প্রাপ্তি
আপনি তো ভয়ানক সুন্দরী’--অপ্রত্যাশিত ভাবে এবং মুখের ওপর যে
কেউ এভাবে একজন স্বল্পপরিচিতা মহিলাকে একথা বলতে পারে, বিনতা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। ছিঃ, মানবেন্দ্র কি মনে করলেন! চকিতে
একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করলেন বিনতা। যেন এই ধরণের হালকা কথাবার্তা
তার পছন্দ নয়। মুখের গাম্ভীর্যে ধরা রইল বার্তাটুকু। জ্যোতিপ্রকাশ তখনো মুখের দিকে
তাকিয়ে। বিনতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। এতো মহা জ্বালা! কাল থেকে ফেউ এর মত লেগে আছে
পিছনে। যেখানেই যাও, মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এভাবে কাজ করা
যায় ! আকারে-ইঙ্গিতে অনেক বুঝিয়েছেন তিনি। এই ধরণের চাপল্য তার ভাল লাগে না।
চপলতার বয়সও এটা নয়। পঞ্চাশ পেরিয়ে গৃহিনী মানুষের আবার অত চপলতা কিসের ! তাছাড়া
তিনি বরাবরই একটু চুপচাপ, চাপা
স্বভাবের। তাই বলে কি তিনি হাসি-মস্করা করেন না? করেন, সেটা
সময় ও পরিস্থিতি বুঝে। তুমি স্বামীর বন্ধু, এদিকে এসেছিলে, দুটো
দিন
স্বামীর আথিতেয়তায় নাহয় আরো
কাটিয়ে গেলে। কিন্তু তাই বলে একটা শিক্ষা, সহবত , সংযম থাকবে না ! নিজের ওপরই যেন
বিরক্ত হয়ে উঠলেন বিনতা। ছুটির দিনে সাত সকালেই কোথাও যেন একটু চিড় ধরল মনে।
মানবেন্দ্রর চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
মুখ তুলে খাবার ঘরের ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখলেন সবে সাতটা বেজেছে। সকালের চা-টা বিনতা ওদের ঘরেই দিতে চেয়েছিলেন।
তারপর ধীরে-সুস্থে জলখাবার
খেলেই হত। কিন্তু জ্যোতিই এখানে এসে মৌজ করে চা খাবেন বলে বায়না ধরলেন। --তোর বাড়িতে কি শুধু ঘুমোতে এলাম
নাকি, কি মুশকিল ! অগত্যা সকালেই খাবার ঘরে। কাল দুই
বন্ধু গেষ্টরুমে অনেক রাত অবধি গল্প করেছেন। বিনতার ঘরেও ওদের হাসি-গল্পের টুকরো
টুকরো কথা ভেসে আসছিল। অনেক রাতে শুতে গেছেন ওরা। বিনতার আজ ছুটি, রবিবার। কিন্তু সকালেই উঠে পড়েছেন। বাড়িতে অতিথি, তার আদর-আপ্যায়নে ত্রুটি ভালো
দেখায় না। তাছাড়া বাল্য বন্ধুর আতিথেয়তায় কমতি দেখলে মানবেন্দ্রও অখুশি হবেন। এখন
বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে মানবেন্দ্র বুঝতে পারলেন তার মুখ আলগা বন্ধুটি কিঞ্চিৎ
বেশিমাত্রায় রসিকতা করে ফেলেছে যা বিনতার পছন্দ নয়। কিন্তু বিনুকে রাগাবার
সুযোগটুকুও হাতছাড়া করতে চান না মানবেন্দ্র। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বন্ধুকে
বললেন...... তুই তাহলে বলছিস, যে
বিনু এখনও সুন্দরী ?’ জ্যোতি
বন্ধুর কথায় অবাক হলেও চকিতে কথাটা লুফে নিয়ে বললেন----‘দারুণ ! যাকে খুশি জিজ্ঞেস কর’।বি বিনতাবিনতাবি বড় বড় চোখে স্বামীকে একবার দেখে
নিয়ে জ্যোতির দিকে তাকালেন। মুখের গাম্ভীর্য্যের কোন হেরফের হল না। তারপর মুখ নীচু
করে বেরিয়ে গেলেন। সুন্দর-অসুন্দর
এসব কথা তার ভাল লাগে না। সুন্দর আবার কি! এতো তার জন্মসূত্রে পাওয়া, তার নিজের কি করার আছে এতে?কই, তার অন্য গুণের কথা তো কেউ বলে না ,সেসব তো তার নিজের অর্জন করা! এটাই
তো আর মানুষের নিজের পরিচয় নয়। যা নিজের নয়, তার প্রতি এই মোহকে পছন্দ করেন না বিনতা। যখন আরো সুন্দন্রী ছিলেন, তখনও তাকে কেউ একজন কিন্তু অপছন্দ
করেছেন শুধুমাত্র তার শিক্ষা গত মান কম ছিল বলে। বিনতা তখনো বিএ পাশ করেননি। তাই
ছেলে মেয়ে না দেখেই মুখের উপর ‘না’ বলে পাঠিয়েছিল। বিনু সেদিনই বুঝেছিল, রূপ নয় গুণ-ই মানুষের বড়। তাছাড়া
এতদিন ধরে স্কুলে পড়িয়ে এসব কথা তার
কাছে ছেলেমানুষী মনে হয়। যার গুণ আছে, সে সৌন্দর্্য্য খুঁজতে যায়না । ঘরের বাইরে এসে নীচু বারান্দা
পার হয়ে বাগানে নামলেন বিনতা ।
(২)
জ্যোতিপ্রকাশ চায়ের খালি কাপটা
নাড়াচাড়া করছিলেন, একবার
উল্টে-পাল্টে দেখলেন। মানবেন্দ্র বুঝতে পারলেন বন্ধুর আরও একটু চা চাই। ইশারায় সে
ইঙ্গিত করতেই হেসে ফেল্লেন জয়তিপ্রকাশ। এখানে ঠান্ডাটা একটু বেশিই, তাছাড়া সকালে তার বড় কাপে চা খাওয়া
অভ্যাস।। ‘বিনু, বিনু’ করে হাঁকলেন মানবেন্দ্র। হাতে হাতে
কাজ করে দেয় যে মেয়েটি, নানকী, ঝাড়ু হাতে এসে দাঁড়াল। মানবেন্দ্র দেখে
বললেন--‘মাসিকে আরো একবার চা করে দিতে বল
গে যা।‘ ‘আমি করে দিচ্ছি, মাসি বাগানে কথা বলছে, সোনুয়া এসেছে‘---বলে হাতের ঝাড়ু ঘরের এককোণে নামিয়ে
রেখে হাত ধুতে গেল নানকী। ‘সোনুয়া
কে’--জিজ্ঞেস করলেন জ্যোতি। ‘বিনুর পুষ্যি’--হাসলেন মানবেন্দ্র।‘আরে, একটা দেহাতী ছেলে, বাগানে এটা -ওটা করে দেয়, বিনুও ওকে সময়ে টাকা-পয়সা দেয়, কাজও করায়। সে ছেলেও মায়জী ছাড়া আর কিছু বোঝে না’ । --তোরা তাহলে এখানে বেশ জমিয়ে আছিস, কি বল? --না তো কি! তোর মত ভবঘুরে হয়ে থাকব
নাকি! বিয়ে-থা না করে সারাজীবন ঘুরে বেড়ালি। নিজেও কিছু করলি না, আমাদেরও কিছু করেত দিলি না...’ গলা তুলে হাসলেন জ্যোতিপ্রকাশ---‘যে যার নিজের মতই থাকে রে...তোর
জন্যই বা কে কি করেছি। নিজের সংসার তো নিজেই করছিস, নিজেই সামলাচ্ছিস...হা হা ...’ হাসলেন মানবেন্দ্রও। --তোমার বাবা
কে এক সুন্দরী চোখে পড়েছিল, তার
ধ্যানেই তো কাটিয়ে দিলি সারাজীবন। কি করে পারলি, আমিও তাই ভাবি। আচ্ছা, তোর মনে আছে তাকে, সেই মেয়েটাকে? --দূর!
মেয়েটাকেই মনে নেই! আসলে, এখন
একা থাকতে থাকতে কেমন যেন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। --কোথায় যেন বাড়ি ছিল মেয়েটার---রাশটুকু ধরে রাখতে
চাইছিলেন মানু,
মানবেন্দ্র। ‘আরে, ওই তো গিরিডি যাবার পথে...জায়গাটার নামও ভুলে
গেছি---বিশেষ গুরুত্ব দিছিলেন না জ্যোতি। --গিরিডি, এই, বিনুরা তো একসময় ওদিকেই থাকত, দাঁড়া, বিনুকে ডাকি, ও হয়ত বলতে পারবে।‘ ---ছাড় ওসব! কবে, কোথায়...আমার নিজেরই মনে নেই। চল, বাইরে ঘুরে আসি। রোদটা বেশ ভাল
লাগছে। হেঁটে আসি একটু, ওঠ
এবার...’
(৩)
রান্নাঘরে কাজের মেয়েটার সঙ্গে
হাতে হাতে জলখাবারের কাজটা এগিয়ে রাখলেন বিনতা। ওরা এখুনি এসে পড়লেই দিয়ে দেবেন।
নানকী, মানে সেই কাজের মেয়েটিকে কিছু
কাজের নির্দেশ দিয়ে
স্নানে গেলেন বিনতা। ওরা এসে পড়বার আগে নিজের কাজটুকু সেরে রাখতে চান। কিন্তু
স্নান, পুজো, হাতের দু/একটা টুকিটাকি কাজ সারার
পরেও মানবেন্দ্ররা আসছেন না দেখে অধৈর্য্য হচ্ছিলেন। এত দেরী করার কথাতো নয় !
খাবার ঘরের ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে ন’টা।
চিন্তিত মুখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন বিনতা। দেখলেন জ্যোতি একাই রাস্তা পেরিয়ে এসে
ফটকে হাত দিলেন। স্বামীকে না দেখে সামনের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলেন বিনতা। ফটক খুলে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে
একেবারে সামনে এসে পড়লেন জ্যোতিপ্রকাশ। নীচু বারান্দাইয় ঊঠে এসে হাত দুটো দেখালেন
বিনতার দিকে। হাত ধোবেন, হাতে
মাটি লেগে আছে। বিস্ময়-মুখে জল আনার জন্য পিছন ফিরতেই জ্যোতি বলে উঠলেন,”আবার আপনি কেন, ওই মেয়েটাকে বলুন না’! হাঁক-ডাক করে কথা বলতে পারেন না
বিনতা।‘ঠিক আছে,’ বলেই নিজেই এক মগ জল এনে হাতে দিতে গেলেন। জ্যোতি হাতে ঢেলে
দেবার ইঙ্গিত করতেই বারান্দার এককোণে যেখানে বারান্দার নীচে বেলফুলের ঝাড় আছে
সেখানে এলেন বিনতা। জল ঢেলে দিলেন হাতে। জ্যোতি হাত ধুয়ে হাত মোছার জন্য এদিক-ওদিক
তাকাতেই তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর থেকে একটা হাত মুছবার ছোট তোয়া্লে এনে দিলেন। জ্যোতি
তখনও বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে বিনতা স্বামী কোথায় প্রশ্ন করলেন। --ভয় নেই, তাকে মেরে মাটিতে ফেলে রেখে আসিনি।
আজ নাকি হাটবার,
তাই কিসব গাছপালা কিনছে, এসে পড়বে এখুনি।‘ --আচ্ছা, আপনারা নাকি গিরিডিরি লোক, মানে মানু তাই বলল আমাকে...হাসি
মুখ করে জানাল জ্যোতি।---‘কোথায়, গিরিডির কোন জায়গা ?’ জায়গার নাম বললেন বিনতা। অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন জয়তিপ্রকাশ। আপনাকে খেতে দিয়ে দিই, নাহলে দেরী করলে আপনার বন্ধু রাগ
করবেন। এত দেরী করার কোন মানে হয় না...’ বলেই হাত দিয়ে চুলটা একটা হাতখোঁপা করতে করতে পিছন ফিরলেন বিনতা।
জ্যোতি তখনও তাকিয়ে আছেন ওঁর দিকে, চলে যাওয়া দেখছিলেন। হঠাৎ চোখ পড়ল কানের পাশে ঘাড়ের দিকে কালো বড়
তিলটার দিকে। ঝপ করে কি যেন মনে পড়ে গেল। --প্রসাদ সেন বলে কাউকে চেনেন? পিছন ফিরল বিনতা,অবাক
হয়ে তাকিয়ে রইল। ইনি কি করে চিনলেন তাঁকে? কই, কখনও
দেখেছেন বলে তো মনে করতে পারছেন না। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করলেন। --কতদিন যাননি ওখানে, এখনও যান? --উনি আমার বাবা, কিন্তু আপনাকে...‘ আর কিছু বললেন না বিনতা। অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন
জ্যোতিপ্রকাশ।
--ধীরেন কে চেনেন?’ --আমার দাদা, কাকার বড় ছেলে।
(৪)
এখানে এই পরিবেশে বিনতাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন জ্যোতি।
তাই কি এত চেনা লাগছিল? দু
দিন ধরে তাই কি এত চিনতে চেষটা করছিলেন? অবাক হয়ে গেছেন জ্যোতি। না, মানুকে তিনি মিথ্যে বলেছিলেন...নাম তাঁর মনে আছে, শুধু মেয়েটিকেই ঠিকমত মনে করতে
পারছিলেন না,
পারেননা। সেই কবেকার
দেখা...! একটা মনের মধ্যে আলোড়ন অনুভব করলেন জ্যোতিপ্রকাশ। এঁদের কি বলবেন একথা, বলাটা কি ঠিক হবে ? দুপুরে খাবার পর দুই-বন্ধুতে শোবার ঘরে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে
নানান গল্পে মেতেছিল। বিনতা আজ অনেক খাইয়েছেন স্বামীকে ও তাঁর বন্ধুকে। মানবেন্দ্র
কাগজ হাতে নিয়ে ঢলে পড়লেন ঘুমের মধ্যে। চশমা হেলে পড়ল একদিকে। মৃদু হেসে জ্যোতি
চোখ থেকে চশনা খুলে বালিশের পাশে রেখে দিলেন। এত খাওয়ার পর আজ আর ঘুমোবেন না। তাঁকে এখন অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। মানুকে কিছু বলেননি তিনি, বলতেও চান না। কারো কৃপার প্রার্থী
হতে চান না তিনি। বন্ধুদের উপদেশ তাঁর পছন্দ নয়। যে ক’দিন থাকবেন পৃথিবীতে, আনন্দ করেই কাটাবেন ঠিক করেছেন।
তিনি তো একা নন,
এমন হাজারো ক্যান্সারের
রুগী আছেন এই পৃথিবীতে। তাহলে আর বাড়তি দয়া, যত্নটুকু একা কেন তিনিই বা ভোগ করবেন? মানু তাঁর একেবারে ছোটবেলার বন্ধু।
ভাগ্যিস তাঁর নিজের সঙ্গে বিয়ে হয়নি বিনুর, বিনতার !মানু ভালবাসে বিনুকে, ভালমানুষের ঘরণীই তো হয়েছে বিনু। ঘরের বাইরে এলেন জ্যোতি, বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দূরে
বাগানের এককোণে দেখলেন মাটিতে উবু হয়ে বসে কি যেন করছেন বিনতা। সেই কবে শাড়ী-গয়না পরা সুন্দরী বিনুকে মনে পড়ল তাঁর। কে
ভেবেছিল, যাবার আগে তাঁর প্রিয় রমণীটিকে
একবার তিনি দেখেতে পাবেন? বহুদিন
পর আজ খুব ভাল লাগছিল জ্যোতির। সকলের জন্যই কোথাও না কোথাও কিছু রাখা থাকে...যেমন
এখানে ছিল তাঁর জন্য।! ঈশ্বরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞ্তায় মন ভরে যেতে লাগল জ্যোতির।
কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবেন । আজ আরো একবার বিনুকে একটু কাছ থেকে দেখবেন বলে বাগানের
মাটিতে পা রাখলেন ।