হ্যান্টেড কাহিনী--৫৭
আক্রান্তকাল
--ভ্যাকসিন তো বেরিয়ে গেল--
কে? কে?? রোহিত চমকে উঠলোl
খানিক স্তব্ধতার পর বাতাসে ইকো সাউন্ডের মত ভেসে এলো, আমি রে রোহিত,
তোর দাদু--
রোহিতের দাদু পরেশ বাবুর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। রেস্টিকসানে থাকা সত্ত্বেও কি ভাবে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তা জানা নেই।
করোনা মহামারীর সময়কার কথা। এটা প্রচন্ড ছোঁয়াচে রোগ এমন একটা ধারণা
সবার মনের মধ্যেই ছিল। করোনা হওয়া মানে তা মৃত্যুর নামান্তর। রোহিতের দাদুর এ রোগ
ধরা পড়ার পরে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হল। সেখানে নার্স ডাক্তাররা তাকে ছুঁতে পর্যন্ত
নারাজ ছিল। কোন ওষুধ অসুস্থ দাদুকে নিজে নিয়ে খেতে হত। ঘরের কারো তাকে হসপিটালে গিয়ে
দেখা করা মানা ছিল। এমন কি রোহিত জানতে পেরে ছিল হসপিটালে দাদুকে ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন
হলে দাদু থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে তা ছুঁড়ে মেরে ফুটিয়ে দেওয়া হত। হসপিটালে রোগীর
মৃত্যু হলে রোগীর ঘরে জানানো হলেও মরদেহ বাড়িতে ফেরত দেওয়া হয় না। সরকারী ভাবে মৃতদেহ
কোথায় সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তাও জালানো হয় না। অধিকাংশ মৃতদেহ নাকি মাটিতে
পুঁতে ফেলা হয়।
রোহিতের দাদু সে সময়টা আতঙ্কে থাকতেন, রোগের সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক ও যন্ত্রণার
মধ্যে দিয়ে হসপিটালে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন। এক দিন সকালে রোহিতদের ঘরে খবর এলো,
রোহিতের দাদু মারা গেছেন। তাঁরদেহ সৎকার করা হবে। দাদুর কোথায় কি ভাবে কখন সৎকার হবে
এ ব্যাপারটা হসপিটাল কর্তিপক্ষ কাউকে জানাল না। মরদেহ দেখার কারো অনুমিতি ছিল না। তবু
রোহিত মন খারাপ নিয়ে হাজির হয়ে ছিল দাদুকে দেখতে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর এক ডোম দাদুর
মৃতদেহটা দেখিয়ে দিয়ে ছিল রোহিতকে। রোহিত দেখতে পেলো দাদুর মৃতদেহ আলাদা ভাবে চেনার
কোন উপায় নেই। এখানে মানুষের নাম নেই ! নির্মম দৃশ্য আর দেখতে পারছিল না রোহিত। নিজের
অজান্তে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসছে তার বুকের ধুকপুকানি শব্দ থেকে, দাদু, দাদু,
বেদনার্ত ডাক বেরিয়ে আসছিল। মোটা পলিথিনের নীলরং চাদর দিয়ে দাদুর সমস্ত দেহটা ছিল
মোড়ানো। পাশে একটা ঠেলা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রোহিত। সেই ঠেলাগাড়িতে দাদুর মৃতদেহর
সঙ্গে আরও চারপাঁচটা মরদেহ চাপিয়ে সৎকারের জন্যে নিয়ে গেলো। রোহিত ঠেলার সঙ্গে যাবে
ঠিক করে ছিল কিন্তু কিছুতেই তাকে যেতে দেওয়া হল না।
রোহিত পরে জানতে পেরে ছিল যে দাদুকে ওরা নিমতলা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে
দাহ করিয়ে ছিল। এ দাহ ছিল অনাম দাহ। মানব সভ্যতার অত্যন্ত অবহেলিত এক দৃষ্টান্তের নজির।
সে দিন নাকি সব মৃতদেহকে ঠেলা থেকে নামিয়ে বড় বড় লোহার হুক দিয়ে টেনে টেনে শ্মশানে
নিয়ে যাওয়া হয়েছিল !
এ এক মহামারীর কাল, এ সময় মানুষ আপনজনকে পর বানিয়েছে, নিজেদের বা
নিজেকে বাঁচাতে এক অস্পৃশ্য জেলের পরিবেশে বন্দি বানিয়েছে। এ যে দমবন্ধ করা যন্ত্রণাময়
এক ভয়াবহ সংক্ৰমণকাল।
ইতিমধ্যে নিয়ম রক্ষার্থে পরেশ বাবুর শ্রাদ্ধ পালিত হল।
দাদুর মৃত্যুর পর রোহিত রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারে না। সে যেন রাতের
নির্জনতায় দাদুর গলা শুনতে পায়--দাদু যেন তাকে বলছেন--কি দাদু, কেমন আছো ? আবার কখনো
যেন রোহিতের পাশ থেকে হঠাৎ দাদু বলে ওঠেন, কি খবর বল দাদু ভাই ?
এ নিয়ে রোহিত অনেক ভেবেছে, এটা কি তার মনের ভয় থেকে সৃষ্টি হচ্ছে
?
সে দিন রোহিতের ঘুম আসছিল না। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে সে আলাদা একটা
ঘরে থাকে। ঘরের একটা জানালা আছে, জানালা খুলে সামনেই চোখে পড়ে তাদের ফুলের বাগান ও
তারপর রাস্তা। মধ্যরাত চলছিল, ঘুম আসছিল না তার। দাদুর কথা খুব করে মনে পড়ছিল। তার
মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিল। বিছানা ছেড়ে উঠে এলো সে, জানালার একটা পাট খোলা ছিল--বন্ধ
পাটটা খুলে দিল সে। জালনা ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল, না, ভয় পাচ্ছিল না, সে তার
দাদুকে কেন ভয় পাবে ? দাদুর সঙ্গে সবচে বেশী অন্তরঙ্গতা তো ছিল তারই। আজ যদি তার দাদু
সত্যি ভূত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় তবে রোহিত ভাবলো, না সে ভয় পাবে না--
ঠিক এমনি ভাবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল। রোহিত বাইরে
বাগানের দিকে তাকালো। অন্ধকার চারদিক, রাস্তার লাইট জ্বলছে, রোহিতের মনে হল, চারদিক
যেন বড় স্তব্ধ হয়ে আছে ! ঠিক এমন সময় সে শুনতে পেল, ভ্যাকসিন এখনো বের হল না রে--
--কে? কে ?? চমকে উঠল রোহিত।
একটু নিস্তব্ধতার পর বাতাসের শব্দের মধ্যে থেকে ভেসে এলো, আমি রে, তোর
দাদু !
রোহিতের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, দাদু !
--হ্যাঁ রে আমি, শ্রাদ্ধ পেলাম, এবার চলি--
--তুমি কেন চলে যাবে দাদু ?
--সবই বিধির বিধান রে ! দুঃখ যন্ত্রনা মৃত্যুকষ্ট--
এবার দাদুর অস্পষ্ট শরীরটা ভেসে থাকতে দেখল রোহিত। দাদুর পা দুটো মাটিতে
লেগে নেই, অন্ধকারে সাদা পেঁজা তুলোর মত তার দেহটা ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
--তোরা ভালো থাকিস, চলি--
ব্যাস, আর কিছু নেই, রোহিত দেখল, দাদুর পেঁজাতুলোর মত শরীরটা কথাও ভেনিস
হয়ে গেছে। সে বলে উঠল, দাদু দাদু--তুমি কোথায় গেলে ?
না কিছু নেই, কারো সাড়া নেই, রোহিত দেখলো, বাইরে রাস্তা, সামনের বাগান,
সবকিছু যেন নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে।