রোদ বৃষ্টি
ঘণ্টি বেজে গেছে আষাঢ়ের। তিন
সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কিন্তু বৃষ্টি নেই। দিন পাঁচেক আগে আশা জুগিয়ে কালো রঙ মেখেছিল
আকাশটা। তবে লাভ হয় নি কিছু। এক পশলা বৃষ্টি ঢেলে জমাট মেঘ হাওয়া।
আজকের আকাশেও মেঘ। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। কিন্তু জল আদৌ ঝরবে তো! হঠাৎ দেখবো মেঘ উধাও। ভাবনার জাবর কাটতে কাটতে ভ্যাপসা গরমে হাঁটছিল রাজকুমার। এলোমেলো চুল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে তিন দিনের না-কাচা জামা। জামার নিচে কোমরে বাঁধা ময়লা প্যান্ট। লম্বা শরীরটা নিয়ে সামনে ঝুঁকে হাঁটছিল রাজকুমার। অনেকটা বৃদ্ধ মার্কা চলন। পাড়ার অনেক বড়রাও মুখ লুকিয়ে হাসে। ঝন্টুদার চায়ের ঠেকে গেলেই খোঁচা খেতে হয়। স্কুলের বন্ধু বুলি একদিন অনেকের সামনে ঠেস মেরে বলল, ‘ওরে, একটু স্মার্ট হ রাজু। ঝকঝকে লুক না দেখলে কেউ চাকরি দেবে’?
কথাগুলো হয়ত ঠিক। এযাবৎ চাকরি
কেউ দেয় নি। কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউ গুলো ভালই দেয় রাজু। পড়াশুনায় বরাবরের এক
নম্বর। বাবা বেঁচে থাকলে এমএসসি পাশ করে ডক্টরেট ডিগ্রী বাগিয়ে অধ্যাপনা করতে
পারতো। তেমনি ভাবে রাজু। কিন্তু প্রকাশ করে না। শুনলে মা দুঃখে আরও ঝুঁকে পড়বে।
এমনিতেই শোক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মা। একটু যে স্বাচ্ছন্দ জোগাড় করবে সে ক্ষমতাও নেই।
নিজেকেই বলে, রাজকুমারটা শালা একটা অপদার্থ।
অপদার্থ রাজকুমার পাত্র কলেজ
ডিঙিয়ে কম্পিউটারের কয়েকটা কোর্স করেছে। ওয়েব ডিসাইন খানিক শিখেই চাকরীর খোঁজে
হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখন চলেছে চিঠির খোঁজে। বাড়ি থেকে পোস্ট অফিস। স্পিড পোষ্টে
চিঠি আসবার কথা। পোষ্টাপিসে বলে রেখেছিল রাজকুমার। চিঠি নিজে গিয়েই নিয়ে আসবে।
পোস্ট
মাস্টার ওর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা’। একটু পরে আবার, ‘কিসের
চিঠি’?
‘চাকরির’।
‘বাঃ’।
শব্দটায় মন ভরে গেছিল রাজুর। ছোট্ট শব্দ। চিঠিটা হাতে এলে
পরিচিত একশ মানুষ বলবে, ‘বাঃ’। জীবনটাই তখন অন্য রকম। বেকার থেকে সাকার। দু’টো শব্দ। পার্থক্য আকাশ পাতাল।
সাত দিন আগে ইন্টারভিউ দিয়েছিল।
শ্রীরাম ইনফোটেকে সেলসের চাকরি। গুজরাতি কোম্পানি। ভালো মাইনে দেয়। মালিক যোগেশ
প্যাটেলের কথায় মনে হয়েছিল, চাকরিটা হয়ে যাবে। হাসি মুখে প্যাটেল সাহেব বলেছিলেন,
‘চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই চিঠি পেয়ে যাবেন। খেয়াল রাখবেন, স্পিড পোস্ট’।
গতকালও চিঠি আসে নি। আজ নিয়ে
ছ’দিন। চিঠিটা আসবে কি? মাথায় ভোঁ ভোঁ করে চক্কর মারছে প্রশ্নটা।
একটু থামল রাজকুমার। আকাশে মেঘ।
বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। হঠাৎ মেঘের ফাঁক গলে সূর্য উঁকি দিল। একটু পরেই ঠাণ্ডা
হাওয়া হটিয়ে ঝাঁ ঝাঁ রোদ। রোদের তাত মাথায় মেখে খানিকটা পথ দ্রুত হাঁটল
রাজকুমার। অদূরে রাস্তার পাশে একটা প্রকাণ্ড জারুল গাছ। নিচে অনেকটা জায়গা জুড়ে
নরম ছায়া। বহু মানুষ দাঁড়িয়ে। রাজকুমারও দাঁড়িয়ে পড়ল ভিড়ে।
পাতার ফাঁক গলে তেরছা রোদ মাটি
ছুঁয়েছে। গরমে পথ চলতি মানুষের নাভিশ্বাস। মাথা তুলল রাজকুমার। বেগুনী থোকা থোকা
ফুলে ভরে আছে গাছ। গাছের উপর আকাশ। আকাশ জুড়ে আবার ঘনিয়ে এল মেঘ। কয়েক ফোঁটা
বৃষ্টি পড়ল গায়ে। রোদ-বৃষ্টি-মেঘ কেবলই লুকোচুরি চলছে।
‘রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি!’ মনে
মনে বলল রাজকুমার। রাজকুমারের ঠোঁটের দু’পাশে হালকা হাসি। বড় একটা শ্বাস ফেলল ও। জারুল গাছের সবুজ পাতা আর বেগুনী
ফুলের আড়ালে রোদ বৃষ্টি মেঘ দেখতে বিড়বিড় করল, ‘শালা লুকোচুরি! বেকারদের ভাল্লাগে
এ সব?’ --০—
[পরিচিতিঃ
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও
এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026; মোবাইলঃ 9831046252; E-mail: soumitrag10@gmail.com].