তটিনী
বহুদিন পরে সরযূ এসেছে বাড়িতে । সবাই তো অবাক । বাবা, এমন দেখতে হয়েছে তাকে ? আট বছর পরে তাকে যেন তার মা পর্যন্ত চিনতে পারছে না । আট বছর আগে কি সে এত সুন্দরী ছিল ? রূপের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের অদ্ভুত সমাহার হয়েছে সরযূর । বয়স মানুষের ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে পালটে দিতে পারে সরযূকে না দেখলে
যেন বিশ্বাসই করা যায় না ।
মামা বিনোদ তার কাঁধে হাত রেখে প্রতিমাকে বলল, সরযূ তোদের গ্রামে বিডিও হয়ে এসেছে রে । মস্ত বড় সরকারী
অফিসার । এবার আর তোদের গ্রামের উন্নতি ঠেকায় কে ?
মায়ে-মেয়েতে বহুদিন পরে দেখা । প্রতিমার
সাধ মেয়েকে সে প্রাণ ভরে দেখে বেশ খানিক্ষণ । কিন্তু মুহূর্তে একটা বিষম লজ্জা এসে
গ্রাস করে । একটু তাকিয়েই লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয় সে ।
- দেখ, আট বছর পরে তোদের মেয়ে কি হয়ে ফিরেছে, বিনোদ বেশ গর্বের সঙ্গে বলে, অথচ তোরা –
বাবা সতীশ এসে ঘরে ঢুকেছিল
কিছুক্ষন আগে আর হাঁ হয়ে মেয়েকে দেখছিল । বাবা হয়ে মেয়েকে চিনতে না পারার কষ্টটা
কাঁটার মত বিঁধছিল তার । আর এর মধ্যেই আবার একটা কাঁটা বিনোদের ঐ কথাটা । অথচ
কথাটা তো মিথ্যে নয় । আজ থেকে আট বছর আগে সরযূর মনের ওপর যে সাংঘাতিক ঝড় বয়ে
গিয়েছিল তার জন্য দায়ি আর কেউ ছিল না । ছিল তার নিজের বাবা-মা-ই ।
মাধ্যমিক পাশ না করতেই বিয়ের সম্বন্ধ দেখা হয়ে গিয়েছিল । একবারও মেয়ের মনের ইচ্ছেটা জানার দরকার বোধ করে নি তারা । বিয়ের
তিনদিন আগেই মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে । গাঁ ময় একেবারে ঢি ঢি কাণ্ড ।
কিছুদিন পরে খোঁজটা কলকাতা থেকে সরযূর
মামাই জানিয়েছিল । আর জানিয়েছিল, তোদের মেয়ে
আর কোনদিন তোদের ওখানে ফিরে যাবে না । এখানে আমার কাছে থেকে লেখাপড়া শিখবে । তোরা
কখনও ওর খোঁজ করবি না ।
সেই সরযূ আজ আট বছর পরে ফিরে এসেছে । মেয়েকে
বুকে টেনে নিতে পারছে না । সতীশ বড় আত্মগ্লানিতে
ভুগছে । একটা প্রবল সংকোচ ওকে বাধা দিচ্ছে ।
- কি বাবা, আমার ওপর রাগ করেছ ? আমায় কাছে নেবে না ? সরযূ হাসছে ।
সব জড়তা
কাটিয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিল সতীশ । কাঁদতে কাঁদতে বলল, কোথা থেকে
পড়াতাম বল ? দুবেলা খাবার তো তেমন করে জোটাতে পারি নি ।
- সাধ্য কি
আমারি ছিল শালাবাবু ? কিন্তু
ইচ্ছেয় কি না হয় ? বিনোদ বলল, তোমার
মেয়েকে স্বাবলম্বী করে দিয়েছি কোন কাল থেকে । নিজের পড়ার ফাঁকেই ছোট ছোট
ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে যা রোজগার করত তাতেই ওর পড়ার খরচটা হয়ে যেত । আর মামার সংসারে
নুনভাত –
মেয়ের
কপালে চুমো খেয়ে সতীশ বলল, আজ তুই কত
বড় অফিসার –
-কে বলল ? সরযূ হাসল, আমি তোমাদের সেই সরযূই আছি গো । আমার প্রথম পরিচয় আমি তোমাদের মেয়ে ।