গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৩

সুখী ইসলাম

বৃহন্নলা

সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। সূর্য ডোবার সাথে সাথে হেনার গাছ হাসনুহানার গাছের ডালের ফাঁক ফোকর দিয়ে চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। ঘরটি বেশ আলোকিত। তারপর হারিকেনের মৃদ আলো জ্বলছে। গামলায় গরম পান নাড়িকাটার জন্য নতুন চকচকে ব্লেড । সাবান, স্যাভলন আর কিছু পুরোনো কাপড় তার পাশে প্রসব বেদনায় ছটফট করছে আলেয়া বানু । প্রচন্ড ঘাম শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে । আলেয়ার মা মুখ, হাত, গা মুছে তাকে কিছুটা হালকা করেতে চাইছে । আলেয়া দাঁত কামড়ে ধরেছে । তার মনে হচ্ছে কলিজাটা বের হয়ে আসছে । দাইমা তাপ দিচ্ছে আর বলছে আর একটু চেষ্টা কর
দাই মা চিৎকার করে বললো- ছেলে হয়েছে
বিষ্মিত হয়ে বললো ছেলে কিন্তু অন্তকোষ কোথায় । আবার মেয়ের মতো
আলেয়া বানু মাথাটা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছে । আলেয়ার মা বললো ওসব ঠিক হয়ে যাবে । কচি বাচ্চা এমনটা হয় । বিজ্ঞের মতো উত্তর দেওয়ার পরও তার মনে সংশয় রয়ে গেলো
সবাই কে জানানো হলো মেয়ে হয়েছে ভয় আর সংশয়ের মধ্য দিয়ে মা স্বাগতম জানালো তার সদ্য নবজাত ফুটফুটে শিশু সন্তান সীমাকে মা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তিন মাস বয়সী সীমার দিকে। কি ফুটফুটে সুন্দর লাগছে । ঠোঁটের এক পাশে বাঁকা একটা হাসি । মা যখন শরিষার তেল মালিশ করে সীমার শরীরের সর্বত্র । মালিশের এক পর্যায়ে হাতটা সীমার নিতম্বের উপর দিয়ে অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টিতে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে
দুধের বাটি নিয়ে সীমার নানি ঘরে ঢুকে দেখছে আলেয়া সীমার নিতম্ব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে।
চাপা ভীতু আর রাগন্বিত কন্ঠস্বরে ধমক দিয়ে ঘরের দরজাটা ভিতর দিয়ে লাগিয়ে দিল । আর বলে উঠলো- তোকে আমি কতবার বলেছি এমন করে কখনও দেখবি না । লোক জানা জানি হয়ে গেলে তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে
কতদিন গোপন রাখবো, আর কি ভাবে রাখবো। একদিন তো সবাই জেনে যাবে
আজ, কাল, পরশু তোকে সারা জীবন গোপন রাখতে হবে । যতদিন তুই বেঁচে থাকবি গোপন রাখ কেউ জানবেনা । একথা কেউ যানেনা তুই আমি আর দাইমা ছাড়া
কিন্তু মা, দাই যদি কোন দিন বলে দেয়
দেবে না, মোটা টাকা গুজে দিয়েছি ওর হাতে । ধর্মের কসম দিয়েছি, কোন দিন বলবে না
মা, তারপরও যদি কেউ জেনে যায় ?
তখন ওরা তোর বুকের মধ্যে হাত দিয়ে খাবলে নেবে তোর হৃৎপিন্ডটাকে । তোকে নিঃশেষ করে দেবে । ওদের লজ্জাস্থান নেই । লজ্জাজ্ঞানও নেই । ওরা বহু রঙের ভন্ডামীর পোশাক পরে তোর সন্তানের জন্মগত ক্ষতিচিহ্ন গুলো নগ্ন করবে
ভীত সন্ত্রস্ত মা সন্তানকে বুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে । এ শক্ত বাঁধন যেন কোনদিন ছাড়েনা । এ বাঁধন পৃথিবীর অশুভ শক্তি থেকে তার সন্তানকে দুরে রাখার বৃথা প্রয়াস

সরল প্রাবন্ত সীমা কৈশোরে পাড়ি জমাচ্ছে। ছেলের চাইতে মেয়েদের সাথে সখ্যতা তাকে বেশী সাচ্ছন্দ দিচ্ছে । স্কুলে আসা যাওয়া পথে আড়চোখে মাথা থেকে পা অবদি অবলোকন করে রুমা, মারজান, আয়েশা, কিংবা সাথীকে । বার বার সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করে তাদের শরীরের সাথে । ঈর্শ্বান্নিত বোধ করে তাদের সুডৌল স্তন, চিকন কোমর, ত্বকের নমনীয়তা দেখে । বড় বিরক্ত লাগে তার মায়ের দেওয়া থার্টি সিক্স সাইজের ফোমের ব্রা । যেন জোর করে চেপে বসেছে তার বুকের উপর । বড় শ্বাস রুদ্ধকর হয়ে উঠে

সীমা কান পেতে শুনতে পায় তার কালো জামার নিচে তারা চিৎকার করে কাঁদছে। নিজের দেহটাকে সে আবিস্কার করেছে গোসলের সময়। বড় পরখ করে দেখেছে তার নিজেকে, নিজের দিকে তাকাতে তার ভয় হয় । মনে হয় এটা তার শরীর নয় । ভুল ক্রমে চলে এসেছে । বড় বিব্রত হয় তার শরীর দেখে । যখন তার চোখ পড়ে কোমরের কাছে কালো তিলে । সেটাকে তার পছন্দ হয় । বড় ভালো লাগে । তার শরীরের অস্বাভাবিক গড়ন তাকে চিন্তিত করে । ফুটে উঠছে তার শরীরের বিকৃত চিহ্ন। এতোদিন সে ছিল নারী মতো । এখন তার মাঝে নারীত্ব হারিয়ে পুরুষালী হাব ভাব ফুটে উঠছে । নিজের  যৌনাঙ্গের বিকৃতি তাকে ভাবিয়ে তুলছে

সে এখন বুঝতে পারছে আর দশটা ছেলে কিংবা মেয়ের মতো স্বাভাবিক নয় । নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার সংশয় আর অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে । মানসিক রাজ্য তার তুমুল বিপর্যয়ের সম্মুখিন হচ্ছে । ভয় সংকোচ দ্বিধা তার মানসিক বিকাশকে ব্যহত করছে
জানালা দিয়ে চলে আসা জোছনা সীমাকে স্পর্শ করছে । তার মায়ের ঘুমনোর সদব্যবহার করছে । তার মা বড় অধৈর্যের সাথে পর্দা ঝুলিয়ে চাঁদটাকে বাইরে রাখে । সীমার মনে পড়ে না তার মা সারা জীবনে কখনও একবার হেসেছে কিনা । বাবাও ছেড়ে গেছে তাদের অজানা কোন কারণে । নানীও পাড়ি জমিয়েছে আকাশের দেশে।
মা ঘুমিয়ে আছে । মায়ের মাথার কাছে অপরাধির মতো দাড়িয়ে আছে সীমা । কতটা সময় পেরিয়ে গেছে তার কোন হদিস নাই । মা তাকিয়ে দেখছে সীমা এভাবে তাকে দেখছে
কিছু বলবি
মা তোমার বড় কষ্ট তাইনা
কষ্ট, কিসের কষ্ট ?
মা আমার বড় ভয় হয়
ভয়, কিসের ভয় ?
মা এখন অমি সব জানি, সব বুঝি, ওরা আমাকে নিয়ে যাবে । নিয়ে যাবে তোমার কোছ থেকে
না, না তুই শুধু আমার সন্তান, আমি তোর জন্য পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করবো
সীমা মাকে জড়িয়ে ধরেছে । যেন মায়ের বুকে সে চির আশ্রয় চায়

ভোরবেলা একা হাটতে বেশ আরাম । শিশিরে পা ভিজে যায় । শীতল , ফুরফুরে বাতাস বকুলের মন কাড়া আকর্ষ। ভোরে সীমা আজ ঘরের বাইরে । কিন্তু বকুলের আজ গন্ধ নেই । বকুল তলায় কত ফুল পড়ে আছে । কামিজের আঁচল কতগুলি ফুল কুড়িয়ে নিয়েছে সীমা । বকুলের মালা গাঁথবে । দেবতার পায়ে অর্চনা দেবে । প্রসন্ন হয়ে স্বর্গ থেকে দেবতা নেমে আসবে,  তাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে
সময়টা প্রচন্ড দূষিত নগ্ন । সীমার কন্ঠস্বর ভারী হয়েছে । শরীরের পুরুষালি ভাব প্রকট হয়েছে । বুকটাও পুরুষের মতো চ্যাপ্টা আবার চোখের চাহনী অঙ্গ সঞ্চালন মেয়ের মতন। আশে পাশের সবাই ফিসফিস করছে । গুজব ছড়িয়ে পড়েছে । ওড়নার আঁচলে বকুল ফুল নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই হতবম্ব হয়ে গেল।
সাত-আট জন মানুষ বাড়িতে উচ্চস্বরে কথা বলছে । হয়তো মায়ের সাথে বাক বিতন্ডা হচ্ছে । সবাই মেয়ে মানুষের পোষাকধারী, কিন্তু পুরুষালী ভাব । চওড়া বুক, প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই কোমর দুলাচ্ছে। জংলি ছাপার শাড়ি উঁচু করে পরা । সস্তা পাউডারের বেখায়ালি প্রলেপ , উঁচু করে খোঁপায় জড়ানো দুধরাজ সাপের মালার আলিঙ্গন । এক অদ্ভুত তালি দিচ্ছে । এর আওয়াজও অদ্ভুত। প্রত্যেকের একই রকম তালির আওয়া, আশ্চর্য মিল । তালি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে সীমার দিকে । একজন আঙ্গুল উঠিয়ে কপাল থেকে গাল, গালথেকে চিবুক, চিবুক থেকে বুক অবদি এমন ভাবে আলতো ভাবে আঙ্গুল বুলালো যেন এ শরীর তাদের চেনা । এযেন বহু পরিচিত কেউ

মা দৌড়ে এসে সীমাকে তার পিনে আড়াল করার চেষ্টা করছে আর বলছে- দিবনা আমি দিবনা । এ আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে
এক বৃদ্ধ তার মধ্যমা আঙ্গুলের মাথায় সিগারেটের ফিল্টার তর্জনী দিয়ে টোকা দিয়ে ছাই ফেললো কিন্তু সিগারেট  ফেললো  না । গাঁজার উল্কির মতো করে দুটো টান দিল জোরে জোরে । ফিল্টারের গোড়া ঘেষে গন গনে আগুন । সিগারেটের মাথায় শেষ মশলাটুকু পুড়তে পুড়তে আগুনের তীব্রতা আরও বেড়ে গেল। এবার মুখথেকে সিগারেট টা নামিয়ে রাখলো । তখনও জোনাকির আলোর মতো আগুন জ্বলছে । এতক্ষ সে চুপ করে দেখছিল, এবার সে কথা বলে উঠলো । ভারি কন্ঠস্বর, চারিদিক কম্পিত হয়ে উঠলো
‘অলো- দিবিনা কেন ? হিজড়ে হয়েছে, হিজড়ের ডেরাই তো তার আপন ঠিকান বলে নব্বই ডিগ্রি কোণেএকটা তালি দিল।
হিজড়ে, হিজড়ে হবে কেন । ও প্রতিবন্ধি, যৌন প্রতিবন্ধি, আমার মেয়ে । আর দশ জন যেমন প্রতিবন্ধি ও তেমনি প্রতিবন্ধ
হ্যাঁ তুই যে নামেই ডাক, যৌন প্রতিবন্ধি, ক্লীব, তৃতীয় লিঙ্গ, অজনক, ষাঁড়া, বৃহন্নলা, মহল্লক, সুবিদ, পুংস্তহীন, পুরুষত্বহীন, নপুংসক, খোজা,  সব নামের একই অর্থ- হিজড়া, হিজড়া, আর হিজড়া
না, না, না ও আমার মেয়ে সীমা বলে মা তার সন্তানের অস্তিত্বকে অসহায়ের মতো গোপন করার চেষ্টা করছে । মা কখনও ভাবেনি তার মিথ্যার দালান ভেঙ্গে চুরে ছার খার হয়ে যাবে।
গুরু মা সিগারেটটা আর একটু টানদিয়ে নিচে ফেললো । এবার সীমার হাত ধরে সজোরে টান দিল। এপ্রিলের বসন্তী সকালে সীমা হাটা ধরলো অজনারা উদ্দেশ্যে
মা হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদছে ।  তাঁর দৃষ্টি থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল সীমা । এক সময় পথের বাঁকে হারিয়ে গেল তাঁর সন্তানের চিহ্ন

হিজড়ের ডেরায় পৌছতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল । বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই সীমার আকস্মিক বোধ হলো যে, সে আর কোনদিন বাড়ি ফিরে যাবে না । এক শুন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে । আরম্ভ হয়েছে শূন্যতার । চারিপাশে  হিজড়ারা তাকে ঘিরে ধরে স্বাগত জানাচ্ছে । কিন্তু সে নিশ্চুপ হয়ে শূণ্যতার মাঝে দাড়িয়ে আছে । এত শব্দ-ধ্বনি, কোলাহল, উলুধ্বনি তার কানকে স্পর্শ করছে না । গুরুমা ব্যপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বললো- আজ থেকে আমিই তোর মা আর তুই আমার মেয়ে । এরা সবাই আমার মেয়ে । সবাইকে বলে দিল আজ থেকে তোরা সীমাকে সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নিবি। আদব-কায়দা, নাচ-গান সব । নিজেকে তার বড় ঘৃণা হচ্ছে। এই বিকৃত সমাজে নিজেকে মানতে চাইছে না দিন যায়,
সীমা নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। রপ্ত করেছে সমস্ত আদব কায়দা। এই মেয়ে চেহারার পুরুষালি ঢলে উঁচু করে টান টান শাড়ি পরে চড়া আচরনে গৃহস্থির সাথে কথা কষাকষি করে টাকা আদায় করে। বাচ্চা নাচানোর এক পর্যায়ে বাচ্চার ঠোঁট তার নিপলে  স্পশৃ করায় আর মনেমনে বলে- আঃ কি সুখ। উঃ কি আনন্দ

আর তখনই বাচ্চার মা তার কোল থেকে ছিনিয়ে বলে- কাক ময়ুর হয় না, আর হিজড়ে মা হয় না
পাশ থেকে কোন একজন বলে উঠে বৃহন্নলার কপাল, সন্তানের আকাল
ভিড়ের ভিতর থেকে হাসা-হাসি করতে করতে কে যেন বলে উঠে
যতই নাচো, যতই কোঁদো
পরের নিয়েই করবে তা
নিজের পাপে কোল ফাঁকা
অভিশাপ যে, কি করবে তা?
হা- হা- হা।
মূর্ষে পড়ে সীমা । মাতৃত্বের কাছে অসহায়, তারও যে মা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে । এ যেন স্বর্গের ধ্বনি। এ ডাকে পরম শান্তি । ব্যকুল হয়ে যায় । চার পাশে হাহাকার । বিধাতার ভূলের কাছে সে অসহায় । সমাজের কাছে সীমারা অবমাননা, মর্যাদাহীন তামাশার পাত্র