গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


নীলমণি ও সত্যপ্রকাশ
     
সত্যপ্রকাশকে নিয়ে কিছু লেখার আগ্রহ বা ইচ্ছে কিছুই ছিল না বরং নীলমণিকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবছিলাম । নীলমনি মহাতো পুরুলিয়ার এক গন্ডগ্রামের আদিবাসী লোকশিল্পী । আমি তখন রাড় বাংলার লোকগান নিয়ে একটা কাজ করছিলাম,সে কাজেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে যেতাম প্রায়ই । তখনই নীলমণির সঙ্গে আলাপ হয় । পুরুলিয়ার রুখা শুখা মাটি থেকে সুর তুলে আনত নীলমনী । ওকে একদিন বলেছিলাম কলকাতায় একদিন প্রাণভরে তোমার গান শুনবো নীলমনি । নীলমনি বলেছিলো, কলকাতার জলসায় আমি গান গাইবো না, টাকা দিলেও না । বলেছিল,শহরে ইট কাঠের জঙ্গলে মানুষের প্রাণের মধ্যি কোনো সুর লাই গো দাদা । বলেছিল, ইদিকটা একটুন শান্ত হোলি,এস, আমার কুঁড়ে ঘরে বসে তোমায় প্রাণ ভরে গান শুনাবো ।
না,নীলমণি আর কোনদিন গান শোনাবে না । আজকের কাগজে ছোট করে একটা সংবাদ বেরিয়েছে , পুরুলিয়ার লোকসঙ্গীত  শিল্পী নীলমনি মাহাতো খুন হয়েছে, রাস্তার ধারে তার কন্ঠনালী কাটা লাশটা পাওয়া গেছে । কারা নীলমণিকে খুন করেছে তার ইঙ্গিতও সংবাদপত্রটি দিয়েছে । এখন অবশ্য রাস্তার ধারে খুন হয়ে পড়ে থাকা লাশ কোন দুর্লভ দৃশ্য নয় । বিচলিত আমি ভেবে পাইনা বেঁচে থাকার জন্য মানুষ আর কত মূল্য দেবে ! কিন্তু নীলমণির এলাকা তো গান সেই এলাকায় ঢুকতে তো মোটর সাইকেল চেপে আসতে হয় না ! আসতে হয় না মুখ ঢেকে হাতে দেশি রিভলভার নিয়ে !
      
ঠিক এই সময় আমার সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়বার ইচ্ছে হলো । ও কি আমার মতই বিচলিত হয়েছে ? নাকি বিচলিত হওয়ার মত মন এখনো ওর আছে । !সত্যপ্রকাশ কলকাতার একডাকে চেনা নাট্য ব্যক্তিত্ব ,মিডিয়া ইদানিং একটা অলঙ্কার লাগিয়েছে সেলিব্রিটিতা সে আমার বন্ধুও বটে,অন্তত দু বছর আগে পর্যন্ত ছিল । শুনতে পাই এখন সত্যপ্রকাশ আমাকে দালালছাড়া আর কিছু ভাবেনা,তা ভাবুক,কিন্তু সত্যপ্রকাশের নাট্যবোধ ও অভিনয় দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এখনো অটুট । ইদানিং অবশ্য সত্যপ্রকাশ থিয়েটারে আর সময় দিচ্ছে না, এখন টেলিভিষণে ওর খুব চাহিদা,নানান কারেন্ট এফেয়ার্স ওনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠনের মোমবাতি মিছিলেও দেখা যায় সামনের দিকে ।


বছর তিনেক আগে আমিই নীলমণিকে সত্যপ্রকাশের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম । পুরুলিয়ার লোক শিল্পীদের জীবন নিয়ে রুক্ষ মাটির গাননামে একটা নাটক করার কথা সত্যপ্রকাশ আমাকে বলেছিল । নাটকটাতে সুর ও গান করার জন্য আমি নীলমণিকে রাজি করিয়েছিলাম । রুক্ষ মাটির গানদারুন হিট করেছিল । ও আমাকে বলেছিল যে এই নাটকটাই ওর সবচেয়ে সফল প্রযোজনা এবং নীলমণির গানের জন্যই যে সেটা সম্ভব হয়েছিল,সত্যপ্রকাশ তাও জানিয়েছিল । সেই নীলমনির খুন হয়ে যাওয়ার খবরটা সত্যপ্রকাশ নিশ্চয়ই পেয়েছে । আমি মনে মনে সত্যপ্রকাশের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করতেই আর একটা দৃশ্য ভেসে এলো নীলমনির জন্য নাটক ও সঙ্গীত জগতের লোকেরা মোমবাতি মিছিল করছে,আমি মিছিলে সত্যপ্রকাশের মুখটা খুঁজছি তন্নতন্ন করে ।
         
আচমকা টেলিফোনের তীব্র শব্দে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। ফোন তুললাম । অবাক বিস্ময়ে শুনলাম ওপারের কন্ঠ – ‘মণীষ, আমি সত্যপ্রকাশ বলছিআমার গলা দিয়ে আপাতত কোন শব্দ বেরোলো না । প্রায় দু বছর বাদে সত্যপ্রকাশ আমাকে ফোন করছে , ভেবে পেলাম না কি এমন ঘটনা ঘটল যে দালাল হয়ে যাওয়া আমাকে ওর দরকার পড়লো ? ওপারে কন্ঠে একটা আকুতি একবার আসতে পারবি’ ?
         
আমি ? কি ব্যাপার ? আমি জানতে চাইলাম । ও বললো, তোকে ছাড়া কাউকে বলা যাবে না । আমি বললাম,কিন্তু ব্যাপারটা কি তাতো জানতে হবে । সত্যপ্রকাশের কন্ঠস্বর একটু বিচলিত মনে হল, বললো,‘হ্যা মানে সেই নীলমণি মাহাতো ...জানি,গতকাল রাত্রে নীলমনি ......খুন হয়েছে কথাটা বলার আগেই সত্যপ্রকাশ বললো গতকাল গভীর রাতে নীলমণির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল,ও আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল,আমি উত্তর দিতে পারিনি ।
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না,কি বলছে সত্যপ্রকাশ ?খুন হওয়ার তারিখে গভীর রাতে নীলমণি সত্যপ্রকাশের সঙ্গে দেখা করেছিল এ কি করে সম্ভব ? খবরের কাগজ তো জানিয়েছে নীলমণি রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে খুন হয়েছে , তা ছাড়া এদিন ই তো সত্যপ্রকাশের একটা সম্বর্ধনা অনুষ্টান ছিল,কোন এক মানবাধিকার সংগঠন ওকে সম্বর্ধনা দিচ্ছিল । দিনটা রবিবার ছিল,আমি সত্যপ্রকাশের ফ্ল্যাটে গেলাম ।
         
সত্যপ্রকাশ আমাকে যা বললো তা এই রকম । নীলমণির খুন হওয়ার দিন ওর ঘরে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়েছিল । সম্বর্ধনার পর খাওয়া-দাওয়া ছিল,পেটে একটু্ তরল পানীয়ও ঢুকেছিল  । গলির মোড়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে টলমল পায়ে হাঁটছিল সত্যপ্রকাশ,হঠাত অন্ধকার ফুঁড়ে একটা কালো মত লোক ওর কাছে এগিয়ে এসে বললো - আমি নীলমণি মাহাতো বটে গো দাদা । চিনতে পারছো ? চিনতে পেরে সত্যপ্রকাশ বলেছিল,এত রাতে তুমি এখানে কি করে এলে নীলমণি ? তবে যে কাগজে দেখলাম ......, ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলমনি বলেছিল- ও কথা থাক দাদা,আমি একটা প্রশ্ন শুধোতে এইছিলুম গো । তুমিতো আমাদের ওখেনে মিটিন করতে গ্যাছিলে সেদিন,তা নীলমণি কেমন আছে একটুন খোজ করলেনা কেন গো দাদা ? একজন সুরের কারবারীকে খুন হতে হয় কেন গো দাদা ? সত্যপ্রকাশ চিৎকার করে উঠেছিল তাহলে খবরটা সত্যি ? তুমি ......! নীলমণি বলেছিল একটুন আগে তুমি যখন মিটিনে পুরুলিয়ার মানুষদের নিয়ে বলছ্যালে ঠিক তখনই তোমার নাটকের নীলমণি মাহাতোর কন্ঠনালী কাটা লাশটা ওরা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল । কেন গো দাদা,কোন বিপ্লবের দাম চুকোচ্ছি গো আমরা ?’সত্যপ্রকাশের আর কিছু মনে ছিলনা । কখন কি ভাবে ঘরে ঢুকেছিল,তাও নয় ।
         
বিবরণটা শুনে আমি আর একবার ওর ভেতরটা পড়বার চেষ্টা করলাম, কেননা মদের ঘোরে অন্তত নীলমণির কথা্টা ভেবেছিল সত্যপ্রকাশ,নীলমণির খুন হওয়াটা ওর ভেতরটাকে হয়তো কিঞ্চিৎ আলোড়িত করেছে । চলে আসার আগে বললাম, তুমি আবার রুক্ষ মাটির গাননাটকটা করো,নীলমণি না থাকুক,তার সুর আর গানগুলোতো আছে ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো টেলিফোনের শব্দে । ঘুম মাখা চোখে ফোন তুললাম । ওপারের কন্ঠ বল - যাদবপুর থানা থেকে সার্কেল ইন্সপেক্টর সুজয় বোস বলছি স্যার । শান্ত গলায় বললুম বলুনসুজয় বলল – ‘প্রবীণ নাট্যকার পরিচালক সত্যপ্রকাশ কাল রাত্রে আত্মহত্যা করেছেন, আপনি একবার আসতে পারবেন স্যার ? আপনাকে লেখা একটা চিরকূট রেখে গেছেনআমি আধঘন্টার মধ্যে পোঁছে গেলাম । সত্যপ্রকাশের মুখে গ্যাঁজলা ওঠা নিথর দেহটা পড়ে আছে, পাশে শূণ্য ঘুমের ওষুধের শিশিটা রয়েছে । সুজয় একটা চিরকূট বাড়িয়ে দিল । রাত্রি দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে লেখা একফালি কাগজে সত্যপ্রকাশ লিখেছে মণীষ,তোর কথাটাই ঠিক,বাঘের পিঠে ওঠাটা সহজ,নামাটা কঠিন,তাই ......
                                
১৪ই অক্টোবর ২০১১তে গল্পগুচ্ছ'র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল । ]