গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৩

সাঈদা মিমি

 হলুদ রেইনকোট
ছোট্ট মেয়েটা দ্বিতীয়বার যখন আমাকে দেখলো তখনও ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম আমি কত বয়স হবে মেয়েটার? সাত কিংবা এর আশেপাশেই ধবধবে, আয়েশী গঠন আর হলুদ রেইনকোট  জড়ানো অভব্য হলুদ নয়, বাদামী-হলুদ মিশেল দেয়া মসৃন এক মাখনবর্ণ
বৈশাখে যখন তখন ঝড় বৃষ্টি তো হবেই, এই বয়সে রেইনকোট পড়তে লজ্জা লাগে, সাত বছর বয়সে বরং বেশ অহংকার লাগতো আমার মাখন মিশেল হলুদ রেইনকোট, বাবা কিনে দিয়েছিলেন সে ভারি লম্বা বৃত্তান্ত, আসলে রেইনকোট জিনিসটা বই দেখে চিনতে শিখছি কেবল, বরফের দেশে স্বাস্থ্যবান মানুষেরা পড়ে দিব্যি ঘুরছে পথেদুই পকেটে সাহেবী হাত তো পাড়াগাঁয়ে এসব জিনিস দেখলে মানুষ চোখ গোল করে তাকায়, ভিনগ্রহের চিজটাকে খোঁচা মেরে দেখে

ভোরে একটা খবর সারা গ্রামেই রটেছে, সব মানুষ ছুটছে ওদিকে যুধু মাতবরের বৌ মানে পুঁতি খালা গলায় দড়ি দিয়েছে অবিশ্বাস্য কথা, কালও পুঁতি খালার সাথে দেখা হয়েছে আমার, বিকেলে হলুদ রেইনকোট জড়িয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলাম যখন, বৃষ্টিভেজা প্যচপ্যাচে মাটিপথ, রেইনকোট স্যাণ্ডেল সব মাখামাখি রেইনকোটের সাথে স্যাণ্ডেল ! তখন, সেই সাতাত্তর সালের একটা গণ্ডগ্রামে জুতো পায়ে কেউ স্কুলে যাচ্ছে এমনটা দেখিনি তো! তাবৎ স্কুলের ছেলেমেয়েরা এই রেইনকোট  নিয়ে আমাকে অবিরাম পরিহাস করে যাচ্ছে, এয়া কি? কিরহম জুব্বা? বুখরা ( বোরখা ) নাই ? ম্যাঘ বুখরা!!!! তো এই মেঘ বোরখাটা গায়ে জড়ানোই ছিলো,তখনও ঝরছে নদী থেকে স্নান সেরে ফিরছেন পুঁতি খালা, সাপটে ধরে নিয়ে এলেন আমায়, বিটি, কেম্বা আছাও? কতদিন আহো না, আইসো মা, তোমার বুখরা দেখুম, মোয়া রাখছি তোমার জন্যি, গাইয়ের দুধের দই সেই পুতি খালা নেই মানে!

আমি ছুটছি, নানিমা বাধা দিচ্ছেন, বুনু, গলায় দড়ি দিয়া মরাতুমি ভয় পাইবা, যাইও না কে থামায় আমকে? আমার পুঁতি খালা! কালও আমি নাড়ু খেয়েছি তার হাতে, কালও তার সদাহাস্যময় মুখটা দেখেছি! আজও দেখলাম, খালার নিথর শরীর ফাঁসির মরায় নাকি জিভ ঝুলে পড়ে? কই, খালাকে তেমন দেখছি না তো? আধাবোঁজা চোখ, মুখে একটা যণ্ত্রনার ছাপ যুধু মাতবর দাওয়ায় বসে বিলাপ করছে বড় মেয়েটা এখনো শ্বশুরবাড়ী থেকে আসেনিছেলেদুটো মায়ের লাশের ওপর উপুড় হয়ে কাঁদছে কি এমন কষ্ট ছিলো খালার যে এভাবে মরতে হলো? পুলিশ এসেছে, এখন ওরা লাশ নিয়ে যাবে শুনছি, কিসব কাটাছেঁড়া হবে আমি কাঁদতে পারছি না কেন? দাদী যেবার মারা গেলো, কেঁদেছিলাম তো! এখন পারছি না, আমি মানতেও পারছি না

জুরান গেরস্থের ছেলেটা মিয়া বাড়ীর মেয়েকে নিয়ে ভেগে গেছে বড়রা বলাবলি করে, আমার নিবিড় পাঠে মন নেই, এসব শোনায়ও মন নেই কাল পুঁতি খালার কবরের কাছে বসেছিলাম যুধু  মাতবর জোর করে নিয়ে এসেছে আমায়, মা গো, ফাঁসির মড়া প্রেত হইয়া ঘুরে, এইহানে এলহা থাহা ঠিক না ভয় ভয় লাগে, খালা কেন গলায় দড়ি দিলো মামু? কপাল মা রে, বুঝতারি নাই এমন করবো বড় মাইয়া বারতা পাঠাইলো, জামাইয়ে দশহাজার টেকা চায়, কৈ থে দিমু? হেই চিন্তা মাথায় নিয়া তর খালায় তো গেলো, আমার কি অইবো? মাইয়াডাও এহানে আইয়া পড়ছে, পোলাগুলানও নাদান আমি এত ভারী চিন্তার কথাগুলি বুঝতে পারি না

বৃষ্টির মরশুম এটা, অবোধ জীবনের দূরন্ত দিন কেউ কেউ ছাতা বগলদাবা করে হাঁটে, অনেকেই এসবের ধার ধারে না, একটা আস্ত কলাপাতা দিয়ে মাথা আড়াল করে বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা ভিজতেই ভালোবাসে, খুব কায়দা করে পলিথিনে মুড়িয়ে নেয় বইপত্তর, আমি রেইনকোট পরে হাঁটি এতে কেউ ঈর্ষান্বিত হয় দেখিনি, ম্যাঘ বুখরা দেখে সবাই হাসে এবং একসময় সেটা সংক্রামিত হয়ে অট্টহাসিতে রূপ নেয় আমার লজ্জা লাগে, আমি বাসায় এসে বাবাকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখি এই ম্যাঘ বুখরা বেত্তান্ত জানিয়ে সেই চিঠি পড়ে বাবা গ্রামে চলে আসেন এবং সুতীব্র হাসি সহযোগে মাকে চিঠিটা দেখান অসংখ্য ভুল বানানে আমি সূচনা পর্ব লিখেছিলাম, ‘মাননীয় বাবা, আমার দোয়া নিবেন

গল্পটা আরো বাড়তে পারতো কিন্তু তার আগেই ছিদেম মামুর পাগলা গরুটা শিং গলিয়ে দিলো সেদিন মা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন মুন্সিবাড়ি থেকে গাছপাকা একটা চালকুমড়া নিয়ে আসি, মোরব্বা হবে উলস, সে তো মজার জিনিস, কিন্তু ভারী কুমড়া বয়ে আনা কি চাট্টিখানি কথা! পাক্কা সোয়া মাইল পথ হেঁটে স্কুল থেকে আসি মুন্সি বাড়িটা আমাদের বাসা থেকে দুই মোড় পরেই, তবু মা আমাকেই হুকুমটা করলেন কি হতো দুপা হেঁটে নিজেই একটু নিয়ে এলে! সেদিন ফিরতি পথে একটা আছাড় খেয়ে কাঁদায় মাখামাখি হলো রেইনকোট, একটা হতচ্ছাড়া আধাভেজা শালিখ তিড়িংবিড়িং করে চেহারা দেখিয়ে গেলো

পুঁতি খালার কবরটা হালট পেরিয়ে আরো দুরের জংলা একটা ভিটায়, রোজ সেদিকে দাঁড়াই কিছুক্ষণ, সেদিনও দাঁড়িয়েছি বৃষ্টির ফোঁটা যেন উড়ে যাওয়া কাশের রেণু চোখে কি একটা ধরা পড়লো, কুণ্ডলি পাকানো কোন ধোঁয়া? খিঁচে দৌড়, দিগ্বিদিক... মুন্সি বাড়িটা যেন কই? একটা সোরগোল, ধর ধর... ছুইটে গেলো এবং কি একটা যেন তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো আমায় ক্ষেতের আলে একটা বিকেল, আমি, কতগুলো মুখ, অচেতন ঘোর

ছোট্ট মেয়েটা হাসছে, মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে সে, পরনে হলুদ রেইনকোট হাত নেড়ে আদর ছুঁড়ে দিলাম মেয়েটার দিকে   সেই কতকাল আগে ভয় পেয়ে যেদিন ছুটছিলাম, ছিদেম মামুর পাগলা গরুটাও গোয়াল ছেড়ে পালিয়েছিলো, একটা শিং নেই, আরেকটা আধভাঙ্গা, স্মৃতি নড়েচড়ে ওঠে। রেইনকোটটা আছে, প্রায় অক্ষত কেবল কোমরের কাছটায় একটা শ্রীহীন গর্ত