গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১

ভীষ্মদেব সূত্রধর

 


তিমিরান্ধস্য


মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এলো, আশ্রয়ের জন্যে ভাঙা স্কুল ঘরে জনা কতক ছিল বটে, এখন মাত্র দুজন বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এর থেকে। বিভু আধ ভেজা কিন্তু অন্যপ্রান্তে যে যুবতী দাঁড়িয়ে ছিল তার শরীর জবজবে ভেজা, চুল থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে বুকে, অন্তর্বাসহীন বুক জেগে উঠছে চরের মতো, বিভু সেদিকেই তাকিয়ে আছে নিষ্পলক, না মোটেও ভ্রুক্ষেপ নেই যুবতীর, সে দাঁড়িয়েই আছে। বিভুর হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে যায়, শরীর তেতে ওঠে, স্তনবৃন্তে হা করে চেয়ে থাকে উঠতি যৌবনের স্বাদে, ভেতরে প্রতঙ্গটি নড়েচড়ে ফের শান্ত হয়। বৃষ্টির ছাঁট আসে গায়ে পড়ে, থামবার বিরাম নেই। যেন আরো কষে মেঘ গলছে, একটা অটো এসে সামনে দাঁড়ালে যুবতী তাতে ওঠে এবং মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যায় অটো, আবছা অন্ধকারে আর বেশিদূর দেখা যায় না, পৌরসভার বাতিগুলো একে একে জ্বলে, কাঁদা পথে দুটো গাড়ি ছুটে চলে যেতে জলকাদা ছুঁড়ে মারে এবং মিলিয়ে যায়। বিভু হাতঘড়ি দেখে, আর থাকা চলে না, ওদিকে চারদিক ফাঁকা আর গুমোট অন্ধকার, পা ফেলে এগোয়, কিছুদূর যেতে থমকে দাঁড়ায়। উফ শিট! চটির ফিতে ছিঁড়ে গেছে, অগত্যা খুরিয়ে চলতে চাইল, যেহেতু দ্রুত যাওয়া চাই তাই জুতো জোড়া হাতে নিয়েই চলবার কথা ভাবল সে। কলেজ স্ট্রীটের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ বা যে কটা দোকান খোলা আছে সেখানেও ভিড়ের বালাই নেই, এমন বৃষ্টি অনেকে উপভোগ করছে , অনেকের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। 

মোড়ের কাছে এসে তাকাল, পানের দোকানে দুটো মুরুব্বি বেঞ্চিতে এক পা তুলে গল্প করছে, পানের পিক নালা দিয়ে গল গল করে ভেসে যাচ্ছে, লাল টকটকে রঙ জলে মিশে বিবর্ণ হয়ে পেছনের মজা পুকুরে পতিত হচ্ছে। বিভু আবার দাঁড়াতে চাইল কিন্তু অন্ধকার যেন জেঁকে বসেছে, ঠকঠক করে কাঁপছে, শীত করছে তার, ভীষণ! এই কিছুক্ষণ আগে গরম হয়ে গেছিল, নেতিয়ে পড়া অঙ্গটি তার কাছে এখন জড় পদার্থ অথবা শুন্য বোধয় সেখানে কিছুই নেই। হাঁটতে হাঁটতে পৌছে গেছে ব্রিজের ওপর তারপর মশাল মোড়। বিভুর ভয় করছে, গত ১০ তারিখে এখানে জোড়া খুন হয়েছিল শহরে যেটা চাঞ্চল্যকর, মারোয়াড়ি দম্পতি যারা এই মোড়েই শুয়েছিল রক্তাক্ত দেহে, পুলিশ বলছে ছিনতাইকালে খুন হতে পারে কিন্তু শহরে প্রচারিত হয়েছে সম্পত্তির জের ধরে বেহারি সন্ত্রাসীরা এ কান্ড ঘটিয়েছে।। পুলিশ অবিশ্যি দুটো নিরপরাধ সাঁতাল ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে, তুলে নিয়ে গেছে কোথায় সে খবর আর কারো কানে পৌছোয়নি। বিভুর ভয় কাটেনি, মেপে মেপে পথ চলছে কাঁকর বেছানো পথে, জড়ভরত অবস্থা থেকে এখন দ্রুত আরো দ্রুত চলতে চাইছে। বেশ নবছর আগের কথা, বিভু তার বাবার হাত ধরে গিয়েছিল টুনিরহাটে, শুক্রবার হাটের দিন, ফেরবার পথে তুমুল ঝরবৃষ্টি, ভ্যান রিকশার দেখা নেই, নেই কোনো পথিকও, কেই বা থাকে! বাবা সদাশিব বাবু জোরে জোরে রাম নাম জপতে জপতে ছেলের হাত মুঠোয় ধরে এগোচ্ছেন, একটা ইউক্যালিপটাসের ডাল মরমর করে ভেঙে পড়ল পায়ের কাছে, ইষ্টদেবতা ভেঙচি কাটছে! অবশেষে মাঠের কোণে এক চালা ঘরে যেখানে বোধকরি গেরস্থের গবাদিপশুর ঠাঁই হয়নি তাতেই ঠাঁই নিলেন সদাশিব বাবু। কত কিছু ভাবতে ভাবতে বিভু এসে থামল হোটেল নর্দানের ঘুপচি বাড়ান্দায়, না এখানেও কেউ নেই যেন, মৃত একটা অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে, শাদা একটা জাপানি গাড়ি পার্ক করা হোটেলের কাছে, পায়ে কাদা ভেজা শরীরে বিভত্স মনে হচ্ছে তার, প্যান্টে কাদার নকশা বুনন, মেঝেটা ততক্ষণে ভিজে গেছে, দূর থেকে কোনো বয়স্কার উচ্চস্বর শোনা যাচ্ছে, এগিয়ে গেলে বুঝতে পারে হাত ইশারা করে তাকেই ডাকছে, বয়স ঠাহর করা গেল না তবু পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে এবং বেশ স্বাস্থ্যবান ও সুন্দরী। বয়স্কাকে খুব ব্যস্ত মনে হলো। কাছে এসে বললেন, তুমি তো ভিজে গেছ বাবা, যাও মুছে নাও।

তারপর কাকে যেন গামছা দিতে বলে উধাও হলেন তিনি, বৃষ্টির সাথে বাতাস বইছে, মোটা একটা লোক গামছা দিয়ে সরে গেল। বিভু যতটুকু পারে মুছে নি ল শরীর, এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু পেলনা, ডাক দিতে সংকোচ করছে, ওর বড় লজ্জা। বয়স্কা নিজেই এলেন এবং বললেন, চা খাবে?

বিভু বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে কথা বললনা । উনি আবার বললেন, ঐখানটায় বসো।

দেয়াল ঘেষে একটা হাতলভাঙা চেয়ার আছে তাতেই বসতে বললেন। বিভু বসল না কিন্তু কম্পিত কন্ঠে বলল, আমার কাছে পয়সা নেই, সব ভিজে গেছে।

বয়স্কা কিছু বললেন না মেকি হাসলেন। বিভুর সংকোচ বেড়ে গেল, কে ইনি? আগন্তুকের সাথে তার কী পরিচয়? ওই মোটা লোকটিই চায়ে'র পেয়ালা হাতে দিয়ে সরে গিয়ে বয়স্কার কানে কানে কিছু বলে দাঁড়িয়ে রইল হুকুমি পেয়াদার মতো, সিঁড়ির দিকে কয়েকবার চেয়ে বলল, উঠি বাবা। ফের এসে নামধাম শুনবো।

ওঁরা অন্তর্হিত হবার পর বিভু আকাশ নিরীক্ষণ করে আবার চেয়ারে বসল, মোটেও ছাড়বে না এ বৃষ্টি, রাত আটটা বেজেছে কখন হাত ঘড়িতে তাকিয়ে তাই বিড়বিড় করে বলল। গাঢ় অন্ধকারে বিদ্যুত্ লোডশেডিং, রাস্তার বাতিগুলো নেভানো, হোটেলে জেনারেটর ঘরঘর আওয়াজে যা আলো দিচ্ছে তাই, অল্প আলোতে দুজনকে আসতে দেখে দাঁড়ায়, একটা নারী তার কাঁধে হাত রাখা একটা টেকো বুড়ো গোছের কেউ সিঁড়ির কাছে এসে থামে, বুড়োর হাত নারীটির কাঁধ থেকে বুক অব্দি ঝুলছে, নারীটি চিত্কার করে বলল, খানকির পো এইবার মাগনা পাবিনা, এর আগে ফ্রি খাইছিস।

বলেই বিভুর দিকে চাইল বোধয় লজ্জাও পেল এইমাত্র বলা কথাটিতে। হা টেকো মাথার বুড়ো লম্বা জোব্বা পরিহিত, কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফ ছাটা যে দেখেই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আলহ্বাজ জমিরউদ্দীন রাসেলের বাবা। যে বলেছিল তার বাবা পয়গম্বর। সেই যুবতীটি যাকে স্কুল ঘরে দেখেছিল! কোথায় তার ভেজা শরীর! মাথা দুলে ওঠে এবং হাঁচি আসে। যুবতীটি মুচকি হেসে উপরে উঠতে থাকে। বিভু আর দাঁড়ায় না, চটি জোড়া হাতে নিয়ে ভিজতে ভিজতে পথ চলে নগ্ন পায়ে। আবার শীত করে ভয়ানক শীত, অন্ধকারেই দ্রুত পা চালায় গন্তব্যের পথে। বৃষ্টি মুষলধারেই পতিত হচ্ছে শহরে।রাস্তায়। হোটেলে। যুবতীর বুক ও জমিরউদ্দীনের হাত মিশে যাচ্ছে চোখের সামনে