মানুষ দেখার লোভ চিরিদিনের। যত মানুষ তত বৈচিত্রের
সমাহার
। কখনো কখনো দেখেছি যে মানুষটা
খাচ্ছে
দাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা
বলছে তাকে ছাপিয়ে তার ভেতরের আমিটা বেরিয়ে পড়ে । ঘন কালো মেঘের আড়ালে ক্ষণিকের বিদ্যুৎ চমকের মতোই, কিন্তু তাও পড়ে। মুখোশ খুলে যায়, মুখ বেরিয়ে পড়ে । কখনো আবার মুখোশ এতই শক্ত করে আঁটা যে মনে হয় মুখটা বোধহয়
চিরিদিনের জন্যে চাপাই পড়ে গেছে। মুখ আর মুখোশের ফারাক না বোঝায় ঠকেছি কম নয়, আবার কখনো বাইরের খোলসটার আড়ালে এক অন্যরকম মনের খোঁজ
পেয়ে উল্লসিত হয়েছি । পাল্লা
কোনদিকে ভারি বলতে পারব না, কিন্তু এসব সত্ত্বেও মানুষ
দেখতে ভালো লাগে ।
এই দেখার উদ্দেশ্যেই মেলায় আসা । হোক
গ্রাম্য কিন্তু বৈচিত্রের কমতি নেই। প্ল্যাটফর্মে নেমে জনস্রোতের মধ্যে নিজেকেও
ভাসিয়ে দিলাম । মিলতে না পারলে আর মেলায়
আসা কেন ?
মেলার কেন্দ্র একটি শিবমন্দির । বৈশাখ মাসের একটি
বিশেষ
দিনে সেখানের বিশেষ পুজো
উপলক্ষ্যে প্রচুর লোক সমাগম হয় । মেলার সূত্রপাত সেই থেকেই, এখন তা মোটামুটি সাতদিন থাকে । খোঁজ
পেয়েছিলাম এর একবার খবরের কাগজের
পাতায়, হঠাৎ ঠিক করে ঝোলা
কাঁধে
বেরিয়ে পড়েছি। মন্দির প্রাঙ্গণ বেশ বড়ো, বড়ো ফাঁকা মাঠ পাশেই যা আজ
ভরে গেছে দোকানে, মানুষে । সত্যিই মেলা, সত্যিই
জমজমাট মেলা । মন্দিরের সামনে অপেক্ষারত
দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন, তাই দেবদর্শনের আশা ছেড়ে
মেলার ভিড়ে মিশে গেলাম ।
ঘড়ঘড় শব্দে বিরাট নাগরদোলাটা
ঘুরছে
। তাকে ছাপিয়েও কানে আসছে নাগরদোলায় বসা মানুষের কোলাহল । কেউ উত্তেজনায় চেঁচাচ্ছে, কেউ ভয়ে, কেউ বা স্রেফ আনন্দে । আমার পাশ দিয়ে অল্প বয়সী দুই যুবক যুবতী চলে গেল হাসতে হাসতে। যুবতীটির হাতে একটি ছবি, হাসির কারণ
ওটাই
। একটু পা চালিয়ে তাদের পেছনে গয়ে উঁকি মারলাম, দেখলাম
ছবিটি আর কিছুই নয়, সাদা কাগজে আঁকা যুবতীটির মুখের স্কেচ । খুব পটু হাতের নিখুঁত স্কেচ নয়, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না। বইমেলায়, অন্যান্য
মেলায় দেখেছি শিল্পীদের এরকম স্কেচ করতে, কিন্তু
এখানে এই গ্রামীণ মেলায় তা দেখব একেবারেই আশা করি নি । দু একটি ছোটো ছেলেমেয়েকে
দেখলাম জলরঙ এ আঁকা মেলার ছবি, গ্রামের
দৃশ্যের ছবি এসবও নিয়ে যেতে । অবাক হলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করায় সে ‘ছবিওয়ালা’র
ডেরা দেখিয়ে দিল । ডেরা বলতে
কিছুই নয় । মাথায় একটা প্লাস্টিকের ছাউনি, তার নীচে দুটো নড়বড়ে টুল আর
একটা ক্যানভাস। শিল্পীর চারপাশে বেশ কিছু লোকজন, শিল্পী একমনে কাজ করে যাচ্ছেন, অন্য কোনোদিকে তাকাবার ফুরসত নেই । একটি ছোটো মেয়ে
নিজের ছবি আঁকাচ্ছিল, হাসি হাসি মুখে পোজ দিয়ে
দাঁড়িয়েছিল,
চোখেমুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট । শিল্পী
আঁকা শেষ করে ছবিটা তার হাতে দেওয়ার জন্যে ঘুরলেন, আমিও তাঁকে দেখতে পেলাম। আর দেখে খুব চমকালাম । শিল্পী আমার খুবই
পরিচিত। আজকের নয়, অনেকদিনের। কিন্তু তাঁর যা
পরিচয় জানি তার সঙ্গে এই মেলায় ছবি আঁকিয়ের ভূমিকা একেবারেই খাপ খায় না। এতই
অপ্রত্যাশিত,
এতই বেমানান তাঁকে এখানে এভাবে
দেখা যে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। একবার এও মনে হল এ সেই লোকই তো, যাকে আমি ভাবছি? কিন্তু
ভুল হবার কোনো সম্ভবনাই নেই। এ মুখ একবার দেখলে কেউ আর ভোলে না।
হাতের কাজ একটু
হালকা হতে অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতে তিনিই আমাকে ডাকলেন
। বললেন, “আপনি
আবার এসব জায়গাতেও আসেন নাকি ?”
হেসে বললাম, “মেলা দেখতে কার না ভালো লাগে ? গ্রামের এইসব মেলাগুলোই যেন ঠিকঠাক মেলা মনে হয়। শহরে
তো রোজই হাজার লোকের মেলা লেগে আছে। আর যেগুলো হয় সেগুলোও যেন বড্ড বেশী
সাজানোগোছানো,
সর্বত্র পরিপাটির ছাপ। মন ভরে না ।”
শিল্পী কিছু
বললেন না, আরেকটা
ছবি আঁকতে লাগলেন
। তিনি ব্যস্ত রইলেন আঁকায় আর
আমি ভাবতে লাগলাম
অন্য কথা ।
শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডার । আমার বাড়ির কাছাকাছি একটা ছোটো মুদিখানার দোকান । মুদিখানার জিনিসপত্র থেকে
অল্পবিস্তর আলু পেঁয়াজও পাওয়া যায়।
রেল স্টেশনের লাগোয়া যে বস্তিটা রয়েছে তার বাসিন্দারাই মূলত শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডারের খদ্দের । বেশীর ভাগই
ধারের কারবারী । দোকানের সামনে ঝামেলা
ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকে। কতবার আমিই দেখেছি দোকানের মালিক জিনিস না দিয়ে কর্কশ গলায়
অশ্রাব্য গালিগালাজ করে খদ্দেরকে ভাগিয়ে দিচ্ছে কারণ তার অনেক ধার । মাসের প্রথমে
খাতা হাতে খদ্দেরের বাড়ি ধাওয়া করতেও দোকানদার ওস্তাদ । দু একবার অন্য দোকান বন্ধ
থাকায় বাধ্য হয়েই আমাকে শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডারে যেতে হয়েছে। লক্ষ্য করেছি যারা নগদে
কেনে দোকানদারের তাদের প্রতিও অপরিসীম বিরক্তি। কোনোদিন তার মুখে এক চিলতে হাসি
কেউ দেখে নি,
নরম গলায় দুটো ভালো কথা বলতে কেউ
শোনে নি। বিরক্তি, রাগ, বিতৃষ্ণা – এসব
কিছুর স্থায়ী বাস তার মুখে। নাম জীবন মণ্ডল। মনে হয় শুধু নিজের ইহজীবনের ওপরেই নয়, তাবৎ জনজীবনের ওপরেই বিরক্ত, ক্রুদ্ধ সে ।
পাড়ায় সে পরিচিত কানা জীবন নামে । বসন্ত তার মুখে তার
প্রকোপের স্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছে, চোখটাকে
ছিনিয়েছেও সেই। সব মিলিয়ে কানা জীবন বলতে এক বীভৎস মুখ এবং ততোধিক বিরক্ত, অসন্তুষ্ট মনের এক মানুষকে মনে পড়ে। সকালবেলা অনেকেই
যার মুখ দেখতে চায় না একান্ত বাধ্য না হলে। বাড়িঘর কোথায় বা কে আছে না আছে – এসব আমি জানি না । সত্যি কথা বলতে আমার কেমন যেন
অস্বস্তি হয় ওই মুখটাকে দেখলেই । যথাসম্ভব তাই এড়িয়ে চলি ।
কিন্তু বিচিত্র ক্ষমতা
পরিবেশের, পরিস্থিতির । আজ আমি সেই কানা জীবনের এত কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছি, দেখছি ওর শিল্পকীর্তি, কিন্তু
কই কোনো অস্বস্তি তো হচ্ছে না । পালাই পালাই করছে না তো মন । নিজেই আশ্চর্য হলাম ।
“কাছেই একটা দোকানে ভালো কচুরী, আলুর দম বানায় । চলুন খেয়ে আসি। খান তো এসব ?” বলল
কানা জীবন ।
না খেলেও আজ খাব । আজ একে ছাড়া চলবে না । যে রূপে আজ আমি কানা জীবনকে দেখেছি তা অভাবনীয় । তাই
চললাম তার সঙ্গে ।
খেতে খেতে জিজ্ঞেস না করে পারলাম
না, “আপনি ছবি আঁকতে পারেন ?”
কানা জীবন
একটু চুপ করে রইল ।
বোধহয় ভাবছিল কি বলবে । তারপর বলল, “মন যা চায় তা করতে পারা আপনাদের মতো বড়ো মানুষদের পক্ষে সম্ভব । আমাদের সে সুযোগ কোথায় ? ছোটোবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম । কিন্তু যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, ছবি আঁকার কথা চিন্তা করাও তাদের কাছে বিলাসিতা। একবার বসন্ত হল, চোখটা গেল ।
তার কিছুদিন পরে পড়াশোনাটাও
বন্ধ হল ।
নানান দোকানে ফাইফরমাশ খেটে পয়সা জমিয়ে অনেক কষ্টে এই মুদিখানার দোকান করা। চাল, ডাল, তেল, নুনের করতে করতে ছবিটবি আর মাথায় ছিল না । একদিন
বন্ধের জন্যে সকাল থেকেই দোকান খুলতে পারি নি। কি করি কি করি করতে করতে ফুটপাথে
বসে ইঁটের টুকরো দিয়ে ছবি আঁকছিলাম। দেখলাম বেশ ভালো লাগল । সেই শুরু । দোকানে বা
বাড়িতে তো এসব সম্ভব নয়। সুবিধেমতো এসব মেলায় চলে আসি মাঝেমধ্যে ছবি আঁকার জন্যে।
কেউ পয়সা দেয়,
কেউ দেয় না। না দিলেও এঁকে দিই । এতো
বিক্রির জন্যে নয়, ভালো লাগার জন্যে ।”
অবাক হয়ে শুনছিলাম কানা জীবনের কথা । ভাবছিলাম একি সেই লোকই
কথা বলছে যার মুখ দিয়ে
কারণে অকারণে গালিগালাজের ফুলঝুরি ছোটে, যার মুখে আজ অবধি হাসির নামগন্ধ দেখে নি কেউ ! সেটা কি
তবে নিছকই মুখোশ ? আসল লোকটা কি তবে এই ?
“এরকম সব মেলাতেই আসেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি ।
“না সব
সময় আর হয় কই ? আজ
এমনিতেই
দোকান বন্ধ, তাই চলে এলাম ।
নাহলে দোকান কি আর বন্ধ রেখে আসা যায় ? বেঁচে
থাকার জন্যে,
সংসারের জন্যে দোকান তো চালাতেই
হবে । ছবি এঁকে কি আর পেট ভরবে ?”
সত্যিই জীবনধারণের
প্রয়োজনে মানুষকে কত
কিছুই না করতে হয় । ইচ্ছে, ভালোলাগা, ভালোবাসা সব সেখানে পিছিয়ে পড়ে ।
মেলা ঘুরে দিনের শেষে ঘরে ফেরার পালা। একসঙ্গে প্ল্যাটফর্মে এলাম ।
“আমি একটু
এগিয়ে যাই, “ বলল কানা জীবন ।
অবাক হলাম। এতক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম আর এখন একসঙ্গে যেতে কিসের আপত্তি ?
অবাক হলাম। এতক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম আর এখন একসঙ্গে যেতে কিসের আপত্তি ?
কানা জীবন বোধহয় বুঝল আমার মনের ভাব । বলল, “আপনি যেরকম আছেন সেরকমই ফিরে যেতে পারবেন । কিন্তু আমি এখানে ছবিওয়ালা, ফিরে গিয়ে আমাকে আবার কানা জীবন হতে হবে । তাই একসঙ্গে না আসাই ভালো,” সে এগিয়ে চলে গেল ।
ট্রেন এল। উঠলাম। কোনো এক কামরায় নিশ্চয়ই কানা জীবনও উঠেছে । যেতে যেতে ভাবছিলাম কানা জীবন নামটাই যেন এক প্রহসন । জীবন কি কখনো কানা হয় ? না দৃষ্টিহীন হতে পারে ? জীবন কি খুঁজে নেয় না তার ভালোলাগা, দেখতে পায় না তার ইচ্ছে অনিচ্ছে ? পায়, নিশ্চয়ই পায়। যেমন পেয়েছে আমাদের শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডারের জীবন মণ্ডল।