গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮

বিজয়া দেব


   হাতটা ধরুন প্লিজ

    গৌহাটির বাসটা ছাড়ল শেষ পর্যন্ত । খানাপাড়া আই এস বি টি তে দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকে । রাইয়ের ভয় করছিল । সাথে মা রয়েছে । আর কেউ নেই । কে-ই বা থাকবে ! গৌহাটির পাঞ্জাবাড়িতে থাকে সে , মানে রাই ও তার মা । ভাড়াবাড়ি । পাশের বাড়িতে কাকা রয়েছে । কাকা ত তার নিজের ছেলেমেয়ে বউ নিয়েই ব্যস্ত । রাই অন্যত্র থাকতে পারত , কাকার পাশের বাড়িতে ভাড়া নিয়েছে এই ভরসায় যে হাজার হোক কাকা ত , আপদবিপদ হলে ফেলতে পারবে না , কিন্তু কার্যত তা হয়নি ।
      নিজেকে দুর্ভাগা  বলেই জানে রাই । বিয়ের  দুবছরের মাথায় স্বামী  তাকে ছাড়ল । মা-র কাছেএকটা মোটরবাইক দাবি করেছিল  । দিতে পারেনি মা ।  কোথা থেকে দেবে ? বাবা  মারা গেল হঠাৎ । একটা  সিমেন্ট কোম্পানিতে সামান্য  কর্মচারী ছিল বাবা ।  ওখানেই কাজ করতে করতে  হার্ট অ্যাটাক হয় ।  বাবার সামান্য পেনসন  আর গ্রাচুইটির সামান্য  টাকা । তা থেকেই অনেক  কষ্টে বিয়েটা দিয়েছিল  মা । কাকার পছন্দের  পাত্র । ও বাড়িতে বেশিদিন  থাকেনি সে । থাকতে পারেনি  । শাশুড়ি ছিল ভারি দজ্জাল  । দিনরাত মানসিক নির্যাতন  । ওসব নিয়ে আজকাল ভাবে  না রাই । জীবনটা খুব  সাময়িক । মানে আজ এই  মুহূর্তে ভাল থাকাটা  খুব জরুরি । কাল কি হবে অথবা একটু পরেই কি হতে চলেছে সেটা নিয়ে ভাবতে নেই । এই-ই নাকি এই সময়ের অমোঘ বার্তা । সবাই বলে । সে-ও তাই বিশ্বাস করে । সিমেন্ট কম্পানিতে অনেক বলে কয়ে কোনক্রমে একটা চাকুরি মিলেছে তার ।
     গাড়িটা চলছে  । শিলঙের রাস্তা ধরেছে  এখন । শেষ অব্দি তারা  যেতে পারবে কিনা জানে  না রাই । মা-র শরীরটা  একদম ভাল নয় । নার্ভের  সমস্যায় ভুগছে মা ।  হাত-পা কাঁপে । মাথাটাও  সোজা করে রাখতে পারে  না । হাল্কা কাঁপন লেগেই  আছে ।
    মেঘালয় সীমান্তেও গোলমাল । বাস থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে চাইছে । ঠিকঠাক না পেলে উল্টো গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে । এরা কোন সাহসে এত কিছু করছে সেটাই ত ভাববার বিসয় । কোন অধিকারে এত হেনস্থা করার সাহস পাচ্ছে ? রাই তাই ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড ব্যাগে রেখেছে নিজেদের । তবু ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছে যদি নাগরিক পঞ্জির ২ নং খসড়ায় ওঠা নামের প্রমানপত্রটি দেখতে চায় ? রাইয়ের নাম খুঁজে পাওয়া যায় নি নাগরিক পঞ্জির দ্বিতীয় খসড়ায় । নাম উঠেনি । তার বাবা জগবন্ধুর লিগ্যাসি ডেটা পাওয়া যায়নি । কেন পাওয়া যায়নি সেসব প্রশ্নচিহ্ন । ১৯৬২ সালের ভোটার তালিকায় বাবার নাম আছে । তবু লিগ্যাসি না থাকায় ঐ কাগজটা যথার্থ নথি হিসেবে গ্রাহ্য হয়নি । এন,আর,সি সেবাকেন্দ্রে এর কারণ জিজ্ঞেস করেও যুক্তিসহ উত্তর মেলে নি । হয়রানি আর হয়রানি ।
    গাড়িটা শিলং যাওয়ার  পথে । আঁকাবাঁকা পাহাড়ি  পথ । অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে  যাচ্ছে হেডলাইট । গোটা  দুনিয়াটাই আজ যেন রহস্যময়  । এই প্রেক্ষিতকে সে  চেনে না ।এই অচেনা গোলোকে  সে খুব একা । গাড়িটা  ছুটছে খুব দ্রুত । জানালার  বাইরে ঘন অন্ধকার ।  গূঢ় রহস্যে মোড়া কিছু  বৃক্ষ অন্ধকার অথবা আলোছায়ার  ভেতর অনিবার্য দ্রুততায়  সরে সরে যাচ্ছে । গাড়ির  গতি যেন বেড়েই চলেছে  । এত দ্রুতগতিতে ছুটছে  যে রাইয়ের মা সুনীতি  ভয় পেয়ে মেয়ের হাতটা  শক্ত করে চেপে ধরে ।  রাই কন্ডাকটরকে বলে
 -ও ভাই, এত  জোরে চালাতে বারণ কর  ড্রাইভারকে । পাহাড়ি পথ , কখন  কী  হয়ে যাবে !
- চোখ বন্ধ করে নিন , চোখ বন্ধ করে নিন , তাহলে ভয়টা কম হবে ।
- এ আবার কী কথা ?
- নাহলে গাড়ি থামিয়ে হুজ্জোতি করবে খাসিয়া ছাত্রগুলো । কাগজ চাইবে । কোনরকমে পেরিয়ে গেলে ভাল । আপনাদের জন্যেই ত !
রাই এবার চুপ । যা হয় হোক । নাহয় খাদেই পড়ে গেল । নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে গেল দুজনায় । মা ও মেয়ে মুক্তি পেয়ে গেল ! না না , এসব কি ভাবছে সে ? একটুও না , বাঁচবে তারা । এই দুনিয়ায় সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে । চোখ বন্ধ করে নেয় রাই । ছুটুক , এমনি দুরন্ত বেগে ছুটে চলুক গাড়ি । সব অন্ধকার চিরে চিরে দেখে নিক হেডলাইটের তীব্র আলো । অচেনা অন্ধ কোণগুলো যাবতীয় রহস্য বুকে আগলে রাখুক । তবু এর শেষ দেখে যাবে সে ।মাঝপথে কেন সে হারিয়ে যাবে ?
   পরদিন  শিলচর শহরে পৌঁছোল তারা  বেলা এগারটায় ।সুবোধকাকুর  বাড়ি সুভাষনগর । বাবার  খুড়তুতো ভাই । তেমন  যোগাযোগ ছিল না । কাকা-  যোগযোগ করে অন্তত দুটো  দিন থাকার বন্দোবস্ত  করে দিয়েছে । এ শহরে  রাই এসেছিল খুব ছোটবেলায়  । এখন সেসব ধূসর স্মৃতি , শুধু মনে পড়ে এক শান্ত  নিরুপদ্রপ শহরকে । নাম  ছিল শান্তির দ্বীপ ।  আজ যে শহরকে দেখা যাচ্ছে সেখানে তীব্র যানজট , ধুলো আর শ্রাবণ মাসের ভারী দমচাপা গরম ।
   কাকার  বাড়ি যখন পৌঁছানো গেল  তখন দুপুর সাড়ে বারো  পেরিয়ে গেছে ।
   

              
বুঝেছিস  রাই , ১৯৫০ সালের কথা ।  আমি তখনও জন্মাইনি , কিন্তু  দাদার কাছে , আমার বাবার  কাছে শুনেছি । তাছাড়া  এই ডাইরিটা দেখ ।পুরনো  কাঠের আলমারি থেকে একটি  ধূসর ডাইরি বের করে  আনে কাকা ।  ডাইরির পাতা  ওলটায় । একটি পৃষ্ঠায়  এসে কাকার আঙ্গুল স্থির  হয়ে যায় । বলে , এখানে , এখানে রয়েছে সেইসব দুঃসহ দিনগুলোর বিবরণ । বুঝেছিস মা রাই । দেশভাগ ।ছিন্নমূল মানুষের জীবনকথা । কার লেখা বলতো ? তোর বাবার ।
বাবা ? বাবা লিখে গেছে ? তুমি আমাকে বল নি ত কোনদিন ?
কি করে বলব ? তোরা ত আমাদের ভুলেই গেছিস । আজ ঘটনাচক্রে এখানে এলি !
     কথাটা ঠিক ।  আসলে নিজের কাকা যেমন  দায়সারা সম্পর্কে আছে  তাদের সাথে , খুড়তুতো কাকাকে  তাই আর জড়াতে চায়নি  সে । দুজন পুরুষবিহীন নারী । কখন কোন বিপদে পড়ে যায় , সেই ভয় তার নিজের কাকার ত আছে !
পড়ে দেখ রাই , কী ভয়ানক সব বিবরণ ! পড়ল রাই । সত্যি ভয়ানক । হঠাৎ করে যদি ফরমান জারি হয় পুরুষানুক্রমে বাস করা এই জমি মাটি বাড়ি তোমার নয় , যদি রাতের অন্ধকারে এক বস্ত্রে লুকিয়ে ভিটেবাড়ি ছাড়তে হয় , যদি পথে নিজের মেয়ে , স্ত্রীকে টেনে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তের দল তাহলে কি হতে পারে পরিণতি ? গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে । কিন্তু কখনও যা ভাবেনি এখনও কি তাই হবে ?
কী হবে আমাদের কাকা ? আমার , মায়ের ?
এটা ভেবে লাভ নেই মা , যখন যা হয় । আমার পায়েল এর জন্যে ভাবনায় ভাবনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি । তোর কাকিমা ছুটছে । আমি দোকান ফেলে যেতে পারছি না । পায়েলেরও খসড়া তালিকায় নাম ওঠেনি ।

               
রাইদের শিলচরে আসার একটাই কারণ । অবোধচন্দ্র মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে যাওয়া । বাবা ঐ ইস্কুলে পড়েছিল । ক্লাস সিক্স অব্দি । ওখান থেকে একটা ইস্কুল সার্টিফিকেট জোগাড় করা চাই । ইস্কুলটি শহরের উপান্তে , রামনগরে । পরদিন রামনগরে এল রাই , মাকে নিয়ে । আর কেউ সাথে আসতে পারেনি । কাকা আজ দোকান গেছে । গতকাল ওরা আসায় কাকা দোকান যায়নি । কাকিমা কোথায় যেন যাবে ।
 বেশ  ঝাঁঝিয়ে রোদ উঠেছে ।  অনেকক্ষণ খুঁজেও অবোধচন্দ্র  মধ্যবঙ্গ ইস্কুল পাওয়া  গেল না । কেউ কোনও  সন্ধানও দিতে পারল না  । এক গ্যারাজের কাছে একটি বটগাছ । সেই গাছের ছায়ায় একটি হাতল ভাঙ্গা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধ । কেউ একজন বলল - এঁকে জিজ্ঞেস করে দেখুন , ইনি জানতেও পারেন ।
   রাই  বৃদ্ধের কাছে আসে ।  বলে শুনছেন ?
বৃদ্ধ তাকাল । চোখদুটিতে কী যেন রয়েছে । এক অচেনা ভয় এলো । এই ভর দুপুরে চারপাশে কোনও মানুষ দেখতে পেল না সে । গ্যারাজটিও ফাঁকা । আশ্চর্য ! কিছু আগে গ্যারাজে লোকজন দেখা গেছে । লোকটা কোনও উত্তর করছে না । তাকিয়ে আছে একইভাবে । রাই আমতা আমতা করে কিছু মনে করবেন না । আপনাকে বিরক্ত করছি । মানে আমি জানতে চাইছি ...
বলতে পারল না রাই বাকি থাকা কথাটি । লোকটি ভয়ঙ্কর হাসল । এমন বীভৎস হাসি সে কখনও দেখেনি ।
আমি-ই অবোধচন্দ্র , ইস্কুলটি আমি-ই করেছিলাম ...
এবার রাই শুনতে পায় মা বলছে ,
- রাই , এই খোলা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে লাভ কি ! আমি আর পারছি না রে । একটু জল খাবো । কোথাও একটু বসাতে পারবি আমায় ?
-খোলা জায়গা ? মানে ?
    বলে রাই দেখে  কেউ নেই । কোথায় সেই  বৃদ্ধ অবোধচন্দ্র ? সেই  গ্যারাজ ? সেই বটগাছ ? ভুল ? এতটাই ভুল ? সে কি পাগল  হয়ে যাচ্ছে ? কষ্টে কষ্টে  এমনটা নাকি হয় ! হ্যালুসিনেশন ? অবচেতন পৃথিবী দৃশ্যমান  হয়ে যাওয়া ! না , না , মাকে  এসব বুঝতে দেওয়া চলবে  না । ভয় পাবে মা ।  মা যে তার ওপরেই ভরসা  করে বেঁচে আছে । রাই  এদিক ওদিক দেখে । একটি  মুদি দোকান দেখা যাচ্ছে  অদূরেই ।
মাকে নিয়ে ঢুকে সে । দোকানিকে বলে ,
- এখানে একটু বসা যাবে ? মা-র শরীরটা একটু খারাপ  লাগছে ।
লোকটি জিনিষপত্র ওজন করছে । খদ্দের দাঁড়িয়ে । এক পলক দেখল শুধু । তারপর হাঁক দিল
এই বলাই , একটা চেয়ার  এনে দে ত ভেতর থেকে 
রাই দেখে একপাশে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বসে আছেন । চেয়ারটা এনে দেয়ার পর মা-কে বসিয়ে রাই তার ঢাউস কাঁধব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে মা-কে দেয় ।
কোথা থেকে আসছেন ? – প্রৌঢ়ের প্রশ্ন ।
গৌহাটি ।
ও । এখানে কি কিছু খুঁজছেন ?
অবোধচন্দ্র মধ্যবঙ্গ ইস্কুল বলে একটা ইস্কুল কি এখানে ছিল ?
হ্যাঁ । কিন্তু ওটা ত এখন নেই । ওটা তারাসুন্দরি উচ্চ মাধ্যমিকের সাথে জুড়ে গেছে । ওটাতে শিক্ষক ও ছাত্র দুটোই কম থাকায় তারাসুন্দরির সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে । আমিও একসময় অবোধচন্দ্রে পড়িয়েছি । পরে অবশ্য অন্য ইস্কুলে চলে যাই ।এখন অবসর নিয়েছি । ইস্কুলে আপনাদের কাজ ছিল ?
হ্যাঁ । খুব দরকার ।
আপনারা গৌহাটি থেকে এসেছেন । যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি ?আপনারা কি সার্টিফিকেট তুলতে এসেছেন ?
হ্যাঁ । একদম ঠিক বলেছেন । বাবা ঐ ইস্কুলে পড়েছিলেন । বুঝলেন কাকাবাবু , কোনও কারণে বাবার লিগ্যাসি বের হয়নি । সার্টিফিকেট তোলাটা খুব দরকার ।
  প্রৌঢ় অসহায়ের মত  মাথা নাড়েন । বলেন কিন্তু পাবেন কি ? পুরোনো কাগজপত্র কীভাবে ওরা সংরক্ষণ করেছে তার ওপর নির্ভর করছে । বুঝতেই পারছেন , একটা ইস্কুল আরেকটা ইস্কুলের সাথে জুড়ে গেছে । তোমার বাবা কি আছেন ?
না ।
রাইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে । স্রোতে ভেসে যাওয়া খড়কুটো চেপে ধরতে চায় । বলে তারাসুন্দরি ইস্কুলটা কোথায় ?
সে ত এখান থেকে দুকিলোমিটার ভেতরে ।
রাই মায়ের দিকে তাকায় । মা ঘোলাটে দুটো চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে । অনেকটা খানিক আগে দেখা বৃদ্ধের দৃষ্টির  মত ।একটা তীব্র আতঙ্ক ও ভয় শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে ।টের পায় রাই । চারপাশটা তার কাছেও অন্ধকার হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত । তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মনে হয় কেউ বলছে আহা হা উনি পড়ে যাচ্ছেন , হাতটা ধরুন , প্লিজ ।