কেয়ামত
আমাদের এলাকার প্রায় সর্বজনের হরিদার আর বাঁচতে ইচ্ছা হয় না। মাঝেমধ্যেই
বিরস-মুখে কাউকে-কাউকে শোনায়।তখন হরিদা বেশ আশার আলো দেখাতে চায় অন্য পক্ষ।
মোটামুটি সবার মুখে এককথা, ‘তুমি তো অসুখী নও। দুই ছেলে তোমার চাকরী করে। মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছ। আমরা যদ্দুর জানি বৌদি খুব ভালোমানুষ। পেনশন তো কম পাও না।তাহলে? এসব একদম ভেবো না।‘
শুনে হরিদা কিঞ্চিৎ কষ্টের
হাসি হাসে। কিছু বলতে চায় না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘বেশ’
বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
হরিদার সামান্য কথায়
বিরক্ত হয় শ্রোতা।
কেউ বা তখন অন্যের কানেকানে
বলে, ‘সুখ উপছে পড়লে বুঝি এমন হয়।‘
আমি দুদিন একটু দূর থেকে
এমন দেখেছি। উনি কেন অমন হতাশ তা নিয়ে মনে-মনে ভেবেছি খুব পরে।
একদিন বাবাকে হরিদার
হতাশার কথা বললাম। বাবা আমার কথা শুনে মুচকি হাসল। আমি বাবার হাসি দেখে বেশ অবাক হলাম।
বাবাকে বললাম, ‘তুমি
হাসলে যে?’
হঠাৎ বাবার মুখ কালো
হয়ে উঠলো। আমি বেশ থতমত খেয়ে গেলাম।
বাবা মুখ খুলল।
বলতে থাকলো, ‘ওর তো আগেই
মরা উচিত ছিল। এখন নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু একদিন ব্যাটা সাধু-বেশে অতিশয় পাকা চোর ছিল।‘
মা অতশত জানে না।
চোখ বড়-বড় করে বাবাকে
জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন, শুনি?’
আমি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলাম
বাবার কথা শোনার জন্য।
বাবা এবার মার দিকে তাকিয়ে
ঘৃণা-ভরা মুখ নিয়ে বলতে থাকলো, ‘বাইরের কথা আমি তোমাকে তেমন বলিনি কোনদিনও। আজ বলতে
বাধ্য হচ্ছি। ছেলের সামনে বলতেও আমার লজ্জা নেই।‘
বাবার মুখে এমন কথা শুনে
আমি বেশ চমকে উঠলাম। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম।
মা যুত করে বসলো বাবার
পরের কথা শোনার জন্য।
‘বলছি তবে শোন। আমি হরিদা
বলি না। সম্বোধনও করি না। আসলে ও হরণ হারামি। যে বৌকে দেখো ও কি আসলে ওর বৌ? অনেকবছর
আগে এক গরীব বন্ধুকে দিনের পর দিন নিজের পয়সায় মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে তার বৌকে একরকম
চুরি করে ও। আর নিজের আসল বৌ তার আগেই ওর সব লুচ্চামি দেখে বাপের বাড়িতে চলে যায়। ভাগ্যিস
বাচ্চা ছিল না।‘
মা শুনে’ উফ’ শব্দ করে
খানিক সময়ের জন্য অন্যদিকে মুখ করে নিলো। আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলাম।
বাবা আবার বলে চলল রাগে-রাগে,
‘বৌটা ভদ্র ঘরের মেয়ে ছিল বলে পরে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। পরে আবার বিয়ে হয়েছে। শুনেছি
তার পরের স্বামী ছিল বেশী বয়সেও অকৃতদার। তাকেই বিয়ে করে। এও শুনেছি, দুই প্রতিষ্ঠিত
মেয়ে আর তাদের বরকে নিয়ে খুব ভালো আছে এখন।‘
‘তারপর আর কিছু?’
মা বেশ কৌতূহলের সুরে
বাবাকে জিজ্ঞেস করলো।
আমি ততক্ষণে পাশের ঘরে
গিয়ে চুপচাপ বসে আছি।
বাবা উত্তর দিলো, ‘নিজের
চাকরীটাও ঠিক মতো করেনি কোনোদিন। রাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকতো। রাজনীতির সুবাদে অফিস ফাঁকি
দেওয়ার অনেক সুযোগ পায়। আবার সুদের ব্যবসাও করতো। শুরুতে গোপনে, পরে জানাজানি হয়ে যায়।
তাতেই বা কি। লজ্জা ছিল না একদম। আর অনেক পয়সা ছিল বলেই অনেকেই শয়তানটার তেলা মাথায়
তেল দিতো। বুঝি বিবেক জেগেছে এখন । অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে। কারও-কারও চোখে আজও ঘৃণার
পাত্র। সইছে না বুঝি আর। তাই এখন মরতে চায়। মরুক না আমাদের কি।
আমি পাশের ঘর থেকে বলে
উঠলাম, ‘অনেকেই কিন্তু হরিদা বলতে পাগল। কতজন তাকে সৎ বুদ্ধি দেয়।‘
আমার কথা শুনে বাবা হেসে
অস্থির। মার চাপা হাসি কানে গেলো।
বাবা বেশ চেঁচিয়ে বলল
আমার উদ্দেশ্যে, ‘জেনে রাখ ওরা তারা যারা একদা ওর দল করতো। আর অন্যায় করে ওর হাত ধরে
উদ্ধার পেয়ে যেতো। সেখানেও কিন্তু ঘুষ ছিল।‘
আমি শুনে চুপ।
হঠাৎ বন্ধু তপনের ফোন।
ও তড়িঘড়ি আমাকে বলল,
‘দেখবি আয়। হরিপদ সাহা চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে পথে মরে পড়ে আছে। দশ চাকার গাড়ি মেরে পালিয়েছে।‘
আমি শুনে আঁতকে উঠলাম।
দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এক পোশাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
যেই দরজার কাছে গেছি,
বাবা আমাকে পরামর্শের সুরে বলল, ‘খবরদার ওই শয়তানটার সঙ্গে দেখা হলে একটা কথা বলবি
না। নামেই গুরুজন, কিন্তু অসম্মানের পাত্র।‘
আমি শুনে হাসবো না কাঁদবো
বুঝে উঠতে পারলাম না। বাবাকে দুর্ঘটনার খবরটাও দিতে পারলাম না।
মনে-মনে বললাম, সে বাবা
নিজেই জানুক। কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয় জেনে যাবে।
বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু
হয়ে গেছে। একটু হাঁটতেই বৃষ্টির জোর বেড়ে গেলো। আমি বৃষ্টির মধ্যে একটু দ্রুত হাঁটতে
থাকলাম।
বাকি পথ আমার বারবার
মনে হল, ঈশ্বর বুঝি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামিয়ে কিঞ্চিৎ পাপ ধুয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার কতটুকু
আর সামর্থ্য। সভ্যতা যে প্রায় পাপের কয়লায় ঢেকে গেছে।