গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১

রত্না বড়ুয়া (মজুমদার)

 


এক বিন্দু নয়নের জল

 

 আজকাল দেখি ধর্ষণ নিয়ে খুব আলোচনা। আগে যে হত না, এমন নয়। কিন্তু মিডিয়া সোচ্চার খুব এখন।

 

এমন একটা গল্প এটা যে, একটু ভাবার আছে। ওপার বাংলার সুবিখ্যাত এক পরিবার। আর যাকে কেন্দ্র করে এই গল্প, সে এক নাবালক মেয়ে। কৈশোর পার না হওয়া।

 

ধরা যাক, মেয়েটির নাম পামেলা চ্যাটার্জি। তার মা অরুন্ধতী চ্যাটার্জি। অরুন্ধতী ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এস-সি। ভারতের একটি দুধের কোম্পানিতে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগে চাকরি পেয়েছিল। আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছিল তাকে। কিন্তু তার মা তাকে কিছুতেই যেতে দিলেন না। বললেন, কন্যা সন্তান, কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়বে, বিয়ে দেওয়া যাবে না। এখানেই থাকুক, চাকরি করুক, বিয়ে দেব এখানেই।

এই মা নিজে কিন্তু ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের টিচার। সুবিখ্যাত সেই পরিবারের সেই নতুন পাতা গজানো শুরু। কিশলয় পরিবার তখন।

দেশভাগের পরবর্তী সময়ে কলকাতা শহর ছিল সিনেমার প্রাণকেন্দ্র। উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন বিমল রায়। হিন্দি আর বাংলাতে অনেক ছবি করেছিলেন। নিজের ছড়ানো-ছেটানো বিরাট পরিবার থেকেই বেছে নিতেন তাঁর সিনেমার চরিত্র উপযোগী মানুষদের। তাদেরকে নানাভাবে তৈরি করতেন।

একটা কথা মানতেই হবে, কীভাবে যেন তাঁরা সকলেই কাজে নেমে পড়েছিলেন। খোঁড়লে পড়ে থাকলে মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায় না কখনোই। বেরোতে হয় একদিন না একদিন। তাহলে নিজের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আরও পাঁচজনের মুক্তির সন্ধান আনা যায়।

সেই সময়ে অনেকটাই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তাঁরা।

পারিবারিক পর্যায়ে পাওয়া যায় আদিনাথ সেনের নাম। তাঁর ছিল দুই কন্যা, এক পুত্র। এই গল্পের অনু-দি আর মণি-দিকে ধরা যাক, আর ছেলের নাম দিবানাথ। দিবানাথ ব্যবসায়ে প্রচুর টাকা ঢেলে মস্ত ধনী হয়ে গেলেন। টাকার জোরে অপরূপ রূপসী রমা সেনকে বিয়ে করলেন। সেই রূপসীর বাবা ছিলেন পূর্ব-বঙ্গের রিফিউজি। দেশ-ভাগের পর বোলপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে স্যানিটারি-ইন্সপেক্টরের কাজ পেয়েছিলেন। অনেক সন্তান। তাই তিনি এমন সুপাত্র হাতছাড়া করেননি। রমা সেনকে ভাগ্নের-বউ হিসেবে পেয়ে বিমল রায় তাকে সিনেমায় নামাতে দ্বিধা করলেন না। দিবানাথ দিনরাত টাকার নেশায় মত্ত। কিন্তু রমা সেন সিনেমায় নেমেই দারুণ নাড়া দিল। সুনাম ফেটে পড়তে লাগল। এক নতুন জীবন, নতুন পরিচিতি। নতুন নাম।

দিবানাথের কানে আসতে লাগল বউয়ের সুখ্যাতি। শত কাজের মধ্যেও বউকে নজরে রাখতে নিয়ম করে সে শুটিং-এ যাওয়া শুরু করল। হীনমন্যতা ধরল তাকে। সে বুঝে ফেলল, নবীন-প্রবীণ সব নায়কই এখন তার বউয়ের প্রেমিক হতে চাইছে। প্রেম নিবেদন করে ধন্য হতে চাইছে। কেউ কেউ বিয়ের প্রস্তাবও দিচ্ছে নিশ্চয়ই।

একদিন শোনা গেল, রমা সেনকে অ্যাসিড ছুঁড়ে আক্রমণ করেছে দিবানাথ। সে আর সহ্য করতে পারছে না, কিভাবে তার গেঁয়ো বউটা আজ সারা দেশের রানি হয়ে বসেছে। অনেক টাকা রোজগার তার এখন। এই টাকা তার নিজের টাকা। দিবানাথের কাছে চেয়ে নেওয়া নয়। এই টাকা কেউ তার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মেয়েটার রূপটা চাইলে তো শেষ করে দেওয়া যায়? সেই মত অব্যর্থ অ্যাসিড। কিন্তু ভুল বুঝেছিল দিবানাথ। সে চিকিৎসা করাতে না চাইলেও, গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে এলো। সুইটজারল্যান্ডে চলে গেল নায়িকা রমা সেন। পর পর কয়েকটা অপারেশন হল। তারপর দিব্যি ভালো হয়ে ফিরল।

এখন শুটিং শেষে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরতে হয় না রমার। ডিভোর্স হয়ে গেছে। তবে সিনেমায় নামানোর সময়ে বিমল রায় যে নাম রেখেছিলেন, সেটি আর বদলায়নি রমা। বিভ্রান্ত হতে পারেন দর্শকেরা। পদবীটা পর্যন্ত রয়ে গেল, যদিও তাতে স্বামী বা তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মান বাড়ানোর কোনও ব্যাপার নেই।

এই চরিত্রটি হল নারী স্বাধীনতার প্রতীক। রমা সহিংস অত্যাচারের থেকে সেই সময়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। অপারেশনের পর লাবণ্য একটু টাল খেয়ে গেলেও, অভিনয় যেন দিন দিন আরও অতুলনীয় হয়ে উঠতে লাগল। দিবানাথ ততদিনে কোন অতলে তলিয়ে গেছে। রমা তাদের একমাত্র কন্যাকে ইয়োরোপের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। দিবানাথ আর তার পরিবারের সু বা কু-দৃষ্টি কোনোটাই যাতে না পড়ে। অল্প দিনেই রমা হয়ে উঠেছিল কিংবদন্তি। কাজ নিত সে কম, যতটুকু সে করত, তা হয়ে উঠত অনন্য।

 

এই পরিবারের প্রথম ধাপটি ছিল সত্যিই অনন্য। সে ছিল উৎসাহ-উদ্দীপনার যুগ। তারপর দ্বিতীয় ধাপে এল অরুন্ধতী। সুযোগ যদিও সে অনেকটাই পেয়েছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী ছিল সে। কিন্তু তার মা, এই গল্পের অনু-দি হলেন রক্ষণশীল ধরনের মানুষ। তিনি বলতেই পারেন, মাইয়া মানুষের বিয়া কোথায় হইব কেউ জানে না, ঘরে থাক তুই। কিছু দিন পর কেন্দ্রীয় সরকারের এক প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড-অফিসারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। অরুন্ধতীর বাবার মত, অরুন্ধতীর বরও চাকরির দৌড়ে অনেক দূর গিয়েছিল। লিয়াকত-নেহরু প্যাক্টে চাকরি পাওয়া একটু সহজ হলেও, নিজেদের যোগ্যতা আর পরিশ্রমের দ্বারা এরা চাকরির প্রায় সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত পৌঁছোতে পেরেছিল। আর্থিক অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠেছিল আবার।

অনু-দি একদিন স্কুলে এসে আমাদেরকে গল্প করলেন, অরুন্ধতী আইজ আমারে খাইতে দিসে ইলিশ মাছের ল্যাজাখান। জামাইরে দিসে দুইখান পেটি। নিজে একখান গাদা, আর সব কাইলকার জন্য। বুঝব, বুঝব, নিজের মেয়ে তো এহই করব তর সঙ্গে।

সে হোক, অরুন্ধতীর মেয়ে পামেলা বড় হল একদিন। নাম খুব মিষ্টি হলেও, চেহারা কড়ির মত। মোটা কালো। আড়ালে লোকে হাসে, কী মেয়ের কী নাম। এই নাম তার বাবার রাখা। হয়ত অন্য কোনও স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু পামেলা ছিল লেখাপড়ায় খুব ভালো।

সেই কিশোরী পামেলার সঙ্গে এক বিকেলে আমার দেখা গড়িয়াহাটের মোড়ে। স্কুলের পথে এটাই ছিল ওর একটু দাঁড়ানোর জায়গা। স্কুল তার নটা থেকে, ছুটি তিনটেয়। এখন গড়িয়ার বাস ধরবে।

‘তুই কি মাঝে কোথাও নামবি? না হলে আমার গাড়িতে যেতে পারিস। তোকে পৌঁছে দিতাম মায়ের হাতে।‘

‘সে কী গো, মা তো এখনও স্কুলে। বলো দাদুর হাতে।‘

‘দাদু?’

‘হ্যাঁ, দাদুর বাড়িতে থাকি। দাদু আমাকে স্কুলের বাস থেকে রিসিভ করে।‘

‘বাহ, ভালো।‘

বেশ ভালো ব্যবস্থা। দাদু, ---অর্থাৎ অনু-দির বর। রিটায়ার্ড লাইফে বেশ ভালোই সার্ভিস দিচ্ছেন তিনি।

 

কিন্তু কি যেন ঘটে গেল। পৌঁছে গেলাম অভাবনীয় এক পরিস্থিতিতে। আমার বাড়ির খুব কাছেই শান্তিপিসির বাড়ি। তার বাড়িতে বাচ্চা-কাচ্চাদের ভিড় লেগেই থাকে। ছবি আঁকা, গান, নাচ, আবৃত্তি শেখানো হয় ওখানে। বাড়ির নামটাও মানানসই। কাকলি। খুবই কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই শেখানোর কাজটুকু শান্তিপিসি ও তাঁর মেয়ে করে থাকেন। মেয়ে তার আর্ট-কলেজ থেকে পাশ করে একটা স্কুলে আঁকা শেখাচ্ছে। শান্তিপিসির সেই স্কুলে একদিন দেখেছিলাম পামেলাকে। তাকে পৌঁছে দিয়ে তার মা স্কুলের জন্য দৌড়োল। যাবার আগে বলে গেল, ‘ওর দাদুর আরথ্রাইটিস খুব বেড়েছে, তবু পেনশনের জন্য ছুটতে হচ্ছে রোজ। রইল মেয়ে। দেখবেন। পরে উনি ঠিক এসে নিয়ে যাবেন।‘

পামেলার সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। কথায় কথায় সে জানিয়েছিল, স্টেট্‌সম্যান পত্রিকায় সে নাকি প্রায়ই লেখে। এতটুকু বয়সে? কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলাম, বয়সের তুলনায় তার জ্ঞানগম্যি, জেনারেল নলেজ, ইংরেজির ওপর দখল, সেইসঙ্গে জীবনবোধও অনেকটাই বেশি।

খানিক বাদে যে ভদ্রলোক এলেন তাকে নিতে, তাকে দেখে চমকে উঠতে হল আমায়। আমার চেনা। রোজই প্রায় দেখি। প্রাতর্ভ্রমণে বেরোন নিয়ম করেই। কিন্তু কেন জানি, ভদ্রলোকের চোখের দৃষ্টি কেন যে এত কূট এবং কদর্য লাগে আমার, বলতে পারব না। তাই হয়ত ভদ্রলোককে দেখলেই মনে হয়, এক ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ি।

একদিন জানা গেল, পামেলার দাদু আর নেই। অর্থাৎ মারা গেছেন। স্ট্রোক হয়েছিল। আশ্চর্য! কেন? আশ্চর্য হবার কি আছে?

কিন্তু পামেলা যে একা হয়ে গেল।

কেন? তার বাবা-মা-দিদা সকলেই তো আছে। তাছাড়া এই বয়সী মেয়ে, তায় উঠতি লেখক, তার এত একাকিত্ব কিসের?

কিন্তু তিনদিনও গেল না। পামেলা গায়ে কেরোসিন ঢেলে নিজেকে শেষ করে দিল। মুখে প্লাস্টার সেঁটে নিয়েছিল আগুন দেবার আগে, যাতে টুঁ শব্দটি বের না হয়। কিন্তু উল্টোদিকের বাড়ির এক মহিলা আগুনের হলকা দেখে হইচই করে লোকজন জড়ো করে আনলেন। যখন দরজা ভাঙা হল, ততক্ষণে সব শেষ। ভিড়ে ভিরাক্কার হয়ে গেল। পুলিশ, দমকল, অ্যাম্বুলেন্স সব হাজির। আবার হতাশ হয়ে তারা ফিরেও গেল।

খুব খানিক হইচই হল পামেলার আকস্মিক আত্মহত্যায়। ময়না-তদন্ত, সঙ্গে আরও কী সব তদন্তে বেরোল, পামেলা নাকি নিত্যদিন যৌন সাহচর্যে অভ্যস্ত ছিল। অথচ তার কোনও পুরুষ-বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গেল না। বরাবরই গার্লস স্কুলে পড়া পামেলা একবারের জন্যেও ধর্ষিত না হলেও, নানাবিধ যৌন-আচরণে সে ছিল নাকি নিতান্ত অভ্যস্ত। এতসব কথা এপাড়া থেকে ওপাড়া ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। খবরের কাগজের পাতা থেকে টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ভাসতে থাকল। আমার মনে হতে লাগল, কে মারা গেল? একটি মেয়ে? নাকি একজন উদীয়মান উজ্জ্বল লেখক?

এখন পামেলাদের বাড়িটা একেবারে ভূতের বাড়ির মত লাগে দূর থেকে। ওর বাবা-মা নরেন্দ্রপুরে ফ্ল্যাট কিনে চলে গিয়েছে। এই বাড়িটা একইরকম পড়ে রয়েছে। একটা জানলা অনেকদিন আগে কাচ ভাঙার পর কাগজ দিয়ে আটকানো হয়েছিল। সেই কাগজটা পর্যন্ত একইরকম রয়েছে। খুলে পড়ে যায়নি, বা নষ্ট হয়নি।