষ্ণদার কাছে সব কিছুই বলে শুধু ঐ দিনের ঘটনা ছাড়া । পাখিদি পুরু ঘটনাটাই
যেইচ্ছে করে চেপে যায়সেটা কৃষ্ণদার কথা শুনে বুঝতে পারি । এও অনুমান করতে পারি শিবুদার
ব্ল্যাকমেইল পর্ব শুরু হয় ওই ঘটনার পর থেকেই । মানসিক অশান্তি, সামাজিক ভাবে হেয় হওয়া
ছাড়াও অনেকে ব্যাপারটা জেনে ফেলাতে পাখিদি এক সময় শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে । চাকরিটা ছেড়ে
দেয় ইচ্ছে করেই । অবশ্য না দিয়েও তার উপায় ছিলো না । কারন জানাজানির ব্যাপারটা বেশ ঘটা করেইচাউর হয়
চারদিকে । এদিকে পাখিদির ছেলেটা বড় হচ্ছে । কোন মা’ই তার সন্তানের চোখে নিজে ছোট
হতে চায় না । সব কিছু বিবেচনা করে এখানখার চাকরিটা ছেড়ে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হয় পাখিদির কাছে।
-পাখিদি এখন কোথায় আছে ? কৃষ্ণদাকে
জিজ্ঞেস করলাম একটু সাহস করেই ।
-বলতে পারবো না । লজ্জায় আমিও আর
যোগাযোগ করি না । শতহলেও শিবুকে তো নিজের ভাইয়ের মত দেখেছি ছোট থেকে ? এরকম একটা
কাজ করবে ভাবতে পারি নি কখনো ।
-ভাইয়ের মত মানে ? শিবুদা তোমার আপন
ভাই নয় ? আমরা তো জানতাম তুমি শিবুদার নিজের দাদা ?
-রক্তের সম্পর্ক না হলে কি আর আপন হয়
না ! ও আমার নিজের ভাই না হলেও আমার অনেক কাছের ছিল রে । কৃষ্ণদার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ আর চোখের কোনে
ক’ফোটা জল দেখে কিছুটা খারাপ লাগলো । আমরা চুপ হয়ে গেলামএকটু সময়ের জন্য । পরিবেশটা একটু হালকা হবার পর কৃষ্ণদার
কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিবুদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম ।
মাসিমাকে দেখতে পেলাম উঠোনে । হাতে লাঠি নিয়ে কি যেন
করছেন ফুল বাগানের মধ্যে । ভেতর থেকে এলসেশিয়ানের দাপাদাপির আওয়াজ আসছে । গেটে শব্দ করতেই মাসিমা ঘুরে
দাঁড়ালেন । আমাদের দেখে আস্তে আস্তে এসে দরজাটা খুলে দিলেন ।
-কেমন আছেন মাসিমা ? চিনতে পারছেন ?
-এই বয়সে কি আর ভালো থাকা যায় ? চিনতে পারবো না কেন ? কত
দিন তোড়া আসিস না এদিকে ? আয়, ভেতরে আয় । রোমে গিয়ে বস । বলেই মাসিমা আমাদের আগে
আগে পাবাড়ালেন ।
-মাসিমা, শিবুদাকে দেখছি না যে ? বেশ জোরেই বললাম কথাটা । উদ্দেশ্য শিবুদা আশেপাশে
থাকলে নির্ঘাত শুনবে এবং চলে আসবে ।
-আর বলিস না বাবা । ওকে নিয়ে যে কি করি ? বাড়িতে নূতন বৌ
। তাও কি ওর বাইরে যাবার কমতি আছে ? বলি এবার ঘরমুখো হ । কে শোনে কার কথা । আমার হয়েছে জ্বালা । বলতে বলতে ভেতর ঘরে চলে গেল ।
মাসিমা যে কি বলছে শেষ দিকে আর শোনা হল না । চমকে গিয়ে মুখে রা সরে না । নতুন বৌ, এতেই বুদ হয়ে থাকলাম
অনেকক্ষণ । মাথাটা পাকাচ্ছে, সব
কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে । মাসিমা কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে
বলল,
-কানাইয়ের দোকানে খোঁজ করালাম । শিবু ওখানে নেই । তার
উপর ওর মোবাইলটাও বন্ধ । বল দেখিনি, কি কারবার !
কানাই মানে আমাদের কানাইদা । চায়ের দোকান চালায় । খুব
মেজাজি মানুষ । সব সময় ফুর্তিতে থাকে । এখানে যখন ছিলাম প্রায়ই চা খেতে আসতাম
কানাইদার দোকানে । চায়ের দোকান চালিয়েও মানুষ কত সুখী হতে পারে, সেটা কানাইদাকে না
দেখলে বুঝা যাবে না । কানাইদাকে শিবুদার পার্মানেন্ট পিএস বলা চলে । কানাইদা যেহেতু মাসিমাকেই বলল না
শিবুদা কোথায়, তাহলে নিশ্চিত আজ আর দেখা হচ্ছে না শিবুদার সাথে
।
-মাসিমা, কবে বিয়ে করালেন ছেলেকে ?
-এই তো সাত-আট মাস হল । তোদের ডাকতে বলেছিলাম বিয়েতে । শিবু বলল ঠিকানা নাকি পায়নি খুঁজে।
মনে মনে বললাম, বিলেতে তো ছিলাম না যে খুঁজে পাবে না । তাছাড়া পাবেই বা কিভাবে, পেলে যে
কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে যেত ? মাসিমা তার নতুন বৌকে মানে শিবুদার বৌকে নিয়ে এসে
পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের সাথে । বৌদির হাতের চা আর মুড়িমাখা খেয়ে নিজে থেকেই
আগবাড়িয়ে নেমন্তন্ন নিয়ে বিদায় হলাম সেদিনকার মত ।
এদিকে রাতও বাড়ছে, অনেকটা পথ যেতে হবে সাইকেল চালিয়ে । ফিরছি লেকের পাশের রাস্তা ধরে আর ভাবছি, এবার
মনে হয় সত্যি সত্যি বুদ্ধু সেজে গেলাম । একবার শিবুদাকে পেলে আসল ঘটনা জানা যেত । অবশ্য মাসিমার কাছ থেকে তার মোবাইল
নাম্বারটা নিতে ভুলিনি । কিন্তু আজ শিবুদাই
বা গেল কোথায় ?