জন্ম পরিচয়ই মুখ্য নয়,মানুষ পরিচয়ই প্রধান
বীণা সাত আট বছর বয়স থেকে জোয়ার্দার বাড়ি কাজ করে। সকাল থেকে গভীর রাত অব্দী কাজের বিনিময়ে আধা পেট ভাত আর দুখানা পুরাতন কাপড় পায়। অধিকাংশ সময় বাসি বা আঁচড়া ভাত তরকারি খেতে হয়। পান থেকে চূন খসলে বকাঝকার অভাব নেই। গায়ে হাত তুলতেও অনেকের বাঁধের না! বাড়ির ছোট বড় সবায় যেন একই শিক্ষায় শিক্ষিত। সবার রক্ত গরম এই একজনের উপরে! প্রত্যকের ব্যক্তিগত কাপড়, সকালের কাপড়, যাবতীয় জিনিস ধুতে হয়, লন্ড্রি করতে হয়, রান্না-বান্না গৃহস্থলীর কাজের কোন শেষ নেই! তবে মাঝে মধ্যে মাছ মাংস থাকলে কাউকে না বলে কয়ে দু এক পিচ খেয়ে নেয়! খাবেই বা না কেন? এত খাটুনির পরও নিজ হাতে কেটেকুটে রান্নাবান্না করার পরও নিজের ভাগ্যে বেশি কিছু জোটে না বললে চলে! কখনো কখনো উটকো লোকজন কিংবা কুকুর বিড়ালে খাবার খেয়ে ফেললে তার দোষও কাজের মেয়ের কাঁধেই চাপে! এর জন্য মাঝে মাঝে দু চারটে চড় থাপ্পরও খেতে হয়!
এগুলো
আমাদের সমাজের নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা! ইদানীং জোয়ার্দার সাহেব রাগারাগী বা বকাবকী করে
না! একটু ভাল কাপড়চোপড় কিনে দেয়! বেশ ভালও বাসে! এতদিনে বীণার বয়স চৌদ্দ পার হয়ে
পনরই পড়ছে! চেহারা খারাপ না! কাজের মেয়ে হলেও মোটামুটি ভালই! আর পাঁচ জনের সাথে মিশে
যায় তবে স্নো পাউডার ক্রিম মাখলে বেশ ভাল লাগে! কাজ না থাকলে সে জোয়ার্দার আর তার
স্ত্রী তানজিলা বেগমের হাত পা টিপে দিত! মাজা থেকে নিচের অংশ পর্যন্ত! বেশ মজা লাগত!
এখনো জোয়ার্দার সাহেবের হাত পা টিপে দেয় তবে যতটা সম্ভব স্ত্রীর আড়ালে কেননা স্ত্রী
এখন আর আগের মত এসব ভাল চোখে দেখে না! মেয়েটও নাকি বেশ ডাগর হয়ে উঠছে, এ সময় তাকে
স্বামী থেকে একটু দূরে রাখা মঙ্গল মনে করে! তাই স্ত্রী বাইরে গেলে জোয়ার্দা্র পুরা
শরীর ম্যাসাজ করিয়ে নেয়! বেশ ভালও লাগে! তাছাড়া বীণা এখন জোয়ার্দার সাহেবের ঘরের
এক কোণায় ঘুমায়, কেননা ছেলেমেয়ে দুটো বড় হওয়া তাদের সাথে ওকে থাকতে তানজিলা বেগম
মন চায় না। ! ফলে তানজিলা বেগম কোন উপায়ান্তর না দেখে নিজের ঘরে নিয়ে আসতে বাধ্য
হয়েছে! আবার নিজেও বেশ কিছুটা অসুস্থ তাই মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিতে পারছে না! জোয়ার্দার
সাহেবের বয়স ৪৫ আর স্ত্রীর ৪০ ছুঁই ছুঁই! এ বয়সের স্বামী-স্ত্রীর রুমে ১৫ বছরের
একটা মেয়ে রাখা ঠিক না তা তানজিলা বেগম জানে কিন্তু কিছুই করার নেই! ওদিকে ছেলে উনিশে
পড়ছে। ছেলের কথা চিন্তা করেই বীণাকে নিজের রুমে রাখেছে! মাঝে মাঝে জোয়ার্দার সাহেব
বীণাকে জিজ্ঞাসা করে গভীর রাতে তোর ঘুম ভাঙ্গে কি না! বীণা প্রায় সবসময় চুপ থাকে
কোন উত্তর দিতে চায় না তবু জোয়ার্দার সাহেব নাছরবান্দা শুনতেই হবে! এসব কথায় বীণা
লজ্জায় যেন লাল হয়ে যায়! একথা শুনতে চাওয়া নিজেদের সতর্ক হওয়ার জন্য নয় একটু
ফ্রি হতে চাওয়া! ঘুসঘাস শব্দ ফিসফিস কথা বলা, তাছাড়া তানজিলা বেগম অসুস্থ থাকাতে
স্বামীর চাহিদা পুরাপুরি মেটাতে পারে না এসব বিষয় নিয়েও স্ত্রীর সাথে জোয়ার্দার
সাহেবের বেশ কথা হয়! তাই গভীর রাতে যে ওর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে দুজনই জানে! জোয়ার্দার
সাহেব এসব কথা বলে কাজের মেয়ের সাথে একটু ফ্রি হতে চায়। বীণা সব
বুঝেও না বুঝার ভান করে যতটা সম্ভব জোয়ার্দার সাহেবের থেকে দূরে থাকে।কাজের মানুষের
উপর প্রভাব খাটানো, সুযোগ নেয়া খুব সহজ! আর বীণা বড় অসহায়! অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়ার
চেষ্টা তো জোয়ার্দার করবেই!
তানজিলা বেগম বাবার বাড়িতে
বেড়াতে যাবে! বেশ কয়েক বছর যাওয়া হয় না! তাই কয়টা দিন বেশি থাকতে হবে! গ্রীষ্মের
ছুটি পেয়েছে ছেলে মেয়েরা! মামা বাড়ির আম কাঁঠালের যে মজা! তাই ছেলে মেয়েরা বায়না
ধরেছে মামাবাড়ি যাবে! যাওয়ার আগে তানজিলা বেগম জোয়ার্দার সাহেবকে বিভিন্ন আদেশ উপদেশ
দিয়ে বলে ‘ ঠিক মত খাওয়া দাওয়া কর, শরীরের যত্ন নিও, আর বীণাকে ক' দিনের জন্য
আজই বাড়িতে পাঠিয়ে দাও! ”
তানজিনা বেগম মনে মনে
ভাবে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে তারপর তাদের যাওয়া উচিত ছিল! সে বীণাকেও বলে “আজকিন্তু চলে যাবি!”
জোয়ার্দার সাহেব হু, হ্যাঁ বলে বউ বাচ্চাদের সবাইকে নিয়ে স্টান্ডে এসে গাড়িতে তুলে
দিয়ে বাসায় ফিরে আসে! এদিকে বীণাও কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়েছে কিন্তু জোয়ার্দার সাহেবের
কাজের ব্যস্ততা আছে তাই আজ যেতে পারবে না, সম্ভব হলে কাল সকালে গিয়ে দিয়ে আসবে! বীণা
এতে বেশ চিন্তায় পরে যায়! খালাম্মা বাসায় নেই, একা থাকতে হবে! খালুজান আসে অনেক রাত
করে! খালুজান পুরুষ মানুষ! আবার নিজেই ভাবে, খালু বলে ডাকি, বয়স্ক মানুষ, অসুবিধা
নেই!
জোয়ার্দার সাহেব কিছু
সময় রেস্ট নিয়ে বের হয়ে গেছে কখন আসবে তার কোন ইয়োত্তা নেই! তার প্রতিদিনের রুটিন
গভীর রাতে বাসায় ফেরা! আজ একটু আগেই চলে এসেছে, সাথে দুটি শাড়ি আর কিছু স্নো পাওডার!
ওগুলো বীণার হাতে দিয়ে সে বলল,“ যা ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়ত দেখি কেমন মানায়! বীণা
যেন আকাশ থেকে পড়ে! দু দুটো শাড়ি! তাও প্রথম, এর আগে কখনো শাড়ি পড়ে নি! সেলোয়ার
কামিজ দিয়েই চলছে! তাও মেয়ের পুরনো কাপুড়! হাত মুখ ধুয়ে পড়তে যাবে এখন দেখে ব্লাউজ
নেই! খালুজানের কাছে এসে বলল,“ খালু খালুজান ব্লাউজ তো নেই!”
জোয়ার্দার সাহেব বলল,“
ঠিক আচ্ছা ওভাবেই পড়ে আয়!”
সবেমাত্র ওর শরীর গড়ে
উঠছে! কাজের মেয়ে হলেও চেহারা বেশ সুন্দর! অগোছাল, অপরিপাটি থাকে বলে খুব সুন্দর দেখায়
না তাছাড়া সারাদিন কাজে থাকে, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত হয় না! তাই চেহারায় তেমন আকর্ষণ
ভেসে উঠে না! আজ বেশ পরিপাটি লাগছে, মাজার নিচে নেমে আসা চুল নিজেই বেনী করেছে!
জোয়ার্দার সাহেব বলল,
“খেয়েছিস?”
বীণা জবাব দেয়, না খাই
নি, আপনর ভাত টেবিলে আছে খেয়ে নিন! আমি পরে খাব!”
“পরে কেন, এখনি খেয়ে
নিতি!
বীণা কোন উত্তর না করে
চুপ করে থাকে!
জোয়ার্দার সাহেব খেতে
বসলে বীণা এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে আর গায়ের কাপড় ঠিক করছে! আগে কখনো শাড়ি পরেনি, তারপর
ব্লাউজ নেই! তাই একটু সতর্ক থাকতে হচ্ছে! তাই তার ইতস্ততবোধ ! জোয়ার্দার সাহেব কিন্তু
বেশ ইনজয় করছে! ব্যাঁকা চোখে মাঝে মাঝে মেয়েটিকে দেখে নিচ্ছে! আর এক সময় সে বীণাকে
বলে উঠে,“ তুই তো বেশ বড় হয়ে গেছিসরে বীণা!
বীণা লজ্জায় লাল হয়ে
যায়!
বীণা জোয়ার্দার সাহেবের
বেড গুছিয়ে দিল! বেডে বীণাকে বলে,“যা একটা পান বানিয়ে নিয়ে আয়! ”একটা পান খেয়ে
জোয়ার্দার সাহেবের মন ভরে না, বড় বড় দুটো পান লাগে! কালো আর তাগরা জোয়ান লোকটা!
গায়ে শক্তিও যেন অসুরের মত! পান খেতে থেতে সে এ গল্প গল্প শুরু
করল! এদিকে রাতও বেশ হয়েছে! বীণা নিজের বেড গুছিয়ে অন্য রুমে যেতে গেলে জোয়ার্দার
সাহেব বাঁধা দিয়ে বলল, “একা একা কোথায় শুবি, ওখানেই শুয়ে পর! বীণার যেন বুক কেপে
উঠল কিন্তু কিছু বলার নেই! কোন শব্দ না করে নিজের বেড ঠিক করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল! কিন্তু
ঘুম হল না!বেশ কিছু সময় পর জোয়ার্দার সাব ডাকল,“ বীণা, ও বীনা, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?”
বীণা আর বুঝতে বাকি রইল
না! ভয়ে বুক কেপে উঠল! বেশ কয়েকটা ডাক দেয়ার পর উত্তর নিল,“ জ্বী খালুজান!”
“বেশ মাথা ধরেছে, একটু
টিপে দিবি!”
বীণা শিয়োরে দাড়িয়ে
মাথা টিপে দিতে শুরু করল! জোয়ার্দার সাহেব বলল, “বসে শরীরটাও মেসেজ করে দে, অনেক দিন
দিস না!”
বীণা সরিষার তেল নিয়ে
এসে জোয়দারের শরীরে ঘোষতে শুরু করল! বীণার মুখটা যেন কাল আঁধারে ঢেকে গেছে! মেসেজ কিভাবে
করতে হয় তা আগে থেকেই জানে! কিন্তু আগের মেসেজ আর আজকের মেসেজ যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য!
সারা শরীর, পা, উরু সব জায়গা ঘোষতে হয়! এদিকে কথার ফুলঝুরি ছুটছে জোয়ার্দার সাহেবের
মুখে! কামনাও জেগে উঠছে! আর পানের গন্ধে যেন নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! লজ্জায় মুখ
ঢেকে নিল শাড়ির আঁচল দিয়ে! জোয়ার্দার সাহেব আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল পিঠে! আতংকে
কেঁপে উঠলেও বীণা কিছুই বলতে পারল না! ভয়ে ভিতরটা কুকরে যাচ্ছে! এক সময় জোয়দার বীণাকে
তার বুকের কাছে টেনে নিল! বীণা বলে উঠল, “খালুজান! ” মুখের কাছে টেনে নিয়ে বীণার মুখে
একটা চুমু দিল। পানের পিক বীণার ঠোঁটে, মুখে লেগে গেল! গন্ধে যেন বমি
আসছে! বারবার নিজেকে ছাড়িতে নেয়ার চেষ্টা করল বীণা! কিন্তু নব্বই কেজি ওজনের শরীরের
নীচে বীণা যেন বড় অসহায়! নিজের হাত পা নাড়ানো ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই! অসুরের
মত যেন বিধ্বস্ত করে দিল ক্ষণিকের মধ্যেই! নিজের অসহায়ত্বের আর্তচিৎকার মিশে গেল বাতাসে!
নিস্তব্ধ হয়ে গেল সব! যত হাসি, যত কান্না, যত স্বপ্ন এক নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেল!
যাকে খালু বলে সম্বোধন করে, বাবার মত শ্রদ্ধা করে তার কাছে এভাবে নিজের অস্তিত্ব বিলীন
হবে তা ছিল বীণার কাছে কল্পনাতীত! এ যেন কল্পনাকেও হার মানায়! মনুষত্ব্যের মাঝে পশুর
হিংস্র থাবায় সব শেষ হয়ে যাবে তা কে জানতো।
বীণা ঘুম থেকে উঠে দেখে
বেশ বেলা হয়ে গেছে! তার পাশেই খালুজান নাক ডেকে, নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে! সারা শরীর ব্যাথা,
কোমরে যেন আরো বেশি ব্যাথা! পা দুটো যেন নড়েতেই পারছে না! একবার উঠে যেতে গিয়েও পারল
না! অস্বস্তি সত্ত্বেও বীণা শুয়ে থাকল আরো কিছুক্ষণ!
এদিকে জোয়ার্দার সাহেব
উঠে গোসল সেরে কিছু শুকনা নাস্তা করে বের হয়ে গেল! কয়েকবার বীণা বীণা বলে ডেকেছে
অবশ্য! কিন্তু বীণা কোন জবাব দেয়নি! বীণা আরো কিছু সময় পর উঠে বাথরুম সেরে বেশ লম্বা
সময় নিয়ে গোসল করল! নাস্তা আর করা হল না! এখন কি করবে ভাবতে লাগল! বাড়িতে চলে যাবে
কি না? কাকে বলবে, আপন বলে তো কেউ নেই! এক মা আছে তাও অসুস্থ! কাউকে বললে নিজেকেই সবাই
খারাপ বলবে, ছি: ছি: করবে! মাকে বললে আরো কষ্ট পাবে! মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখা ছাড়া
কোন গতান্তর নেই! এই মুহূর্তে একা গেলে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে! অনেক ভেবে চিন্তে
বাসা থেকে আর বের হওয়া তার হল না!
জোয়ার্দার সাহেব আবারও
বেশ কিছু জিনিস কিনে নিয়ে এসেছেন বীণাকে খুশি করতে! জিনিসগুলো বীণার হাতে দিলেও তাকিয়েও না দেখে
রেখে দিল! অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করলেও একটা কথাও বীণার মুখ দিয়ে বের
হল না, গম্ভীর মুখে বসে থাকল বীণা! অনেক বুঝিয়ে রাতে কিছু খাওয়ালেন আর সে রাতেও বীণাকে
তার নিজের বেডে শুতে বাধ্য করল। দ্বিতীয় রাতে বীণা ভয়ে আবারো কুকড়ে গেল! এখনো পুরা শরীর ব্যাথা, হাঁটতে
পারছে না, তার উপর নতুন করে.......! ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগল! অসহাত্বের করুণ
পরিণতিতে আবার সে পতিত হল! এভাবেই চলতে থাকল রাতের পর রাত! সব থেকে অবাক করা বিষয়
যে, এত কিছুর পরও জোয়ার্দার সাহেবের আচার ব্যবহারে প্রকাশ পেল যেন কিছুই ঘটেনি! সব
কিছু স্বাভাবিক! চোখে মুখে অপরাধের কোন ছায়া নেই!
১০/১২দিন কেটে গেলো!
তানজিলা বেগমের ফিরে আসার সময় হয়েছে! বীণার শরীরেও বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে!
নববিবাহিত মেয়েদের যেমন শরীরে পরিবর্তন দেখা দেয়! তাই তানজিলা বেগম আসার আগেই বীণাকে
বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে বীণাকে তার বাড়িতে রেখে এল সে!
একে একে বেশ কয়েক মাস
কেটে গেল! তানজিলা বেগম বারবার বীণাকে নিয়ে আসার কথা বললেও জোয়ার্দার সাহেব সে কথা
কানে তুলল না! একথা সেকথা বলে কাটিয়ে দিলেন! অনেক পিড়াপিড়তে অবশেষে যেতেই হল! কিন্তু
গিয়ে দেখে ওদিকে আরেক কান্ড ঘটে গেছে! বীণা প্রায়ই বমি করে, খেতে পারে না, বেশ অসুস্থ!
জোয়ার্দার সাহেবের আর বুঝতে বাকি রইল না কি ঘটেছে! দ্রুত বীণাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াল!
হসপিটাল থেকে ক্লিনিক, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা! এ টেস্ট সে টেস্ট! কোন কাজ হল না!
বড্ড দেরি হয়ে গেছে, পেটে বাচ্চা বেশ বড় হয়ে গেছে! এই মুহূর্তে অন্য কোন সিদ্ধান্তে
গেলে মা মারা যেতে পারে, তাই এবোর্শনের রিস্ক নিতে কোন ডাক্তার রাজি নয়! অনেক টাকা
পয়সার লোভও কোন কাজ হল না! অবশেষে ঢাকায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বীণাকে
বাড়িতে পৌছে দিয়ে নিজে বাড়িতে জোয়র্দার ফিরে এল।
স্বামীর আকস্মিক পরিবর্তনের
কারণ সম্বন্ধে তানজিলা বেগম বার বার জিজ্ঞাসা করলেও কোন জবাব পেল না স্বামীর কাছ থেকে।
স্বামী বেচারার রাতে একটুও ঘুম হল না! তানজিলা বেগম বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল স্বামীর
এ অবস্থা দেখে! কিন্তু কোন কথাই স্বামীর মুখ থেকে সে বের করতে পারল না।
এদিকে বীণা আর তার মা
সারাদিন কেঁদে কেঁটে একাকার করে ফল! মা কখনো মেয়েকে বকে, কখনো নাম বলতে বলে যে তার
সর্ব্নাশ করেছে। কিন্তু মেয়েটা বড়ই মাড়ি আঁটা, সে কোন কথায় বলল না! পাড়া প্রতিবেশীরা
ছি: ছি: করে যাচ্ছে! ক্ষোভে দুঃখে বীণা যেন সুইসাইড করতে মন চাচ্ছে, আবার ভাবে আমি
কেন সুইসাইড করব? আমার কি দোষ? কিন্তু বাচ্চার সমাজে কি পরিচয়? কে বাবা? না আর ভাবতে
পারছে না কান্না চলে আসছে।
তারপর ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোন কাজ
হয় নি! এখন বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই! অসুস্থ মা রাতদিন চিল্লাতে
থাকে আর বকতে থাকে!
গতান্তর না দেখে জোয়ার্দার
সাহেব, নিয়মিত সাংসারিক খরচ দিতে থাকে! নইলে নাম বললে অনেক প্রব্লেম! সামাজিক ও সাংসারিক
জীবনে ভয়াভয় দুর্যোগ নেমে আসবে!
এভাবে কেটে গেল আরো কয়েক
মাস! এক সময় জন্ম নিল একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান! জোয়ার্দার সাহেব মেয়েটাকে মেরে
ফেলতে চাইলেও বীণা রাজী নয়! কোনভাবেই বীণাকে আর রাজী করান গেল না! এতদিন জোয়ার্দার
কথা না বললেও এখন দুই একটা বলা লাগে! সন্তানের বাবার পরিচয় দিতে জোয়ার্দার সাহেব
কোনভাবেই রাজী নয়! সংসারের যাবতীয় খরচ দিবে পরিচয় দিবে না! এ নিয়ে সামাজিক বিচার
বসেছে, সেখানে কোন নাম না বলায়, জোয়ার্দার সাহেবের কোন বিচার করা যায় ! যদিও বীণা
জানে বলেও কোন লাভ নেই! সব কিছুই এদের হাতের মুটোয় যদি খরচের টাকা না দেয়! এই ভেবে
নাম বলল না কিন্তু সে খরচটাও বেশিদিন দিল না! বছর যেতে না যেতেই খরচও বন্ধ!
বাবার নাম না থাকায়
সরকারি নতিতে নাম অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব হয় নি! ছোট্ট খুকি দিনে বড় হতে থাকল! বীণা
নাম দিয়েছে বন্যা! বন্যা এখন স্কুলে যায়! স্কুলেও বাবার নাম দেয়া হয়নি, মায়ের নামেই
পরিচিত! প্রায় স্কুলের অন্য বাচ্চার বাস্টার্ড বা জারজ বলে গালি দেয়, ওর সাথে কেউ
মিশতে চায় না! বন্যা সেদিন মায়ের কাছে জিজ্ঞিস করে,“ মা মা বাস্টার্ড মানে কি? সবায়
আমাকে বাস্টার্ড বলে কেন? জান মা আমার সাথে কেউ মিশতে চাই না! খেলাও করে না! কেন মা?
আমি কি দোষ করেছি? এ কথায় যেন বীণার বুক ফেটে যায়।! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে
পড়ে! বাচ্চাটি চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, আর কেঁদ না মা, আমি আর কখনো এ কথা বলব না!
চুপ কর না মা, তুমি কাঁদলে আমারো কান্না আসে!
বীণা বলল,“ না মা তুই
কোন দোষ করিস নি! ওদের কথায় কান দিস না! লেখাপড়া ঠিক মত কর ভাল রেজাল্ট করলে ওরা
আর কিছু বলবে! ”আর মনে মনে ভাবে সত্যি তো, বাচ্চার কি দোষ? দোষ যদি কিছু থেকে থাকে
তাহলে ওর বাবা মায়ের! ও কেন দোষী হবে? সারা জীবন কেন এর দায়ভার বয়ে বেড়াবে? কেন
বা সব জায়গা বাবার নাম লাগবে? আমি কি ওর কেউ না? কে দেবে এই প্রশ্নের জবাব?
এ যুগেও সরকারের খাতায়
বিহীন একটি মেয়ে বেড়ে উঠছে! সামাজিক অনাচার অত্যাচার সহ্য করে! এই কচি মুখটা যেন
সমাজের অনাচারের মূল কারণ! যাত্রাকালে দেখলে হয় অযাত্রা! সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেই
দিনটা হয় অশুভ! যেমন সমাজের অনাচার কুসংস্কারের শিকার, এক ঘরে হয়ে থাকতে হয়! তেমনি
সরকারি স্কুলের সুযোগ সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত! এভাবে লড়াই করেই বেড়ে উঠছিল মেয়েটি!
শত বাঁধা উপেক্ষা করে, বঞ্চনা-গঞ্জনা তুচ্ছ করে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল! তখন আবারও শক্ত
দেয়াল হয়ে দাড়াল ঐ সরকারি রুল! এস এস সি পরীক্ষার জন্য নাম রেজিস্ট্রি করবে! কিন্তু
ফর্ম পূরণ করতে বাবার নাম লাগবে! বন্যা কোন অবস্থায় বাবার নাম লিখতে রাজি নয়! টিচাররাও
বাবার ঘর শুন্য রেখে জমা নিতে পারছে না! বিষয়টি বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় এলেও কোন
সুরাহা হল না! আর সুরাহা হয়নি বলেই এখনো ডাস্টবিনে, পয়:নিষ্কাশনের লাইনে শুনতে পাই
শিশুর কান্না! সে কান্নার করুণ সুর আজও বেঁজে উঠেনি সমাজ কিম্বা সরকারের কর্ণ কুহরে!!
আজও বোঝেনি ওরা প্রতিটি সন্তান জন্ম নেয় একজন মানুষ হিসেবে, মনুষ্য সন্তান হিসেবে!
জন্ম পরিচয় মুখ্য নয়, মানুষই মুখ্য!
মনোজিৎকুমার দাস,মাগুরা।