গৌহাটির বাসটা ছাড়ল শেষ পর্যন্ত । খানাপাড়া আই এস বি টি –তে দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকে । রাইয়ের ভয় করছিল । সাথে মা রয়েছে । আর কেউ নেই
। কে-ই বা থাকবে !
গৌহাটির পাঞ্জাবাড়িতে থাকে সে , মানে রাই
ও তার মা । ভাড়াবাড়ি । পাশের বাড়িতে কাকা রয়েছে । কাকা ত তার নিজের ছেলেমেয়ে বউ
নিয়েই ব্যস্ত । রাই অন্যত্র থাকতে পারত , কাকার পাশের বাড়িতে ভাড়া নিয়েছে এই ভরসায় যে হাজার হোক কাকা ত ,
আপদবিপদ হলে ফেলতে পারবে না , কিন্তু কার্যত তা হয়নি ।
নিজেকে দুর্ভাগা বলেই জানে রাই । বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্বামী তাকে ছাড়ল । মা-র কাছেএকটা মোটরবাইক দাবি করেছিল । দিতে পারেনি মা । কোথা থেকে দেবে ? বাবা মারা গেল হঠাৎ । একটা সিমেন্ট কোম্পানিতে সামান্য কর্মচারী ছিল বাবা । ওখানেই কাজ করতে করতে হার্ট অ্যাটাক হয় । বাবার সামান্য পেনসন আর গ্রাচুইটির সামান্য টাকা । তা থেকেই অনেক কষ্টে বিয়েটা দিয়েছিল মা । কাকার পছন্দের পাত্র । ও বাড়িতে বেশিদিন থাকেনি সে । থাকতে পারেনি । শাশুড়ি ছিল ভারি দজ্জাল । দিনরাত মানসিক নির্যাতন । ওসব নিয়ে আজকাল ভাবে না রাই । জীবনটা খুব সাময়িক । মানে আজ এই মুহূর্তে ভাল থাকাটা খুব জরুরি । কাল কি হবে অথবা একটু পরেই কি হতে
চলেছে সেটা নিয়ে ভাবতে নেই । এই-ই নাকি এই সময়ের অমোঘ বার্তা । সবাই বলে । সে-ও তাই বিশ্বাস করে । সিমেন্ট কম্পানিতে অনেক বলে কয়ে
কোনক্রমে একটা চাকুরি মিলেছে তার ।
গাড়িটা চলছে । শিলঙের রাস্তা ধরেছে এখন । শেষ অব্দি তারা যেতে পারবে কিনা জানে না রাই । মা-র শরীরটা একদম ভাল নয় । নার্ভের সমস্যায় ভুগছে মা । হাত-পা কাঁপে । মাথাটাও
সোজা করে রাখতে পারে না । হাল্কা
কাঁপন লেগেই আছে ।
মেঘালয় সীমান্তেও গোলমাল । বাস থামিয়ে
কাগজপত্র দেখতে চাইছে । ঠিকঠাক না পেলে উল্টো গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে । এরা কোন সাহসে
এত কিছু করছে সেটাই ত ভাববার বিসয় । কোন অধিকারে এত হেনস্থা করার সাহস পাচ্ছে ?
রাই তাই ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড ব্যাগে রেখেছে নিজেদের ।
তবু ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছে যদি নাগরিক পঞ্জির ২ নং খসড়ায় ওঠা নামের প্রমানপত্রটি
দেখতে চায় ? রাইয়ের
নাম খুঁজে পাওয়া যায় নি নাগরিক পঞ্জির দ্বিতীয় খসড়ায় । নাম উঠেনি । তার বাবা
জগবন্ধুর লিগ্যাসি ডেটা পাওয়া যায়নি । কেন পাওয়া যায়নি সেসব প্রশ্নচিহ্ন । ১৯৬২
সালের ভোটার তালিকায় বাবার নাম আছে । তবু লিগ্যাসি না থাকায় ঐ কাগজটা যথার্থ নথি
হিসেবে গ্রাহ্য হয়নি । এন,আর,সি সেবাকেন্দ্রে এর কারণ জিজ্ঞেস করেও যুক্তিসহ উত্তর মেলে নি । হয়রানি আর
হয়রানি ।
গাড়িটা শিলং যাওয়ার পথে । আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ । অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে যাচ্ছে হেডলাইট । গোটা দুনিয়াটাই আজ যেন রহস্যময় । এই প্রেক্ষিতকে সে চেনে না ।এই অচেনা গোলোকে সে খুব একা । গাড়িটা ছুটছে খুব দ্রুত । জানালার বাইরে ঘন অন্ধকার । গূঢ় রহস্যে মোড়া কিছু বৃক্ষ অন্ধকার অথবা আলোছায়ার ভেতর অনিবার্য দ্রুততায় সরে সরে যাচ্ছে । গাড়ির গতি যেন বেড়েই চলেছে । এত দ্রুতগতিতে ছুটছে যে রাইয়ের মা সুনীতি ভয় পেয়ে মেয়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে । রাই কন্ডাকটরকে বলে –
-ও ভাই, এত জোরে চালাতে বারণ কর ড্রাইভারকে ।
পাহাড়ি পথ , কখন কী হয়ে যাবে !
- চোখ বন্ধ
করে নিন , চোখ বন্ধ করে নিন , তাহলে
ভয়টা কম হবে ।
- এ আবার কী
কথা ?
- নাহলে
গাড়ি থামিয়ে হুজ্জোতি করবে খাসিয়া ছাত্রগুলো । কাগজ চাইবে । কোনরকমে পেরিয়ে গেলে
ভাল । আপনাদের জন্যেই ত !
রাই এবার
চুপ । যা হয় হোক । নাহয় খাদেই পড়ে গেল । নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে গেল দুজনায় । মা ও
মেয়ে মুক্তি পেয়ে গেল ! না না , এসব কি
ভাবছে সে ? একটুও না ,
বাঁচবে তারা । এই দুনিয়ায় সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে ।
চোখ বন্ধ করে নেয় রাই । ছুটুক , এমনি দুরন্ত বেগে ছুটে চলুক গাড়ি । সব অন্ধকার চিরে চিরে দেখে নিক হেডলাইটের
তীব্র আলো । অচেনা অন্ধ কোণগুলো যাবতীয় রহস্য বুকে আগলে রাখুক । তবু এর শেষ দেখে
যাবে সে ।মাঝপথে কেন সে হারিয়ে যাবে ?
পরদিন
শিলচর শহরে পৌঁছোল তারা বেলা
এগারটায় ।সুবোধকাকুর বাড়ি সুভাষনগর ।
বাবার খুড়তুতো ভাই । তেমন যোগাযোগ ছিল না । কাকা-ই যোগযোগ করে অন্তত দুটো দিন থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে । এ শহরে রাই এসেছিল খুব ছোটবেলায় । এখন সেসব ধূসর স্মৃতি , শুধু মনে পড়ে এক শান্ত নিরুপদ্রপ
শহরকে । নাম ছিল শান্তির দ্বীপ । আজ যে শহরকে দেখা যাচ্ছে সেখানে তীব্র যানজট ,
ধুলো আর শ্রাবণ মাসের ভারী দমচাপা গরম ।
কাকার
বাড়ি যখন পৌঁছানো গেল তখন দুপুর
সাড়ে বারো পেরিয়ে গেছে ।
২
বুঝেছিস রাই , ১৯৫০ সালের কথা । আমি তখনও জন্মাইনি ,
কিন্তু দাদার কাছে ,
আমার বাবার কাছে
শুনেছি । তাছাড়া এই ডাইরিটা দেখ
।পুরনো কাঠের আলমারি থেকে একটি ধূসর ডাইরি বের করে আনে কাকা ।
ডাইরির পাতা ওলটায় । একটি
পৃষ্ঠায় এসে কাকার আঙ্গুল স্থির হয়ে যায় । বলে , এখানে , এখানে
রয়েছে সেইসব দুঃসহ দিনগুলোর বিবরণ । বুঝেছিস মা রাই । দেশভাগ ।ছিন্নমূল মানুষের
জীবনকথা । কার লেখা বলতো ? তোর বাবার
।
বাবা ?
বাবা লিখে গেছে ? তুমি আমাকে বল নি ত কোনদিন ?
কি করে বলব ?
তোরা ত আমাদের ভুলেই গেছিস । আজ ঘটনাচক্রে এখানে এলি !
কথাটা ঠিক ।
আসলে নিজের কাকা যেমন দায়সারা
সম্পর্কে আছে তাদের সাথে ,
খুড়তুতো কাকাকে তাই
আর জড়াতে চায়নি সে । দুজন পুরুষবিহীন নারী
। কখন কোন বিপদে পড়ে যায় , সেই ভয়
তার নিজের কাকার ত আছে !
পড়ে দেখ
রাই , কী ভয়ানক সব বিবরণ ! পড়ল রাই । সত্যি ভয়ানক । হঠাৎ করে যদি ফরমান জারি হয় পুরুষানুক্রমে বাস করা এই
জমি মাটি বাড়ি তোমার নয় , যদি রাতের
অন্ধকারে এক বস্ত্রে লুকিয়ে ভিটেবাড়ি ছাড়তে হয় , যদি পথে নিজের মেয়ে , স্ত্রীকে
টেনে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তের দল তাহলে কি হতে পারে পরিণতি ?
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে । কিন্তু কখনও যা ভাবেনি এখনও কি তাই
হবে ?
কী হবে আমাদের কাকা ?
আমার , মায়ের ?
এটা ভেবে
লাভ নেই মা , যখন যা হয়
। আমার পায়েল এর জন্যে ভাবনায় ভাবনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি । তোর কাকিমা ছুটছে । আমি
দোকান ফেলে যেতে পারছি না । পায়েলেরও খসড়া তালিকায় নাম ওঠেনি ।
৩
রাইদের
শিলচরে আসার একটাই কারণ । অবোধচন্দ্র মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে যাওয়া । বাবা ঐ ইস্কুলে
পড়েছিল । ক্লাস সিক্স অব্দি । ওখান থেকে একটা ইস্কুল সার্টিফিকেট জোগাড় করা চাই ।
ইস্কুলটি শহরের উপান্তে , রামনগরে ।
পরদিন রামনগরে এল রাই , মাকে নিয়ে
। আর কেউ সাথে আসতে পারেনি । কাকা আজ দোকান গেছে । গতকাল ওরা আসায় কাকা দোকান
যায়নি । কাকিমা কোথায় যেন যাবে ।
বেশ
ঝাঁঝিয়ে রোদ উঠেছে । অনেকক্ষণ
খুঁজেও অবোধচন্দ্র মধ্যবঙ্গ ইস্কুল পাওয়া গেল না । কেউ কোনও সন্ধানও দিতে পারল না । এক গ্যারাজের কাছে একটি বটগাছ । সেই গাছের
ছায়ায় একটি হাতল ভাঙ্গা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধ । কেউ একজন বলল - এঁকে জিজ্ঞেস করে দেখুন , ইনি জানতেও পারেন ।
রাই
বৃদ্ধের কাছে আসে । বলে –
শুনছেন ?
বৃদ্ধ
তাকাল । চোখদুটিতে কী যেন রয়েছে । এক অচেনা ভয় এলো । এই ভর দুপুরে চারপাশে কোনও
মানুষ দেখতে পেল না সে । গ্যারাজটিও ফাঁকা । আশ্চর্য ! কিছু আগে গ্যারাজে লোকজন দেখা গেছে । লোকটা কোনও উত্তর করছে না । তাকিয়ে আছে একইভাবে । রাই আমতা আমতা করে –
কিছু মনে করবেন না । আপনাকে বিরক্ত করছি । মানে আমি জানতে
চাইছি ...
বলতে পারল না রাই বাকি থাকা
কথাটি । লোকটি ভয়ঙ্কর হাসল । এমন বীভৎস হাসি সে কখনও দেখেনি ।
আমি-ই অবোধচন্দ্র , ইস্কুলটি আমি-ই
করেছিলাম ...
এবার রাই শুনতে পায় মা বলছে ,
- রাই , এই খোলা
জায়গায় ঘোরাঘুরি করে লাভ কি ! আমি আর পারছি না রে । একটু জল খাবো । কোথাও একটু বসাতে পারবি আমায় ?
-খোলা
জায়গা ? মানে ?
বলে রাই দেখে কেউ নেই । কোথায় সেই বৃদ্ধ অবোধচন্দ্র ?
সেই গ্যারাজ ?
সেই বটগাছ ? ভুল ? এতটাই ভুল ?
সে কি পাগল হয়ে
যাচ্ছে ? কষ্টে কষ্টে এমনটা নাকি হয় ! হ্যালুসিনেশন ? অবচেতন পৃথিবী দৃশ্যমান হয়ে যাওয়া ! না ,
না , মাকে এসব বুঝতে দেওয়া চলবে না । ভয় পাবে মা । মা যে তার ওপরেই ভরসা করে বেঁচে আছে । রাই এদিক ওদিক দেখে । একটি মুদি দোকান দেখা যাচ্ছে । অদূরেই ।
মাকে নিয়ে ঢুকে সে । দোকানিকে
বলে ,
- এখানে
একটু বসা যাবে ? মা-র শরীরটা একটু খারাপ
লাগছে ।
লোকটি জিনিষপত্র ওজন করছে ।
খদ্দের দাঁড়িয়ে । এক পলক দেখল শুধু । তারপর হাঁক দিল
এই বলাই ,
একটা চেয়ার এনে দে
ত ভেতর থেকে ।
রাই দেখে একপাশে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক
বসে আছেন । চেয়ারটা এনে দেয়ার পর মা-কে বসিয়ে রাই তার ঢাউস কাঁধব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে মা-কে দেয় ।
কোথা থেকে আসছেন ?
– প্রৌঢ়ের প্রশ্ন ।
গৌহাটি ।
ও । এখানে কি কিছু খুঁজছেন ?
অবোধচন্দ্র মধ্যবঙ্গ ইস্কুল বলে
একটা ইস্কুল কি এখানে ছিল ?
হ্যাঁ । কিন্তু ওটা ত এখন নেই ।
ওটা তারাসুন্দরি উচ্চ মাধ্যমিকের সাথে জুড়ে গেছে । ওটাতে শিক্ষক ও ছাত্র দুটোই কম
থাকায় তারাসুন্দরির সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে । আমিও একসময় অবোধচন্দ্রে পড়িয়েছি । পরে
অবশ্য অন্য ইস্কুলে চলে যাই ।এখন অবসর নিয়েছি । ইস্কুলে আপনাদের কাজ ছিল ?
হ্যাঁ । খুব দরকার ।
আপনারা গৌহাটি থেকে এসেছেন । যদি
কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি ?আপনারা কি সার্টিফিকেট তুলতে এসেছেন ?
হ্যাঁ । একদম ঠিক বলেছেন । বাবা
ঐ ইস্কুলে পড়েছিলেন । বুঝলেন কাকাবাবু , কোনও কারণে বাবার লিগ্যাসি বের হয়নি । সার্টিফিকেট তোলাটা খুব দরকার ।
প্রৌঢ় অসহায়ের মত মাথা নাড়েন । বলেন –কিন্তু পাবেন কি ? পুরোনো
কাগজপত্র কীভাবে ওরা সংরক্ষণ করেছে তার ওপর নির্ভর করছে । বুঝতেই পারছেন ,
একটা ইস্কুল আরেকটা ইস্কুলের সাথে জুড়ে গেছে । তোমার বাবা
কি আছেন ?
না ।
রাইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে ।
স্রোতে ভেসে যাওয়া খড়কুটো চেপে ধরতে চায় । বলে – তারাসুন্দরি ইস্কুলটা কোথায় ?
সে ত এখান থেকে দু’কিলোমিটার ভেতরে ।
রাই মায়ের
দিকে তাকায় । মা ঘোলাটে দুটো চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে । অনেকটা খানিক আগে দেখা বৃদ্ধের
দৃষ্টির মত ।একটা তীব্র আতঙ্ক ও ভয় শিরায়
শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে ।টের পায় রাই । চারপাশটা তার কাছেও অন্ধকার হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত
। তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মনে হয় কেউ বলছে –আহা হা উনি পড়ে যাচ্ছেন , হাতটা ধরুন , প্লিজ ।